বৈচিত্র্যময় খাবার হারিয়ে যাওয়ায় আমরা আরও প্রান্তিক হচ্ছি

বৈচিত্র্যময় খাবার হারিয়ে যাওয়ায় আমরা আরও প্রান্তিক হচ্ছি

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
গীতালী, আলতী ও সুখরানী হাসদা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। দিনের কাজ শেষ করে রাস্তার পাশের একটি প্রায় শুকিয়ে যাওয়া খাস জলাশয়ে নেমেছেন ছোট ছোট মাছ আর শামুক খুঁজতে। মাছ তেমন নেই বলে ছোট ছোট শামুকই ভরসা। শামুকই এখন প্রধান হয়ে উঠেছে প্রান্তিক এই সাঁওতাল নারী পরিবারগুলোর আমিষের চাহিদা পূরণের প্রধান খাদ্য। তারা প্রথমে লজ্জায় স্বীকার করতে চাচ্ছিলো না এগুলো দিয়ে তারা কি করবেন। জানতে চাওয়া হলো বাড়িতে হাঁস মুরগি আছে কি না। যখন এই এই প্রশ্নের না জবাব এলা তখন বোঝা গেলো এগুলো দিয়ে রাতের খাবার তৈরি হবে। পরে তারা স্বীকার করলেন এগুলো খাওয়া হয় তবে আর তেমন পাওয়া যায় না। কারণ তেমন বৃষ্টি হয় না বলে জলাশয়গুলো তারাতারি শুকিয়ে যায় বলে এগুলো কমে যাচ্ছে।


রাজশাহীর তানোর উপজেলার মোহর গ্রামে গীতালী হাসদা (৪৫), আলতী হাসদা(৪৮) ও সুখরানী হাসদা (৪৬)দের বসবাস। মূল পেশা হিসেবে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন সারাবছর। কখনও আলু লাগানো, আলু তোলা, ধান লাগানো বা ধান কাটার কাজই করেন। কাজ শেষে বাড়ী যাওয়ার পথে জলাশয়ে নেমে রাতের খাবারের জন্য ছোট মাছ বা শামুক সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কোনদিন মেলে কোন দিন মেলে না। গীতালী হাসদা বলছিলেন, ‘আগে জলাশয়গুলোতে অনেক শামুক পাওয়া যেত এখন পানি থাকে না বলে শামুক অনেক কমে গেছে।


মাছ বা পোল্ট্রি মুরগির দাম বেশি এগুলো তো আমার তেমন কিনতে পারি না। তাই শামুক আমাদের মাংসের চাহিদা মেটায় এ কথা বলেন আলতী হাঁসদা কয়েকটি শামুক ধুয়ে নিয়ে কোমরের শাড়ীর ভাজে গুজে রাখলেন। সুখরানী হাসদা বলছিলেন, ‘ধানের জমিতে দানাদার বিষ ব্যবহার করার কারণে শামুকের ডিম নষ্ট হয়ে যায় আবার পানিও আগের মতো সারাবছর থাকে না বলে শামুক আর নেই বললেই চলে। পরিবারের ৪জন সদস্য নিয়ে একবেলা শামুক সংগ্রহ করতে ২ বা ৩টি জলাশয়ে ঘুরতে হয়।


জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত অনেক কম। এই কারণে এলাকার জলাশয় ও পুকুরগুলো তারাতারি শুকিয়ে যায়। এই কারণে জলাশয়গুলো জন্মানো অনেক খাদ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে খাস ও পতিত পুকুরগুলো লিজের আওতায় চলে গিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ। যেখানে রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে পুকুরগুলোতে মাছ ছাড়া অন্য কোন প্রাণি ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব রাখা হয় না। এই পুকুর ও জলাশয়গুলো আলতী হাঁসদাদের মতো হাজারো আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের শামুক ঝিনুক সংগ্রহের বড় একটি অংশ ছিলো, পূরণ করত তাঁদের পরিবারের আমিষের চাহিদা।


অন্যদিকে এই এলাকার জমিগুলোতে সারাবছর ফসল হয় বলে সারাবছরই জমিতে কোন না কোন কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। সব থেকে ক্ষতি হয় ধান ফসলে দানাদার কীটনাশক ব্যাবহারে। দানাদার কীটনাশক ব্যাবহারের ফলে এর বড় একটি অংশ পানির মাধ্যমে জলাশয়ে চলে গিয়ে সেখানকার প্রাণবৈচিত্র্য ধংসে বড় ভূমিকা পালন করে। আর এই কারণে সেখানে থাকা খাদ্য উদ্ভিদ বা প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে সুখরানী হাঁসদার মতো প্রান্তিক পরিবারের একমাত্র আমিষের উৎসও ধংস হয়।
দিন দিন এ সংকট আরো প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষগুলোর খাদ্য বৈচিত্র্য আরো বেশি সংকটে পড়ছে, বাড়ছে পুষ্টিহীনতাও যা আসলে তাঁদের ঠেলে দিচ্ছে আরো প্রান্তিকতার দিকে।

happy wheels 2

Comments