উষ্ণতা ঘিরে দরবার চলছে প্যারিসে

:: লা বুর্জ, প্যারিস, ফ্রান্স থেকে পাভেল পার্থ

SAM_7514এক
ভোর না হতেই প্যারিসের রাস্তাগুলোয় মানুষের ভিড়। সবাই ছুটছে। পায়ে, বাসে, মেট্রো রেলে। গার্ড দ্য নর্ড, শাটেলেট, লুসেমবার্গ, মেরি দ্য লিলাস কি লা বুর্জ। একটার পর একটা স্টেশন। নামছে ওঠছে মানুষ। পা থেকে মাথা ঢাকছে সবাই। কেউ কম, কেউ বেশি। গরম বা শীতের ঝাপটানি সবার কাছে সমান নয়। কেউ সয়, কেউ সয় না। উষ্ণতার এই খেলা দুনিয়ার একেক প্রান্তে এককরকম। মানুষ দীর্ঘদিন এই খেলার সাথী হলেও উষ্ণতার এই ছন্দময় খেলা নাকি বদলে যাচ্ছে। তাল হারিয়ে ফেলছে। আর বদলে যাওয়া এই উষ্ণতা কতটুকু সইতে পারবে দুনিয়া এই নিয়ে অস্থির এক সময়। শুরু হয়েছে উষ্ণতা ঘিরে বৈশ্বিক দরবার। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ২১তম আসরটি এবার বসেছে ফ্রান্সের প্যারিসের লা বুর্জে। হাজির হয়েছে ১৫১ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। গত মাসে প্যারিসে নিদারুন সহিংসতার পর চারদিকে নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে। কপ-২১ নামে পরিচিত এই সম্মেলনে অংশ নেয়া সকলেই শীতের প্যারিসে নিজেদের শরীর উষ্ণ রাখতে গায়ে জড়িয়েছেন নানা ধরণের গরম কাপড়। কিন্তু তাদের অধিকাংশই চান না, পৃথিবী নামের এই গ্রহটির শরীর উষ্ণ হয়ে ওঠুক। পুস্তকি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর শরীরজুড়ে পরতের পর পরতে কার্বনের চাদর জমা হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর শরীর গরম হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে তীব্র তাপে পুড়ে যাবে দুনিয়া, গলে যাবে বরফ। বাড়বে অস্থিরতা আর সহিংসতা। বিশ্বব্যাপী তাই প্রবল আওয়াজ ওঠেছে, কার্বনের চাদরগুলো সরিয়ে ফেলা দরকার। কীভাবে, কারা, কখন, কোথায় এই কার্বনের চাদর কতটুকু সরাবে না সরাবে না এই নিয়ে বাহাস চলছে লা বুর্জের উষ্ণ ঘরে। লা বুর্জের বাইরে তাকিয়ে আছে দুনিয়ার অনেক করুণ, সাহসী, উন্মত্ত, লড়াকু চোখ। ৩০ নভেম্বর সম্মেলনের উদ্বোধনী হয়েছে, শেষ হবে ১১ ডিসেম্বর। অনেকেই আশা করছে এবার একটি দারুণ জলবায়ু চুক্তি দেখবে বিশ্ব। কিন্তু উষ্ণতা ঘিরে দরবার চলছেই। একদিকে বাংলাদেশ, নেপাল, আফ্রিকার মতো গরিব স্বল্পোন্নত দেশ, আরেকদিকে দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সুইডেনের মতো ধনী দেশ। অপরদিকে ভারত, ব্রাজিল, চিন কি দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি। কে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ কমাবে তাই নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা উত্তেজনা, সাথে জুড়েছে বৈশ্বিক মন্দা ও নিরাপত্তার তর্কও।


