গোবর: সাধারণ কিন্তু সম্ভাবনাময়
অমৃত কুমার সরকার
বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকে গোবর কৃষিজমির পুষ্টি ও উর্বরতা বৃদ্ধি এবং গৃহস্থালির জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার হলেও অতি সাধারণ এই জৈব উপকরণটি যে নানাবিধ কাজে ব্যবহার হতে পারে সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে সেটি ক্রমশই উন্মোচিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গোবরে উচ্চমাত্রার এমন সব জিন পেয়েছেন যা এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভাংড়া গ্রামের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী আব্দুস সালাম গোবর থেকে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে যানবাহন চালানোর প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন।
বাংলাদেশের কৃষিউৎপাদন ব্যবস্থা খুব ধীর গতিতে হলেও পরিবর্তিত হচ্ছে। বাস্তব কারণেই কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারও ক্রমশ বাড়ছে। আগের দিনে প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে জমিচাষ, ফসল মাড়াই, ফসল পরিবহন, বিক্রি ও যোগাযোগ কাজের জন্য গরু ব্যবহারের প্রচলন ছিল। সেই সময় গোবর ফসলের জমিতে ব্যবহার বা জ্বালানি তৈরির জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। গোবরের জ্বালানিই তখন ছিল বর্ষাকালে রান্নার অন্যতম উপকরণ-শহর এবং গ্রাম উভয়ক্ষেত্রেই। এখনও শহরের বস্তি এলাকা, শহরের চায়ের দোকান ও খাবার হেটেলে রান্নার কাজে এই জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়নের উপরপাড়ার জাহানারাবানু (৪৫) গোবরের লাকড়ি তৈরি করে বিক্রি করছেন প্রায় ১০ বছর যাবত। তিনি প্রতিটি লাকড়ি ৪-৫ টাকায় বিক্রয় করে প্রতিবছর ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করেন বলে জানালেন। তার মতো গ্রামের অনেক নারীই গোবর দিয়ে জ্বালানি তৈরি ও বিক্রয় করে পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে ভূমিকা রাখছেন।
আবার বহুপূর্ব থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে গোবর শুদ্ধতা ও পবিত্রতার অংশ হিসেবেও পরিগণিত হয়ে আসছে। রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার গোকুল মথুরা গ্রামের কৃষক শ্রী রমেন্দ্রনাথ সূত্রধর (৮৫) জানালেন, “গোবর আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। আমাদের পবিত্রতা রক্ষায় গোবরের প্রচলন আছে। গৃহস্থরা গোবরে লেপা উঠোনে ফসল রেখে মাড়াই ও সংরক্ষণ পূর্ববর্তী কাজ করেন; এতে ফসলে ধুলা-বালি কম হয়।” তিনি আরো বলেন, “সেদ্ধ ধান শুকানোর জন্যও গোবর লেপা উঠোনের দরকার হয়। বরেন্দ্র এলাকায় মাটির দেয়ালের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য গোবর দিয়ে লেপার এখন প্রচলন রয়েছে।”
গরুর গোবর থেকে জৈব সার, কেঁচো সার, কীটনাশক ও বায়োগ্যাস উৎপাদন শুরু হয়েছে অনেক দিন ধরেই। গোবর থেকে পাওয়া বায়োগ্যাস সংকুচিত করে মোটরগাড়ির জ্বালানি তৈরির পরীক্ষামূলক ব্যবহারও শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এই সংকুচিত বায়োগ্যাস পরীক্ষামূলকভাবে রাজশাহীর পুঠিয়ার আব্দুস সালাম নিজের গাড়িতে ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজের ‘স্বাতি ডেইরি’ খামারে গোবর থেকে গ্যাস দিয়ে হিউম্যান হলার চালাতে সক্ষম হয়েছেন। এই জন্য তিনি নানা ধরনের যন্ত্রপাতি বসিয়েছেন নিজের খামারে। মাটির নিচে স্থাপন করেছেন গ্যাস মজুতের কটেইনার। গোবরের গ্যাস থেকে এই সংকুচিত বায়োগ্যাস দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে হিউম্যান হলার চালিয়েছেন তার গ্রামেরই হলার চালক দবির উদ্দিন (৫০)।
অনুজীববিদ জো হ্যান্ডেলসম্যান এর নেতৃত্বে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গরুর গোবরে উচ্চ মাত্রার এমন সব জিন পেয়েছেন যা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের একটি গরুর খামার থেকে সংগৃহীত নমুনায় ৮০টি স্বতন্ত্র অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন পেয়েছেন। যাদের তিন ভাগই নতুন এবং যা পেনিসিলিন এবং টেট্রাসাইক্লিনের মতো সুপরিচিত অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে কাজ করে। মার্কিন এই গবেষকরা পরবর্তীতে এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীনগুলো মানবদেহে প্রবেশ করিয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
অতি সাধারণ জৈববর্জ্য গোবর আজ তাই শুধু জমির সার আর জ্বালানিই নয়। গোবরেরও রয়েছে সম্ভাবনাময় নানা দিক। গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত হতে পারে সম্ভাবনার সেই অপার দিগন্ত; যা মানুষ ও পরিবেশের জন্য ভবিষ্যতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।