পানখালী আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর একটি সমন্বিত উদ্যোগ

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল ও আল ইমরান

প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুভিটা বিচ্ছিন্ন এক পুনর্বাসন কেন্দ্র বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের আশ্রয়ন প্রকল্প। ২০০২ সালের দিকে ৩ একর জায়গা নিয়ে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামে একটি ব্যারাক তৈরি করা হয়। পানখালী আশ্রয়ন প্রকল্প স্থানীয়ভাবে যা পানখালী ব্যারাক নামে পরিচিত। একটি ভাগে ৫টি শেড তৈরি হয়। প্রতিটি শেডে ১০টি করে ঘর রয়েছে। মোট ৫০টি ঘর নিয়ে ব্যারাক নির্মিত হয়। শ্যামনগর উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৪টি গ্রামের জেলে, হিন্দু ও মুসলিম ৩০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। ২০০৯ সালের আইলা ঘটে যাওয়ার এই দীর্ঘ সময় পরেও নিজেদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে না পেরে আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাস করছে তারা।

আশ্রয়ন প্রকল্পে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য গৃহায়ন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে পানির সুব্যবস্থা, স্যানিটেশন ও যোগাযোগের রাস্তা করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় সংস্কার বা মেরামতের অভাবে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর, সুপেয় পানির পুকুর, স্যানিটেশন ও যোগাযোগের রাস্তা বর্তমানে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে, ব্যবহারের পুকুরটি প্রায় ভরাট অবস্থায় যে কারণে বর্ষা মৌসুমে আশ্রয়ন কেন্দ্রে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে করে ব্যারাকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হতে থাকে তাদের বসবাস অনুপোযোগী হয়ে উঠে।

pic-1jpg
একপর্যায় ২০১৪ সালে জানুয়ারি মাসে বারসিক কর্মকর্তারা মাঠ পর্যবেক্ষণে পানখালী আশ্রয়ন প্রকল্প পর্যবেক্ষণ এবং স্থানীয়দের সাথে আলোচনা করে। আলোচনায় ব্যারাক জনগোষ্ঠী তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, “আমাদের ব্যারাকে দীর্ঘদিন কাজ না হওয়াতে পুকুরের পাড়গুলো ভেঙে গেছে, ভিটা অনেক নিচু হয়ে গেছে, পুকুর ভরাট হয়ে গেছে এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এমতাবস্তায় ব্যারাকের পুকুর পুনঃখনন, পাড় মেরামত না করা হলে আমাদের বসাবাস করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে।”

পানখালী ব্যারাকের বসবাসকারী জনগোষ্ঠী তাদের সার্বিক পানি কষ্ট লাঘবে বারসিক শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। এরপর বারসিক শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তারা উক্ত জনগোষ্ঠীর পানি সমস্যা সমাধানে তাদের পুকুর পূনঃখননে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর একটি আবেদনপত্র লিখে জমা দিতে সহযোগিতা করা হয়। বারসিক কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে উক্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের সাথে আলোচনা করেন। এ সময় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাদের পুকুরটি ৪০দিনের কর্মসূচির শ্রমিক দিয়ে পুনঃখনন করে দেওয়ার জন্য জনগোষ্ঠীর আবেদন পত্রের অনুমোদন দেন। পাশাপাশি পুকুরের পানি সেচ দিয়ে পুনঃখনের উপযোগী করতে উক্ত জনগোষ্ঠী বারসিকের কাছে লিখিত আবেদন করেন। আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী ও বারসিক এর যৌথ উদ্যোগে পুকুরের পানি অপসারণ করে পুকুর শুকানোর ব্যবস্থা করা হয়।

