দেশী বীজ রক্ষা করি, কৃষির ‘ভিত’ মজবুত করি
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষকদের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত দেশীয় বৈচিত্র্যময় বীজের ব্যাংক। এর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইউসুফ আলী মোল্লা। তিনি তাঁর কাজের জন্য জাতীয় পরিবেশ পদক-২০১৩ পেয়েছিলেন। তিনি দেশী জাতের ধান বীজ সহ বিভিন্ন সবজি বীজ রক্ষায় অগ্রনী ভুমিকা পালন করেন। তাঁর সংগ্রহে আছে ৩০০টি জাতের ধান বীজ ২৫ জাতের বিভিন্ন দেশীয় সবজি বীজ ও ১৫ জাতের রবিশস্যর বীজ। তিনি প্রতি বছর ৭০-১০০জাতের ধান নিজে চাষ করার মাধ্যমে ধানগুলো হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার কাজ করেছেন।
তিনি ২০১৫ সালে তানোর উপজেলা এবং রাজশাহীর জেলার বিভিন্ন কৃষক নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক এবং সেদিনই নানা জাতের দেশিয় ধানের চাল দিয়ে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। সেখানে অন্য গ্রামের ও এলাকায় চাষ হওয়া আমন মোসুমের ধান জাত গুলো নিয়ে এসে কৃষকরা বীজ ব্যাংকে বীজ জমা করেন এবং নতুন জাতের ধান নিয়ে গিয়ে পুনরায় চাষ করেন। কারণ বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংকের নিময় হলো এক কেজি বীজ নিয়ে চাষ করলে মৌসুম শেষে ২ কেজি বীজ ফেরত দিতে হয় ব্যাংকে। এতে করে বীজ ব্যাংক বীজে সমৃদ্ধ হয় কৃষকরা চাহিদা অনুসারে বীজ নিতে পারে।
ইউসুফ মোল্লার অবর্তমান এ কাজে হাল ধরেছেন তার ছোট ভাই মোঃ জাইদুন রহমান। তাকে সহযোগিতা করছেন বীজ ব্যাংকের পরিচালনা কমিটির অন্য সদস্যরা। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংকের ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসবের আয়োজন করেন দুবইল গ্রামের কৃষকরা। সাথে এবার বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকের ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনেরও সিদ্ধান্ত হয়। অনুষ্ঠানে তানোর পবা, গোদাগাড়ি,নাচোল ও পাশের নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে কৃষকরা নবান্ন উৎসবে অংশগ্রহন করেন। উৎসব মূখর পরিবেশে গতরাত থেকে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে চলতে থাকে বৈচিত্র্যমও পিঠা পুলি বানানোর কাজ। এ কাজে সহযোগিতা করেন গ্রামের নারীরা।
সকাল থেকে কৃষকরা বীজ নিয়ে এসে উৎসবে অংশগ্রহণ করতে থাকে। এবারই প্রথম নবান্ন উৎসবে অংশগ্রহ করেছিলেন তানোর উপজেলার বিল্লি গ্রামের শাহানাজ বেগম (৪১)। তিনি লোক মুখে শুনেছিলেন দুবইল গ্রামে নবান্ন উৎসবের কথা। তাই সব সময় খোঁজ খবর নিয়ে এবারে উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য এবার তিনি রাঁধানীপাগল ও কালোজিরা ধানের বীজ নিয়ে জমিতে চাষ করবেন। এমন অনেক কৃষক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
নাচোল উপজেলার ঝিলিমপুর গ্রাম থেকে এসেছিলেন মোঃ মাহাবুর রহমান। তিনি বলেন, “আমার অনেক জমি পানির অভাবে পড়ে থাকে। তাই আমি এসেছি বীজ ব্যাংক থেকে খরা সহনশীল ধান জাত নিতে। এখানে এসে অনেক কৃষকদের সাথে পরিচিত হলাম এবং তাদের কাজ সম্পর্কে জানতে পারলাম এবং খরা সহনশীল ঝিঙ্গাশাইল জাতের বীজ নিয়ে যাচ্ছি চাষ করার জন্য।’
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ৫টি উপজেলার ১৮ গ্রামের ২৫০ জন কৃষক ও কৃষাণী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তানোর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পংকজ চন্দ্র দেবনাথ, বিশেষ অতিথী উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মদ ও নদী ও পরিবেশ গবেষক মোঃ মাহাবুব সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন মোঃ জাইদুর রহমান।
কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক স্থানীয় জাতের ধান সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। যদিও এ কাজ অনেক কঠিন এবং ব্যায়বহুল। তবে এ বীজগুলো আমাদের দেশের সম্পদ। আমরা এ কাজে সব সময় সহযোগিতা করব। কারণ বরেন্দ্র অঞ্চল উপযোগি অনেক ধানজাত এ ব্যাংকে সংরক্ষিত আছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক চমৎকার কাজ ও উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বিশেষ করে কৃষকরা এখান থেকে বীজ নিয়ে চাষ করে আবার বীজ ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন এটা অনেক ভালো একটা দিক। এতে করে দেশী ধানের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তিনি বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকের উন্নয়নে সকল ধরনের সহযোগিতা করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। নদী ও পরিবেশ গবেষক মোঃ মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘ইউসুফ মোল্লা দেশী বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য সারা দেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। তার এ সংগ্রহশালা যদি সরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে এ বীজ ব্যাংক অনেক সমৃদ্ধ হবে এবং কৃষকরা এখান থেকে উপকৃত হতেই থাকবে। রক্ষা পাবে দেশী জাতের শত শত বীজ।’
কৃষক নূর মোহাম্মদ নবান্ন উৎসব ও বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক নিয়ে স্ব-রচিত কবিতা পাঠ করে বলেন, “প্রতিটি ধানের সাথে আমাদের সংষ্কৃতির সম্পর্ক আছে। যেমন ধানের সাথে আছে ঐতিহ্য নবান্ন উৎসবের সম্পর্ক। এ দেশি ধান না থাকলে অনেক সংষ্কৃতিও হারিয়ে যাবে। তাই আমাদের এ কাজের মাধ্যমে শুধু দেশি ধান নয় রক্ষা পাচ্ছে আমাদের সংষ্কৃতিও।’