SAM_7531দুই

জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহ যারা এই জলবায়ু সম্মেলনের পক্ষ রাষ্ট্র তারা নানা সময়ে কার্বন নিঃসরণের হার কমানোর কথা বলেছেন নানাভাবে। জাতীয় পর্যায়ে পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ তার আভ্যন্তরীণ কার্বণ নিঃসরণ হার কমানোর কথা ঘোষণা করেছিল আগের লিমা ও ডারবান সম্মেলনে। এবার রাষ্ট্রসমূহ কার্বন নিঃসরেন তাদের জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত প্রতিশ্রুত অবদান প্রতিবেদন (আইএনডিসি) জমা দিয়েছে জাতিসংঘ বরাবর। দুনিয়ার মোট কার্বন নিঃসরণের মাত্র ০.৩৫ ভাগ বছরে নির্গমন ঘটায় বাংলাদেশ। তারপরও বাংলাদেশ নিজ অর্থায়নে ৫ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় ১৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর সাহসী ঘোষণা দিয়েছে। ২ ডিসেম্বর লা বুর্জে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব কামালউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেন। কিন্তু বাংলাদেশসহ গরিব হিসেবে পরিচিত উন্নয়নকামী দেশগুলো আশংকায় আছে শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে? কার্বন নিঃসরণ কমানোর মাত্রা কার কেমন হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কত ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠবে বা নামবে? নেপাল থেকে সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন গণেশ বাহাদুর কারকী। দীর্ঘদিন ধরে নেপালের জনগোষ্ঠীভিত্তিক বনব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে ফেডারেশন অব দ্য কমিউনিটি ফরেষ্ট্রি নামের এক সংগঠনের প্রধান। সম্প্রতি নেপালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের রক্তাক্ত স্মৃতি টেনে জানালেন, এখনো নেপাল ওঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। ভূমিকম্পের নিদারুণ স্মৃতি অনেকের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ভয় তৈরি করছে। এই ভয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়। নেপালের এক বৃহৎ অংশজুড়ে দুনিয়ার দীর্ঘ পর্বত হিমালয়। বৈশ্বিক উষ্ণতার এই লাগামহীন বৃদ্ধি মানুষের ভেতর শংকা ও ভয়কে আরো বাড়িয়ে তুলছে। হিমালয়জুড়ে যে বরফভূমি তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায় তবে কী হবে? মানুষ, বনভূমি, দেশ কোথায় যাবে। দ্রুত আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসা জরুরি। শুধু এশিয়া নয়, দুনিয়াজুড়ে সকলেই বলছেন এই উষ্ণতার লাগাম টেনে ধরবার কথা। কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর লিমা থেকে এসেছেন আলোকচিত্রী কার্লোস গার্সিয়া গ্র্যান্থন। প্রামাণ্যধারার কাজ করা এই আলোকচিত্রী বর্তমানে কাজ করছেন ‘ফটোহলিকাতে’। কার্লোস জানালেন, লিমার তাপমাত্রা খুব কম বা বেশি নয়। হয়তো এখনও তাপমাত্রা পরিবর্তনের এই প্রভাব আমরা বুঝতে পারছি না কিন্তু উষ্ণতা বৃদ্ধির হার অবশ্যই দুই ডিগ্রির নিচে নামিয়ে রাখা দরকার। তা না হলে পৃথিবীজুড়ে এই সমস্যা বাড়বে।

