লোহার সাথে যুদ্ধ করে জয়ী শ্যামনগরের জবা রানী দেবনাথ
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে মারুফ হোসেন (মিলন)
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নূরনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ হাজিপুর গ্রামের সবুজ শ্যামল গ্রামে স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করেন জবা রানী দেবনাথ। ১৯৬৮ সালে সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার ধূলিহর গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী শিবপ্রশাদ দেবনাথ ও মা ভবানী রানী দেবনাথের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৪ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে জবা ছিলেন দ্বিতীয় (মেঝ) সন্তান।
১৯৮২ সালে জবা রানীর বয়স যখন ১৪ বছর এবং নবম শ্রেণীর ছাত্রী ঠিক তখনেই শ্যামনগর নকিপুর গ্রামের অসিত কুমার দেবনাথের সাথে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন তিনি। স্বামী অসিত কুমার দেবনাথ সাইকেল মেকানিকের কাজ করতেন। স্বামীর বাড়ীতে সুখ শান্তিতেই কাটছিলো জবার দাম্পত্য জীবন। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই জবার জীবনে নেমে আসে দুঃখের অন্ধকার। স্বামী অসিত দেবনাথের সরলতার সুযোগ নিয়ে আপন ভাই সব জমি আত্মসাৎ করে। ফলে অভাব অনঠনের মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে মনের কষ্টে নিজেদের জমানো কিছু টাকা এবং জবার বাবার নিকট থেকে কিছু টাকা নিয়ে বাড়ী ত্যাগ করে শ্যামনগর উপজেলার নূরনগর ইউনিয়নের হাজিপুর গ্রামে আসে জবা। মাত্র ৭ শতক জমি ক্রয় করে বসতি স্থাপন করে তারা।
১৯৮৬ সালে জবা আনছার ভিডিপি এর রাইফেল ট্রেনিংয়ে যোগদান করার পরে আনছার ভিডিপির কাজ করতে থাকে, যেটি এখনও চলমান আছে। আনছার ভিডিপির মাধ্যমে জবা উপজেলার ভোট, পূজা,অনেক অভাব অনটনে কাটতে থাকে জবার সংসার। স্বামী অসিত দেবনাথ সাইকেল মেকানিকের কাজ করে দিনাতিপাত করতে থাকে। কিন্তু স্বামীর শারীরিক দূর্বলতা, অচলাবস্থা ও কষ্টের কথা চিন্তা করে স্বামীর হাতের কাজে সহযোগিতা করতে থাকে জবা। সহযোগিতা করতে করতে এক পর্যায়ে জবা হয়ে ওঠে একজন ভালো দক্ষ ভ্যান ও সাইকেল ম্যাকানিক ।
শুরু হতে থাকে জবার সফলতার গল্প। ১৯৯৮ সালে গ্রামে বিদ্যুৎ লাইন আসার পর জবা লোহার কাজ (ওয়ার্কসপ)এর দোকান বানানোর স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্নের কথা তার স্বামীকে জানায়। স্বামী তার ইচ্ছা পূরন করে জমানো টাকায় নিজস্ব ভিটায় একটি ওয়ার্কসপের দোকান করে দেন। জবা নিজেই শিখে ফেলে লোহা পিটিয়ে গেট, গ্রিল,সাটার,জানালা,দরজা সও বিভিন্ন কাজ। বিভিন্ন মেশিন মেরামত ও ঝালাইয়ের করার কাজও সে নিজে করতো। ওয়ার্কসপের কাজে ব্যাপক সফলতা আসে জবার। জবা জমানো টাকা দিয়ে ১৮ শতক বসত ভিটা, ৫ বিঘা ধানের জমি ক্রয় করে। ৮ রুম বিশিষ্ট ২ তালা পাকা বাড়ী তৈরী করে। জবা জমানো টাকা দিয়ে বড় ছেলেকে এইচএসসি পর্যন্ত এবং ছোট ছেলেকে মাষ্টার্স পর্যন্ত লেখাপড়া শিখিয়েছেন, বড় ছেলেকে স্টুডিওর দোকান করে দিয়েছেন। দুটো ছেলেকে অনেক অর্থ ব্যয় করে বিয়ে দিয়েছেন।
জবা রানী পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অনেক টাকার মালিক হলেও এখনও টিকিয়ে রেখেছেন ওয়ার্কসপের কাজটি। লোহাকে পিটিয়ে অর্থ উপার্জন করে চলেছে এই মহিয়সী নারী। জবা রানী বলেন, ‘ওয়ার্কসপের কাজে সফলতা পেয়েছি সুতারাং জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত এই পেশাকে জড়িয়ে থাকতে চাই। আমার মত অন্য মেয়েরা নিজ ইচ্ছায় নিজেকে,পরিবারকে,সমাজকে বদলে দিতে পারে তার জন্য প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি ও লক্ষ্য।’ এ বিষয়ে জবার স্বামী অসিত বলেন-‘আমার স্ত্রীর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও মনোবল তাকে আজ সাফল্যর দোয়ারে পৌছে দিয়েছে, আমি তার ইচ্ছার কোনদিন বিরুদ্ধে যাইনি। আমি জবার প্রতিভা ও ইচ্চেশক্তিকে কখনও পিছিয়ে যেতে দেইনি, সে যেটা বলেছে বা করতে চাচ্ছে সেটাকে আরো উৎসাহ দিয়েছি।’
জবার প্রতিবেশী ব্যাবসায়ী আব্দুল হান্নান বলেন- ‘এমন দক্ষতা সম্পন্ন নারী এলাকায় আমি দেখিনি। তিনি নারী হয়ে যে কাজ দীর্ঘদিন করে আসছে একজন পূরুষ মানুষও সহজে করতে পারে না। আমার দোকানের ও বাড়ির অনেক শাটার, গেট, গ্রীল জবা করে দিয়েছে। তাকে দেখে অনেক কিছূ শেখার আছে আমাদের।’ গ্রামের অন্য প্রতিবেশি জামাত আলী সরদার তার কথার সাথে মিলিয়ে বলেন- ‘আমি ভ্যান চালাই আর এতে করে যখন আমার ভ্যানের কোন সমস্যা দেখা দিতো আমি জবার কাছ থেকে ঠিক করে নিয়ে যেতাম।।’ জবা রানী যে কাজ করে যাচ্ছে তা সকলের জন্য একটি দৃষ্টান্ত।এ কাজ করার ফলে জবা রানীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।জবা রানী নিজের মনোবল, অদম্য সাহস, ইচ্ছাশক্তি, এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে, সংসারকে পৌছে দিয়েছেন সফলতার দ্বারপ্রান্তে।