নেত্রকোনায় শতবর্ষী প্রবীণ ব্যক্তিকে সন্মাননা প্রদান

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শতবর্ষী প্রবীণ ব্যক্তিকে সন্মাননা জানিয়েছে আতকাপাড়া কৃষাণ পাঠাগারের সদস্যরা। সম্প্রতি আব্দুল মান্নান তালুকদার নামক প্রবীণ এই ব্যক্তিকে তাঁর নিজ বাড়িতে সন্মাাননা প্রদানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আতকাপাড়া কৃষাণ পাঠাগারের সদস্যগণ, ৬নং লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সংরক্ষিত মহিলা আসনের জনপ্রতিনিধি এবং বারসিক কর্মকর্তাগণ।


বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৮মাস (সূত্র-প্র:আলো ২৭ জুন ২০২১ইং)। এই তথ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখনো দিব্যি সুস্থ আছেন আব্দুল মান্নান তালুকদার। বর্তমানে তাঁর বয়স ১০২ বছর। তিনি লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামে বসবাস করছেন। তাঁর এক ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছে। ১৯২০ সালের ৩ জানুয়ারি ভোর বেলায় নানার বাড়িতে তাঁর জন্ম হয়। নেত্রকাণা জেলার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীর পুর গ্রামে ছিল তাঁর নানা বাড়ি। সেখানেই তাঁর বেড়ে উঠা এবং লেখাপড়া। বাবা ছিলেন একজন কৃষক। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তান।

লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারেননি। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। তাঁর নিজের বাড়ি মদন উপজেলার ‘বাড়িভাদেরা’ গ্রামে। সেখানেই তিনি বাবার সাথে কৃষি কাজ করতেন। সময়টা ছিল ভাষা আন্দোলন ও দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে। তখনকার দেশের চিত্র বর্তমান সময়ের মতো ছিলনা। সেই সময়ে পড়াশুনারও এতো গুরুত্ব ছিলনা। তাই তিনি বেশি লেখাপড়া করেননি।
১৯৬০ সাল, সেই সময়ে আমাদের দেশ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনে। তিনি কুমিল্লা বেড়াতে গিয়েছিলেন, এক আত্মীয় বাড়িতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন পুলিশে লোক নিয়োগ হচ্ছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এ অনেকের সাথে তিনিও লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি পুলিশে চাকরি পেয়ে যান। সারদা’ ট্রেনিং একাডেমি থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকা শহরের ১নং পুলিশ ফাঁড়িতে কাজে যোগদান করেন।


১৯৬৮ সালে আতকাপাড়া গ্রামের নূরজাহান আক্তারের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি পরিবারসহ ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানেই তাঁর ছেলে মেয়ের জন্ম হয়। তাদের লেখাপড়াও করিয়েছেন ঢাকায়।


১৯৯৩ সালে তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর আতকাপাড়া গ্রামে চলে আসেন। শ্বশুরের কাছ থেকে জায়গা কিনে বাড়ি করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। কারণ ততোদিনে তাঁর মা বাবাসহ ভাইবোন সবাই মারা গেছেন।
বাড়িতে ফিরে তিনি চাকুরিতে থাকাকালীন শারীরিক ব্যায়াম ও হাঁটার অভ্যাসটা ত্যাগ করেননি। প্রতিদিন ভোর বেলায় উঠে তিনি হাঁটতে বের হতেন। প্রায় ৬/৭মাইল হেঁটে বাড়িতে ফিরতেন। তিনি মনে করেন, এই হাঁটার অভ্যাসই তাঁকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে। খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে কোনো নিয়ম ছিলনা। স্বাভাবিকভাবে সব ধরণের খাবারই তিনি খেতেন।


প্রায় বছর খানেক যাবৎ তিনি সকালে হাঁটতে যেতে পারেন না। পায়ে ব্যথা পেয়ে তিনি হাঁটা বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে এখনো তিনি সুস্থ আছেন। শারীরিক কোনো অসুস্থতা নেই। এখনো তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, নিজের কাজ নিজেই করেন। বাড়ির আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করেন। বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা বই পড়েন। পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে তিনি সময় কাটাতে পছন্দ করেন। ছোট শিশুদের খুব ভালোবাসেন। প্রতিদিনের খাবার গ্রহণেও কোনো সমস্যা নেই। শুধু বার্ধক্যজনিত কারণে বর্তমানে তিনি অতীতের অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না।


তাঁর সন্তান ও পরিবারের অন্যরাও তাঁর খুব যত্ন করেন। তাছাড়া গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। কারো সাথে কোনো দিন বিবাদে জড়াননি। তিনি সারা জীবনে কখনো মিথ্যে বলেননি। এমনকি কোনো অসদুপায় অবলম্বন করেননি। তাঁর ন্যায়, সততা ও কর্মদক্ষতার জন্য তিনি অবসরের দিন পর্যন্ত একই জেলায় কাজ করেছেন। তাঁকে অন্য কোথাও বদলি করা হয়নি।
তাঁর এই জীবনে তিনি বাংলাদেশকে বিধ্বস্ত হতে দেখেছেন, নতুন করে গড়তে দেখেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ সবই দেখেছেন। তাঁর আছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেইসব দিনের স্মৃতি তিনি মনে করতে পারেন না। তবুও তিনি বেঁচে থাকুন তাঁর পরিবারের মাঝে, গ্রামবাসীদের মাঝে, আমাদের মাঝে।


মহামারীর ছোবলে জরাজীর্ণ পৃথিবীতে যেখানে নবীন বয়সের শত শত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, সেখানে একজন শতবর্ষী প্রবীণ ব্যক্তি সুস্থভাবে বেঁচে আছেন। পরিমিত শব্দ উচ্চারণ, মার্জিত ভাষা আর স্নেহসুলভ ব্যবহারের এই মানুষটি আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন তাঁর প্রিয় এই মাতৃভূমির মাঝে, পরিবারের মাঝে। গ্রামবাসীর পাশাপাশি বারসিক’র পক্ষ থেকেও তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

happy wheels 2

Comments