pic-3
পুকুর শুকানোর পর মে ২০১৪ সালে ইউনিয়ন পরিষদের কর্মসৃজন কর্মসূচির মাধ্যমে পুকুরটি পুনঃখননের মাধ্যমে পুকুর পাড়ে মাটি দিয়ে ভিটা উচু ও পাড় বেঁধে দেয়া হয়। এরপর বারসিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্টানের সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠী যোগাযোগ করে ব্যারাক সবুজায়ন করতে সক্ষম হয়। ব্যারাক জনগোষ্ঠী মোমিন গাজী বলেন, “পুকুর খনন এবং পাড় সংস্কারের ফলে আমাদের সবজি চাষাবাদ এবং মাছ চাষের মাধ্যমে খাদ্য চাহিদা পূরণ হলেও বসবাসের ঘর, লেট্রিন, ক্লাব ঘরের অবস্থা নাজুক। এগুলো আজ অব্দী কোন প্রতিষ্ঠান কোন দিন সংস্কার করে দেয়নি। আমরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী কিছুটা সংস্কার করেছি কিন্তু তা উপযোগী নয়।” তিনি আরও বলেন, “বারসিকের সহায়তায় বেশ কয়েকবার উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকারের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম কিন্তু এবছর না আগামী বছর এখন বাজেট নেই এসব কথা বলতো। তারপরও আমরা আশা ছেড়ে দেয়নি। সবসময় স্থানীয় সকরার, উপজেলা প্রশাসন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্টানের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছি।”

pic-4
এবছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জানুয়ারি ও ফ্রেব্রুয়ারি মাসের এক আলোচনাসভায় বিষয়টি নিয়ে উপস্তাপন করা হয় এবং বারসিকের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। বারসিক’র সহায়তায় তারা আবার আবেদনপত্র তৈরি করে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সুপারিশ নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের নিকট জমা দেন। এক পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে সহায়তা করার আশ্বাস প্রদান করা হয়। এসময় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানতে চান যে ব্যারাক জনগোষ্ঠী কোন কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছে কিনা। স্থানীয় জনগোষ্ঠী সাথে সাথে বারসিক’র কথা জানান। এরপর বারসিক কর্মকর্তারা উপজেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করেন। যোগাযোগ করার ফলে উপজেলা প্রশাসন থেকে দ্রুত কার্যক্রম শুরুর কথা জানানো হয়।

উপজেলা প্রশাসন একজন প্রকৌশলীকে দিয়ে ব্যারাকের সমস্ত ঘর মাপার জন্য বারসিককে আহবান জানান। এভাবে গত ১০ মে ২০১৮ বারসিক কর্মকর্তারা শ্যামনগর উপজেলা থেকে একজন প্রকৌশলী দিয়ে ব্যারাকের সমস্ত ঘরের মাপ জোকের কাজ সম্পন্ন করেন। এরপর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে দিয়ে একটি বাজেট তৈরি করে উপজেলা প্রশাসনের নিকট জমা দেওয়া হয়। বারসিক’র সমন্বয়ে তৈরিকৃত বাজেটটি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ ও দূর্যোগ মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা পাশ হবে এবং কার্যক্রম শুরু হবে বলে প্রশাসন থেকে জানানো হয়।

pic-2
অন্যদিকে এই কাজটি কোন সময় এবং কি অবস্থায় আছে কিভাবে করা হবে তার জন্য উপজেলা প্রশাসন বারসিককে সার্বক্ষণিক স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং উপজেলা প্রশাসনের যোগাযোগ রাখার কথা জানিয়েছেন। পানখালী ব্যারাকে বসবাসকারী মোমিন, আক্তার আলী, মোরালী, আহম্মদও রাসিদারা বলেন, “বারসিকের সহযোগিতায় আমাদের আগে পানি ও সবজি চাষের সমস্যার সমাধান হয়েছে। তারা (বারসিক কর্মকর্তারা) পথ না দেখালে আমাদের পক্ষে কাজটি করা সম্ভব হত না। আর যদি আমাদের এ ঘরের কাজটি হয় তাহলে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকবো বারসিক ও প্রশাসনের নিকট। আমাদের খাদ্য চহিদা পূরণের সাথে সাথে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারবো।”

happy wheels 2

Comments