অভিনব ভাবনা, নতুন উদ্যোগ
তানোর, রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম শহিদ
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে, এখান থেকে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে। প্রকৃতির এই অসীম দান কখনও কখনও মানুষের জীবনে দুর্যোগের কারণ হয়ে ওঠে। তবে মানুষ তার অসীম বুদ্ধি, সাহস, ধৈর্য্য এবং সাহসিকতার সাথে সেই দূর্যোগ মোকাবেলা করে আসছেন।
“নদী ভাঙন এর কারণে আমাদের গবাদি পশু চরানোর মত জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে। দাদার আমল থেকে আমাদের পরিবার পুরোপুরি গরু পালনের উপর নির্ভরশীল ছিলো।” এমনটিই জানিয়েছেন শিবগঞ্জ উপজেলার তালপট্টি ও উজিরপুর গ্রামের সুমন (৩৮), তরিকুল (৪২), শফিকুল (৪৪), কালাম (৩৩), শরিফ (৪৫) ও রনি (২৬)। তারা বলেন,“ নিজেদের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় গরুকে সঙ্গী করে বেছে নিই এই যাযাবরের জীবন।” সাধারণত রাখাল সারাদিন গবাদি পশু মাঠে চরিয়ে সন্ধ্যায় গোয়াল ঘরে তোলে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে অন্যরকম। দশ বছর ধরে তারা পতিত জমিগুলোতে গরুর পাল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। খোলা মাঠের নিচেই থাকা খাওয়া এবং রাত্রি যাপন।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল ও প্রকাশনগর এলাকায় গরুর এই দলটি চোখে পড়ে। বরেন্দ্রর পতিত জমিতে গরু চরায় তারা। বর্তমানে তাদের গরুর সংখ্যা ৪১০টি। ১২০টি গাভী থেকে প্রতিদিন তারা প্রায় ২৫০ লিটার দুধ পান। শুধু দুধ বিক্রি করেই তারা মাসে ৩ লাখ টাকা আয় করেন। প্রজননের জন্য রয়েছে ৬ টি ষাঁড় গরু। প্রতিটি গরু ৩০ হাজার টাকা করে নূন্যতম দাম ধরলে তাদের সম্পদের পরিমাণ এখন এক কোটি ২০ লাখ টাকা। ছয় জন মানুষের আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার গল্প এটি। গরুগুলো তাদের কাছে সন্তানের মতো।
তাদের মধ্যে থেকে শফিক জানান, নিজের কোনো জায়গা নেই। বাড়িতে যেটুকু জায়গা আছে তাতে বড় পরিসরে গরু পালন করাও সম্ভব নয়। আবার যদি পালন করাও যায় তাহলে খরচা অনেক বেশি। তাই মাঠের ঘাস ও পুকুরের পানি খাইয়েই দশ বছর থেকে তারা গরুগুলো পালন করে আসছেন তারা। বলতে গেলে সেরকম কোনো খরচই লাগে না। তাদের দুধ বিক্রির নির্দিষ্ট গ্রাহক আছে। তারা যেসব এলাকায় অবস্থান করেন মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে দুধ ক্রেতারা সেখানেই এসে দুধ নিয়ে যায়। দুধ থেকে যে আয় হয় তাতে প্রতিজনের গড়ে মাসে ৪০ থেকে ৪৩ হাজার টাকা আয় হয়। শরিফ বলেন, “গরুর পাল থেকে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০টি বাছুর জন্ম নেয়।”
তারা জানান, তাদের গরুর পালে ১২০টি গাভীসহ বাছুর আছে। আরো ৭০ থেকে ৮০টি গাভী বাছুর হওয়ার অপেক্ষায় আছে। রাতে গাভী ও বাছুরকে আলাদা রাখা হয়। দুধ সংগ্রহ করার সময় ৬টি করে গাভী দুধ সংগ্রহ করার জন্য লাইনে আনা হচ্ছে। বাছুরদের তারা নাম রেখেছেন জয়নাল, মৌসুমী, মমতাজ, পক্ষিরাজ, টগরী, সুবেদার, পিরিতলাল, লাল বিহার, প্রেমলাল, চিত্রা, পাড়াশিং, মালতী, পটলা, গিরিবাজ, লালশিং ইত্যাদি। নাম ধরে ডাকলে পালের মধ্যে যেখানেই থাকুক গরু এসে হাজির হয়। এক মাস ধরে তারা গরুর পাল নিয়ে অবস্থান করছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল ও প্রকাশনগর এলাকায়। সেখানে পতিত মাঠে তারা গরুর পাল ছেড়ে রেখেছেন। প্রতিটি গরুই তাদের চেনা। তাদের রান্নার কাজ তারা নিজেরাই করেন।
গরু চরানোর ক্ষেত্রে তাদের কাছে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে সুমন জানান, প্রথমে অনেক রকমের প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এলাকায় কিছু মানুষ আমাদের গরু চরাতে বাধা দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেছেন “এত দুর থেকে কেন গরু চরাতে এসেছেন অন্যের ফসল খাওয়ানোর জন্য?” এ ধরনের নানারকম কথা আমাদের হর হামেশাই শুনতে হয়েছে। গরুর খাবার টাকা দিয়ে কিনে খাওয়ালে আমাদের লাভ কম থাকে। তাই আমরা গরুর পাল নিয়ে এখন বিভিন্ন এলাকায় চরে বেড়াচ্ছি। এ প্রসঙ্গে, পরিবেশ পদকপ্রপ্ত কৃষক ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, “গরুর দলগুলো আমাদের জন্য অতিথি ও প্রকৃতির আর্শীবাদস্বরূপ। কারণ এত গুলো গরুর গোবর পড়ে আমাদের মাঠের উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে ছয়টি পরিবারের জীবন জীবিকার দায় দায়িত্ব বহন করছে এই গবাদিপশুগুলোই। তাই এই পশু পালকদের বাধা না দিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করে আমাদের আরো বেশি করে গবাদি পশুপালন করা উচিত।