নদী: ব্রিজের বেড়ি পড়া নির্দোষ কয়েদি

নেত্রকোনা থেকে রনি খান

কলকাতার খ্যাতিমান সাহিত্যিক দেবেশ রায় তাঁর কয়েকটি উপন্যাসের সংকলন ‘শরীরের সর্বস্বতা’র ভূমিকায় একটি চমৎকার কথা বলেছেন। সুদীর্ঘ উৎসর্গপত্রের শুরুতেই তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো-আমরা এখন উদ্দেশ্য সর্বস্ব। আমরা যখন কোথাও যাত্রা করি তখন যাত্রার একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে, যে পথে আমরা নামি সে পথ খুবই সংকীর্ণ, খুবই ছোট। অর্থ্যাৎ আমরা কোথাও না কোথাও যাবার জন্য যাত্রা করি। ফলে যাত্রার আনন্দের চেয়ে যাত্রার সমাপ্তিটিই আমাদের কাছে মূখ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন যাত্রা ছিলো আমাদের কাছে চরম আনন্দের। জলের উপর নৌকা ভাসিয়ে আমরা যাত্রা করতাম। তখন আমাদের জীবন ছিলো জলনির্ভর। জলের সাথে আমাদের এই নিবিড় সম্পর্কই আমাদেরকে জলের মতো বিশাল করে তুলেছিলো। কিন্তু জলের উপর ব্রিজ তৈরি করে আমরা শুধু আমাদের যাত্রাপথটিকেই ছোট করে আনিনি, সেই সাথে ছোট করে এনেছি আমাদের সম্পর্কগুলোকেও, আমাদের আন্তরিকতাগুলোকেও। একথার গভীর সত্যতাটুকো কোথায় সে আর বুঝিয়ে বলতে হয় না। আজ ‘শো-পিস’ সর্বস্ব মানুষই তার প্রমাণ।
‘গোরা’ উপন্যাসে রবি ঠাকুর একটি জায়গায় লিখেছেন ‘তখন কলিIMG_20140928_105934কাতার গঙ্গা ও গঙ্গার ধার বণিক-সভ্যতার লাভলোলুপ কুশ্রীতায় জলে-স্থলে আক্রান্ত হইয়া তীরে রেলের লাইন ও নীরে ব্রিজের বেড়ি পড়ে নাই।’ মহান বাঙালি প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ সেই বৃটিশ বণিক সভ্যতার রমরমা যুগেই এমন কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন। আজকে যখন নদী শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে, আবার বর্ষায় তৈরি করছে দুকূল প্লাবী বন্যার, তখন হায় হায় রব উঠছে। কিন্তু রাষ্ট্র সেইসব ঘোর সত্যকে অস্বীকার করে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে নামছে উন্নয়নে। জনগণেরই ঘাম-রক্তে অর্জিত অর্থ ফলত ব্যয় হচ্ছে জনবিদ্বেষী কর্মকান্ডে।

নদীর নাব্যতা হারানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ আছে। সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণা, মামলা-মোকাদ্দমা চলছে। ভূমিদস্যু অথবা নদীদস্যু, কলকারখানা অথবা পাহাড়ি বালু অনেক কিছুই দায়ি এর জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী বাংলাদেশের শিরার মতো, হার্টের মতো, যে হার্ট ‘ব্লক’ হতে চলেছে। রাষ্ট্রের যেখানে উচিত রাষ্ট্রকে বাঁচানো সেখানে ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’র বদলে রাষ্ট্র দ্বিগুণ উৎসাহে ‘হার্ট ব্লক’ এর দায়িত্ব নিয়েছে। হেলাল হাফিজ শুধু নয় নেত্রকোনার অজ¯্র মানুষের প্রিয় মগড়া নদীর উপরই ‘ব্রিজের বেড়ি’ পড়িয়ে আটকে ফেলার ‘বণিক’ ষড়যন্ত্র তারই প্রমাণ। নেত্রকোনা শহর এবং আশপাশে অন্তত ৮টি ব্রিজ রয়েছে যেগুলো এতোই অনুচ্চ যে তার নিচ দিয়ে বর্ষায় মাঝারি নৌযান চলাচলও অসম্ভব।
IMG_20140927_171417
সম্প্রতি শহরের প্রধান মোক্তারপাড়া সেতু পূনঃনির্মাণের ক্ষেত্রেও নাকি পূর্বতন সেতু থেকে উচ্চতা কমিয়ে সেতু নির্মাণের ডিজাইন করা হয়েছে। আশার কথা হচ্ছে নেত্রকোনার বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে ইতিমধ্যেই কথা উঠেছে এবং আশা করা হচ্ছে কর্তৃপক্ষ এই হঠকারি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন। আর যদি না আসেন তা হলে আমরা যা হারিয়েছি তা তো ফিরে পাবোই না, যা আছে তাও হয়তো হারাবো শেষ পর্যন্ত।

আমরাও আশা করছি জনবিদ্বেষী উন্নয়ন কর্মকান্ড থেকে বেরিয়ে এসে রসের সাথে কর্মের সমন্বয়ে, রাষ্ট্রের সাথে সাহিত্যের সমন্বয়ে, তত্ত্ব আর প্রয়োগের সমন্বয়ে, বুদ্ধি আর বিবেকের সমন্বয়ে তৈরি করবে মানবিক স্বদেশ।

happy wheels 2

Comments