নেত্রকোনার নগুয়া গ্রামের উন্নয়নে কৃষক সংগঠনের নানা উদ্যোগ

নেত্রকোনা থেকে রুখসামান রুমি

ভূমিকা
বৈশ্বি মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে গোটা বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশও বিগত আঠারো মাস যাবৎ বন্দীজীবন অতিবাহিত করেছি। করোনাকালীন সময়ে আমাদের অনেকের জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হলেও কৃষিকাজ থেমে থাকেনি। গ্রামবাংলার দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর খাদ্য সুনিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন করে যাচ্ছেন আমাদের কৃষকগণ। তাদের কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় আমাদের দেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। গ্রামের উন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করার জন্য কৃষকরা গড়ে তুলেছে আশুজিয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটি গঠেনের পর থেকে বিগত কয়েক বছর ধরে এলাকার উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে আসছে। নিম্নে আশুজিয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠনের করোনাকালীন সময়ে গ্রামের সার্বিক উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রমগুলো ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হল:

বীজের সমস্যা দূরীকরণে গ্রামীণ বীজঘর স্থাপন
আশুজিয়া ও নগুয়া গ্রামের কৃষকরা সারাবছর অবিরামভাবে বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন করে চলেছেন। কিন্তু তাদের অন্যতম সমস্যা হল মানসম্মত বীজের অভাব। মানসম্মত সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের বীজের সমস্যা লাঘবে সংগঠনের উদ্যোগে নগুয়া গ্রামে গড়ে তুলেছেন একটি গ্রামীণ বীজঘর। নগুয়া, আশুজিয়া, সিংহেরগাও, বলাইশিমুল, বান্দলাল, ভুগিয়া, রামপুর ও রেইন্ট্রিতলাসসহ ১২ গ্রামের মানুষ করোনাকালীন সময়ে এ বীজঘর থেকে ধান ও সবজির নিয়ে জমিতে চাষ করেছেন। সংকটে সকল কিছু বন্ধ থাকায় ঘরের বাইরে যেতে না পারায় গ্রামের কৃষকরা চলতি আমন মৌসুমে বীজঘর থেকে তিন জাতের ধানের বীজ (মালশিরা, চিনিশাইল ও সুবাশ) ৮ জন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করেছেন। এছাড়াও আসন্ন শীত মৌসুমে চাষের জন্য গ্রামের ৫০ জন কৃষক-কৃষাণী পাঁচ জাতের সবজি বীজ (লাউ, সীম, লালশাক) বীজঘর থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। বীজঘরের তত্ত¡াবধায়ক কৃষাণী রোকেয়া বেগম চলতি মৌসুমে বসতভিটায় ৮ জাতের শিম চাষ করেছেন। গ্রামীণ বীজঘর স্থাপনের ফলে কৃষকদের মানসম্মত বীজের সমস্যা অনেকট লাঘব হয়েছে।

নিম গ্রাম গড়ার উদ্যোগ
আশুজিয়া গ্রামটিকে নিম গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে আশুজিয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠনটি প্রতিবছর বৃক্ষ রোপণের মৌসুমে গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবারে এবং গ্রামের রাস্তার ধারে ও পতিত স্থানে নিমের চারা রোপণ করে চলেছেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সংকটেও সংগঠনটি নিমের চারা রোপণ করতে ভুলেনি। প্রতিবছর নিমের চারা রোপণের ধারাবাহিকতায় সাংগঠনিক উদ্যোগে গ্রামের বিভিন্ন বসতভিটা, পতিত জায়গা ও রাস্তার ধারে ১০০টি নিমের চারা রোপণ করা হয়েছে। এ নিয়ে বিগত তিন বছরে সংগঠনটি গ্রামে ৫০০টি নিমের চারা করেছে। তিন বছর পূর্বে গ্রামের রাস্তায় রোপণকৃত নিমের চারা বর্তমানে ৮-১০ ফুট লম্বা হয়েছে।

জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন
আশুজিয়া গ্রামের কৃষকরা পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আসছেন। নেত্রকোনা সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর কম্পোস্ট গ্রাম পরিদর্শন করে সংগঠনের সভাপতি কৃষক আবুল কালাম কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন ও বালাইনাশক তৈরির পদ্ধতি জেনে এসে নিজে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে ও জৈব বালাইনাশক তৈরি করে জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করছেন। কৃষক আবুল কালামের জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রম দেখে গ্রামের অন্য কৃষকরাও এতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। করোনাকালীন সংকটে গ্রামের দু’জন কৃষক (এখলাজ মিয়া, রাখাল চন্দ্র) আবুল কালামের নিকট থেকে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন কৌশল শিখে ও কেঁচো নিয়ে কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেছেন।