SAM_7576তিন
উষ্ণতা বেড়ে এক দুঃসহ যন্ত্রণার দিকে হাঁটছে পৃথিবী। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত আর খরার প্রাবল্য বাড়ছে। আফ্রিকার টোগো থেকে এসেছেন কৃষিবিজ্ঞানী কোমি টমইয়েবা। বয়স ষাট পেরিয়েছে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় চোখের সামনে আবহাওয়ার বদলে যাওয়া টের পেয়েছেন। ছোট্ট দেশ টোগোর বাৎসরিক ঋতুবৈচিত্র্য দক্ষিণ ও উত্তরে ভিন্ন। দক্ষিণে বছরে বর্ষাকাল আসে দুইবার। মে থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর। উত্তরে একবারই বর্ষাকাল, মে থেকে অক্টোবর। ছয় মাস। কিন্তু বর্ষাঋতুর এই বৈচিত্র্য বদলে যাচ্ছে। ২০০০ সন থেকে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। বর্ষাকাল আসতে দেরি হচ্ছে। টোগোর গ্রামীণ কৃষি সরাসরি বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। এছাড়া টোগোতে আর কোনো সেচব্যবস্থা নেই। ভূট্টা, যব ও শিম টোগোর প্রধান কৃষিফসল। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত খরার প্রাবল্য বাড়িয়ে তুলছে। অনেক জমি অনাবাদী হয়ে পড়ছে। গ্রাম থেকে কৃষকেরা শহরে এসে নানা ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়াচ্ছে। এই অবস্থার অবসানে এখন দরকার কম পরিমাণে সেচ লাগে স্বল্পমেয়াদী ফসলের জাত। কিন্তু টোগোতে এমন জাত খুব কম। টোগোর এই আবহাওয়া বদলাতে থাকলে জীবন বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। উচ্চফলনশীল বা হাইব্রিড যাই হোক না কেন কৃষকের দরকার পরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকবার জন্য নতুন জাত। কোমি টমইয়েবার সাথে একেবারেই অমিল ড. পিটার দরওয়ার্ডের মতে। ড. পিটার যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এগ্রিকালচার, পলিসি এন্ড ডেভলপমেন্ট’ এর অধ্যাপক। দীর্ঘ সাত বছর কাজ করেছেন আফ্রিকার ঘানায়। ১৯৯৪ থেকে ২০০১ পর্যন্ত। অংশগ্রহণমূলক জাত নির্বাচন আর সংকরায়ন বিষয়ে কৃষকদের সহায়তা দিয়েছেন। ড. পিটার মনে করেন, স্থানীয় জাতের মতো যেকোনো বিপর্যয় মোকাবেলা শক্তি আর কোথাও নাই। তাছাড়া এইসব জাতের সাথে জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে। জোর করে এটি বদলে ফেলা যায় না। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ভেতরেও স্থানীয় জাতের সম্ভাবনাকে খুঁজে দেখা জরুরি। হাইব্রিড জাতগুলো হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো হতে পারে, কিন্তু সব সমস্যার সমাধান সেখানে নেই। তাছাড়া হাইব্রিড ফসলের বীজ কৃষক সংরক্ষণ করতে পারে না। জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে যদি স্থানীয় ও ঐতিহ্যগত ফসলের জাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি সংস্কৃতির উপরও প্রভাব তৈরি করবে বলে জানান ইউনেস্কোতে কর্মরত পলিন ভ্যালেট্টি। ইউনেস্কোর গ্রীণ সিটিজেন কর্মসূচির হয়ে তিনি ফ্রান্সে কাজ করছেন। পলিন জানান, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদগুলো দূর করা জরুরি। কারণ এটি আমাদের জীবন ও সংষ্কৃতির উপর সমস্যা তৈরি করবে। এই পরিবর্তনের ফলে আমাদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও সম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে। ইউনেস্কো এসব সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর।

চার
বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা আদিবাসী বিনোতাময় ধামাই কাজ করছেন এআইপিপি নামের এক আদিবাসী বিষয়ক সংগঠনে। উচ্চতর শিক্ষার কাজে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় আছেন। ক্যানবেরা থেকে তিনিও এসেছেন জলবায়ু সম্মেলনে। তুলে ধরছেন আদিবাসীদের দাবি। এই খাগড়াছড়িরই একজন জুমিয়া ফকুমার ত্রিপুরা ‘ফকুমার’ নামে এক জুম ধানের উদ্ভব করেছিলেন। বৃষ্টিসেচ ছাড়াই হয় ধান। সুনামগঞ্জের ধরমপাশার কৃষক নুয়াজ আলী ফকির যেমন উদ্ভাবন করেছেন গভীর পানির ধান ‘চুরাক’। বাংলাদেশের মত এরকমই একজন আফ্রিকান কৃষকের কথা জানালেন যুক্তরাজ্যের ড. পিটার দরওয়ার্ড। ঘানার সেই কৃষকের নাম আগায়া আমুয়া। খরাসহিষ্ণু, খেতে ভালো এক ‘উন্নত’ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছিলেন। তার নামেই ধানটির নাম রাখে মানুষ। ঠিক যেমন বাংলাদেশের ঝিনাইদহের হরিপদ কপালির হরিধান। হরিধানের মত ঘানাজুড়ে সরকার বা কোনো এজেন্সি ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ে সেই ধান। ঘানা থেকে বাংলাদেশ, পেরু থেকে নেপাল, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফ্রান্স জলবায়ু সম্মেলনে জড়ো হওয়া মানুষের এমনি জমা আছে কত কত জেগে ওঠার গল্প। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ কী এসব গল্পের সাথী হবে? নাকি শুধু উষ্ণতার দরবারকে আরো জটিল করে প্রশস্ত করবে কর্পোরেট বাণিজ্যের পথ?

happy wheels 2

Comments