বিপন্ন পাখি : সুনন্দ বাবুই

::দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূল অঞ্চল::

‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়েঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই’ এই কবিতাটি আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। জীবন ও নিসর্গের কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী কবিতায় এভাবেই আবহমান বাংলায় সুনন্দ পাখি বাবুই পরিচিত হয়ে আছে। তবে গ্রামবাংলায় এখন আর আগের মতো বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা চোখে পড়ে না। সময়ের বিবর্তনে ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আজ প্রাণবৈচিত্র্য থেকে বাবুই পাখি আমরা হারাতে বসেছি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পী, স¤প্রীতি এবং সামাজিক বন্ধনের কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা।

বাবুই আবহমান বাংলার শোভন পাখি। দলবেধে বাসা বাঁধে তালগাছের পাতায়। দৃষ্টিনন্দন বুননে সে বাবুই পাখির বাসা সুইচ্চ তালগাছ আরও নয়নাভিরাম করে তোলে। বাবুইয়ের মত এমন সুন্দর, নিপুণ কারিগরি বুননে দুষ্টিনন্দন বাসা আর কোন পাখি বুনতে পারেনা। আর মানুষের পক্ষেও অমন সুন্দর বাসা তৈরি সম্ভব নয়। তাই বাবুই পাখির শিল্পিত বাসা নিসর্গকে মনোরম করে তোলে। তবে গ্রামবাংলার পল্লী অঞ্চলে আগের মতো বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা এখন আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির দিকে বাবুই পাখি। তালগাছেই বাবুই পাখির বাসা নিরাপদ। সে তালগাছও উজাড় হচ্ছে দিনে দিনে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রতিকূলতার কারণে বাবুই পাখি ক্রমশ বিপন্নতার দিকে। বাবুই পাখির বাসা আজ স্মৃতির অন্তরালের পথে।

বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়ে বাতাসে টিকে থাকে তাদের বাসা। খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ ও কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করত বাবুই পাখিরা। একান্নবর্তী পরিবারের মত এক গাছে দলবদ্ধ বাসা বুনে এদের বাস। বাবুই পাখি একাধারে শিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনেরও প্রতিচ্ছবি। বাবুই পাখির শক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কঠিন।

এরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায় পছন্দের সঙ্গী খুঁজতে। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য কত কিছুই না করে। পুরুষ বাবুই নিজেকে আকর্ষণ করার জন্য খালবিল ও ডোবায় গোসল সেরে ফুর্তিতে নেচে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। এরপর উঁচু তালগাছের পাতার ডগায় বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই খুবই শিল্পসম্মতভাবে নিপুণ বাসা তৈরি করে।

পুরুষ বাবুই পাখি কেবল বাসা তৈরি করে। স্ত্রী বাবুই ডিম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষ বাবুই খুঁজতে থাকে আরেক সঙ্গীকে। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহের পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায়। বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম হলো পাকা ধানের মৌসুম। স্ত্রী বাবুই দুধ ধান সংগ্রহ করে এনে বাচ্চাদের আহার জোগায়।

আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগেও গ্রামগঞ্জের তাল, নারিকেল ও সুপারি গাছে ব্যাপকভাবে বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়ত। বাবুই পাখির এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক যোগাত এবং সাবলম্বী হতে উৎসাহিত করত।

বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখির বাসা দেখা যায়। বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্য এরা জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে। সকাল হলেই আবার তাদের ছেড়ে দেয়। প্রজনন সময় ছাড়া অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী পাখির গায়ে কালো কালো দাগসহ পিঠ হয় তামাটে বর্ণের। নিচের দিকে কোন দাগ থাকে না। ঠোঁট পুরো মোছাকার, লেজ চৌকা। তবে প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখির রঙ হয় গাঢ় বাদামি। বুকের উপরের দিকটা হয় ফ্যাকাশে। অন্যসময় পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই পাখির চাঁদি পিঠের পালকের মতোই বাদামি। বুকের কালো ডোরা ততটা স্পষ্ট নয়। প্রকট ভ্রƒরেখা কানের পেছনে একটি ফোঁটা থাকে। বাবুই পাখি সাধারণত তাল, খেঁজুর, নারিকেল ও সুপারি গাছে বাসা বাঁধে। তবে পথের ধারে উচ্চ তালগাছের পাতায় বাবুই পাখির বাসার দেখা মেলে বেশি।

ধান, চাল, গম ও পোকা-মাকড় প্রভৃতি তাদের প্রধান খাবার। বর্তমানে যেমন তাল জাতীয় গাছ হারিয়ে যাচ্ছে তেমন হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখিও।

happy wheels 2

Comments