একজন আদিবাসী সফল কৃষক নাহাজং হাজং

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে আল্পনা নাফাক:
নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী একটি আদিবাসী গ্রাম বনবেড়া। গ্রামটিতে মূলত হাজং আদিবাসীদের বসবাস। এ গ্রামে মোট ১৬টি পরিবারের বসবাস, এর মধ্যে ১৫টি হাজং ও একটি গারো পরিবার। গ্রামটি ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হওয়ায় যোগাযোগ বিছিন্ন ও অনুন্নত। গ্রামের প্রায় সকল জনগোষ্ঠীই দিনমজুর। গ্রামের অধিকাংশ হাজং পরিবারই দিনমজুরির কাজ করেন। তবে হাজং আদিবাসীরা নারী পুরুষ উভয়েই মাঠে দিন মজুরির কাজ করেন। যাদের সামান্য পরিমাণ কৃষি জমি রয়েছে, যেখানে তারা আমন মৌসুমে এক ফসলী ধান চাষ করে। তবে ২০২০ সালের বোরো মৌসুমে পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করে সকলেই বোরো ধানের চাষ করেছেন।
এ গ্রামেরই বহুমূখী পেশা ও উদ্যোগী এক আদিবাসী কৃষকের নাম নাহাজং হাজং। নাহাজং হাজং একজন দরিদ্র আদিবাসী কৃষক। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ পাঁচজনের সংসার। স্ত্রী সাবিত্রী হাজং একজন গৃহিনী। আজ থেকে সাত বছর পূর্বেও তাঁর মূল পেশা ছিল দিন মজুরি। শ্রম বিক্রির আয় দিয়েই কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে চালাতে হত পাঁচজনের সংসার। বসতভিটাসহ তার মোট জমির পরিমাণ ৬৪ শতাংশ। আবার জমিতে বালির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ধান ও অন্যান্য ফসল তেমন ফলেনা। তাই আমন মৌসুমে সামান্য পরিমাণে ধানের ফলন হলেও তিনি প্রায় ৫০ শতাংশ জমিতে ধান করেন। শুধু নাহাজংই নয় পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাঙালি, গারো ও হাজং সকলেই আমন মৌসুমের পর সেচের ব্যবস্থা না থাকায় সমস্ত জমি সারাবছর পতিত ফেলে রাখেন। আমান মৌসুমে নাহাজং অন্যের জমি বর্গা চাষ করে খোড়াকের ধান ঘরে তোলেন। নাহাজং ২০১২ সাল থেকে বারসিক’র কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন দক্ষতামূলক সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর ও প্রায়োগিক কৃষি গবেষণা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। বারসিক’র সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তিনি বসতভিটায় বছরব্যাপী সবজি চাষের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন। সে শিক্ষা কাজে লাগিয়ে তিনি তার বসতভিটার পতিত জমিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ আরম্ভ করেন। জৈব উপায়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য তিনি নিজে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে জমিতে ব্যবহার করছেন। ফসলের জমির রোগ-বালাই দমনে তিনি ভেষজ কীটনাশক তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করেন।

এই প্রসঙ্গে নাহাজং বলেন, ‘আমি বসতভিটায় সারাবছর সবজি চাষ করে নিজেরা খাচ্ছি এবং বাকিটা বাজারে বিক্রি করে সংসারে খরচ করতে পারছি। রাসায়নিক সার ও বিষ ছাড়া নিজের চাষ করা সবজি খেতে খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। চলতি বর্ষা মৌসুমে আমি চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা, পাটশাক, ঢেড়স, আমন ডাটা ও মরিচ চাষ করেছি। বাড়ির একপাশে পাহাড়ি ছড়ার পাশের জমিতে তিনি ৫০টি থাই পেয়ার চারা রোপণ করেছি প্রায় ছয় বছর আগে বারসিক’র সাথে যুক হওয়ার পরের বছর। বর্তমানে ৩৫টি পেয়ারা গাছ বড় হয়েছে এবং দুই বছর যাবত ফল দিচ্ছে।’ দু’বছর যাবত গাছে পেয়ারা হলেও তিনি একটি পেয়ারাও কখনো বিক্রি করেননি। তার মতে, গাছের ফল আগে জনগণকে খেতে দিলে পরবর্তীতে অনেক ফলন হয়। এছাড়াও সীমান্তবর্তী হওয়ায় গ্রামের আদিবাসী হাজং, গারো ও বাঙালি ছেলে-মেয়েদের পুষ্টির অভাব রয়েছে এবং তারা প্রয়োজনমত ফল খেতে পারেনা। ছেলেমেয়েদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য তিনি পেয়ারা বিক্রি না করে বিনামূলে খেতে দেন। নাহাজং হাজং এর গ্রামটি ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড় থেকে বয়ে আসা পাহাড়ি ছড়ার পাড়ে তার বাড়ি ও কৃষি জমি হওয়ায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নেমে ঢলের ¯্রােতে সমস্ত ফসল ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিবছর ঢলে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় সীমান্তবর্তী গ্রামের কৃষকরা বর্ষা মৌসুমে জমিতে কোন ফসল না করে পতিত রাখে। কিন্তু নাহাজং হাজং অন্যদের মত বসে থাকেননি। তিনি বারসিক’র মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে গিয়ে বস্তায় স্থানান্তরযোগ্য পদ্ধতিতে সবজি চাষের কৌশল শিখে সে শিক্ষা নিজের জমিতে প্রয়োগ করেছেন। তিনি ঢলের হাত থেকে সবজি ফসল রক্ষায় বিগত তিন বছর যাবত বস্তায় সবজি ও মরিচের গাছ রোপণ করে পরবর্তীতে মাঁচায় তুলে দেন। ঢলের পানিতে জমি ডুবে গেলে গাছের তিনটি ডাল পুঁতে ৩/৪ ফুট উঁচু মাঁচা করে তাতে বস্তাগুলো তুলে দেন। ফলে জমিতে কয়েকদিন পানি জমে থাকলেও সবজি বা মরিচের কোন ক্ষতি করতে পারেনা। আবার পানি নেমে গেলে বস্তাগুলো নামিয়ে দেয়া যায়। নাহাজং সারাবছর নিজের উৎপাদিত মরিচ খাওয়ার জন্য বস্তায় কম্পোস্ট মিশ্রিত মাটি ভরে তাতে বারোমাসি সাদা, সবুজ ও কালো উব্দা মরিচ চাষ করেছেন। বস্তা পদ্ধতিতে মরিচ চাষের ফলে বৃষ্টির পানি জমে গেলে বা ঢলের পানি আসলে বস্তাগুলো উঁচু স্থানে সরিয়ে নেয়া সহজ হয়, ফলে নষ্ট হওয়া থেকে গাছগুলো রক্ষা পায় এবং সারাবছর গাছ থেকে মরিচের ফলন পাওয়ায় তাকে বাজার থেকে কোন মরিচ কিনে খেতে হয়না। গ্রামের এবং পাশ্ববর্তী গ্রামের অনেকেই তার কাছ থেকে সবুজ ও কালো উব্দা মরিচের বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে নিজ নিজ বসতবাড়ির আঙিনায় চাষ করেছে। এ বিষয়ে নাহাজং বলেন, ‘আমার দেখাদেখি আমাকে অনুসরণ করে অন্য কৃষকরাও যে, বস্তা পদ্ধতিতে সবজি ও মরিচের চারা রোপণ করছে সেটাই আমার বড় পাওয়া। গত বছর তিনটি জাতের মরিচ বস্তা পদ্ধতিতে চাষ করে সারাবছর মরিচ খেয়ে এবং প্রায় ৫০ জনকে মরিচের বীজ দিয়ে প্রায় এক কেজি মরিচ শুকিয়ে রেখেছি। চলতি বছরও বস্তায় মরিচের চাষ করেছি।’
নাহাজং আরও বলেন, ‘বারসিক সবসময় জনগণকে সঠিক পথ দেখায় ও সঠিক পথে পরিচালনা করে। বারসিক’র দেখানো পথে হেটেই আমি আজ স্বনির্ভরশীল। আমার কোন জমি এখন পতিত থাকেনা। আমি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করি এবং অন্যদেরও পরামর্শ দেই। বারসিক বাল্য বিয়ে ও যৌতুক প্রতিরোধসহ বিভিন্ন সামাজিক অনাচারে বিরুদ্ধে সকলকে সকলকে সচেতন করে। কলমাকান্দার আদিবাসী-বাঙালি সকলে এখন অনেক সচেতন। হাজং আদিবাসীদের মধ্যে বাল্য বিয়ে ও যৌতুকের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যৌতুক ছাড়া কোন মেয়ের কোন দিন বিয়ে হয়নি। বারসিক’র সচেতনতার ফলে আমি আমার নিজের মেয়ে ও গ্রামের আরেক হাজং মেয়েকে যৌতুক ছাড়া বিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। আমি বারসিক’র কাজের সাথে যুক্ত না হলে এসব কিছু জানতামনা এবং ঋণ করে বা জমি বিক্রি করে মেয়ের বাল্য বিয়ে দিয়ে দিতাম। আমার বর্তমান জানা বোঝা ও স্বচ্ছলতার জন্য বারসিক’র প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’
বারসিক মূলত কোন কিছু শেখায় না, বারসিক সেটাই শেখায় বা দেখায়, যেটা সাধারণ কৃষক বা সাধারণ জনগোষ্ঠী নিজেরা উদ্ভাবন করেছে এবং বংশ পরম্পরায় সেটা চর্চা করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে বেশ লাভবান হচ্ছে। পারিবারিকভাবে স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছে। বারসিক আগ্রহী কৃষক বা জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে এবং তাদের চাহিদা নিরূপণের পর তাদের জন্য কার্যকরী বিষয়টি চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আয়োজন করে উদ্ভাবক বা চর্চাকারীদের সাথে অভিজ্ঞতা সহভাগিতার ব্যবস্থা করে। নাহাজং হাজং তাদেরই একজন, যিনি সেই সফরের দেখা ও শোনা অভিজ্ঞতা বাস্তবে প্রয়োগ করে পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছে এবং এলাকার অনেক কৃষক ও আদিবাসী পিতা-মাতাকে আলোর পথ দেখাচ্ছেন।

happy wheels 2

Comments