ফসলের হাসপাতাল চালুর মাধ্যমে কৃষি সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা
কৃষকরা প্রতি মৌসুমে যেসব ফসল চাষ করেন তার একটি বড় অংশ নষ্ট হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ফসলের রোগ-বালাইয়ের আক্রমণে। ফসলের এসব রোগ-বালাইয়ের কিছুটা কৃষকরা নিজেরা সমাধান করতে পারলেও অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারেন না। তবে গ্রামের বেশকিছু অভিজ্ঞ কৃষক রয়েছেন, যারা ফসলের অনেক রোগ-বালাইয়ের সমাধান জানেন। এসব অভিজ্ঞ কৃষকদের নিয়ে আশুজিয়া কৃষক সংগঠন কৃষির বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গ্রামে একটি ফসলের হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি ও অভিজ্ঞ কৃষক আবুল কালাম গ্রামের অভিজ্ঞ কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে বিগত কয়েক মাস যাবৎ মাসে দু’দিন করে ফসলের হাসপাতালে ধানসহ কৃষকদের চাষকৃত বিভিন্ন ফসলের রোগবালাই ও কৃষি সমস্যার সামাধানে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। যেসব সমস্যার সমাধান তাদের মধ্যে কারো জনা নেই, সে সব সমস্যা ফোনে কৃষি কর্মকর্তাদের জানিয়ে সমস্যার সমাধান জেনে ভূক্তভোগী কৃষকদের জানিয়ে দেন। কৃষক হাসপাতাল থেকে কৃষি ও ফসলের রোগ-বালাইয়ের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পেয়ে গ্রামের কৃষকরা আগের চেয়ে এখন অনেকটা স্বাবলম্বী।

প্রায়োগিক কৃষি গবেষণার মাধ্যমে কৃষকদের পছন্দের ধানের জাত বাছাই ঃ বাজারে চিকন ও সুগন্ধি ধানের বাজার মূল্য ও চাহিদা সব সময়ই বেশি থাকে। তাই যেসকল কৃষকদের কৃষি জমি বেশি, তারা খোরাকের ধানের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু জমিতে মাঝারি বা মোটা ধান চাষ করেন এবং বাকি জমিতে বাজারে বিক্রির জন্য সুগন্ধি বা চিকন ধানের চাষ করে থাকেন। আশুজিয়া গ্রামের অধিকাংশ কৃষকই মাঝারি ধরনের কৃষক, তাই জমিতে তারা ব্রি বা উফশী জাতীয় ধানই বেশি চাষ করে বছরের খোরাকের ধান রেখে বাকি ধান বিক্রি করে দেন। ২০১৭ সালে আশুজিয়া কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার পর থেকেই সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামে বারসিক’র সহযোগিতায় এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনে ধানের প্রায়োগিক কৃষি গবেসণা পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রায়োগিক গবেষণা থেকে কৃষকরা মালশিরা, ঋতুপাইজাম, সুবাস, উঝ- ০৪ ও গ-১৭১এই পাঁচ জাতের ধান এলাকার জন্য উপযোগি বলে নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। নির্বাচিত এই পাঁচটির জাতের মধ্যে মালশিরা ধানটি সবচেয়ে বেশি কৃষকরা পছন্দ করেছেন। আশজিয়া ও নগুয়া গ্রাম ছাড়াও আশুজিয়া ইউনিয়নের প্রায় আড়াই শতাধিক কৃষক চলতি আমন মৌসুমে মালশিরা ধানের চাষ করেছেন। সংগঠনের উদ্যোগে কৃষকরা চলতি আমন মৌসুমে ১৮টি সুগন্ধি ধানের জাত নিয়ে এলাকা উপযোগি সুগন্ধি ধানের জাত নির্বাচনের লক্ষ্যে ১০ শতাংশ জমিতে প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করছেন। এ গবেষণা থেকে কৃষকরা এলাকা উপযোগি বেশকয়েকটি সুগন্ধি ধানের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হবেন, যা এলাকায় ধান বৈচিত্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে বলে তারা আশা করছেন।

পাখির নিরাপদ বাসস্থানের জন্য গাছে মাটির হাড়ি বাঁধা
কোন ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে ফসলের পোকা দমনে গ্রামে পাখি প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাখির নিরাপদ বাসস্থান ও আশ্রয় নিশ্চিত করতে সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামের গাছে গাছে মাটির কলস বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফসলের জমিতে কৃষকরা বাঁশের কঞ্চি ও গাছের ডাল পুঁতে পার্চিং করে দিয়েছে। কৃষদের মতে, পাখি ক্ষেতের পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করবে এবং পাখি বৈচিত্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামের পরিবেশও সুরক্ষিত হবে।

এছাড়াও সংগঠনটি গ্রামের প্রত্যেক পরিবার প্রতি মৌসুমে বৈচিত্র্যময় সবজি, ফল-মূল, মাছ চাষ ও গবাদি পশু-পাখি (গরু, ছাগল, হাস-মূরগী, কবুতর) পালন করে মহামারী করোনা সংক্রমণ রোধে দৈনন্দিন পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছে। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখন সবজির জন্য বাজারের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল নয়। সংগঠনটি গ্রামের তিনটি কৃষকের বাড়িকে (আবুল কালাম, কৃষক আল আমিন ও কৃষাণী রোকেয়া আক্তার) শতবাড়ি মডেলে পুষ্টিবাড়ি হিসবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। নির্বাচিত তিনটি বাড়িগুলোকে শতবাড়ি মডেলে আদর্শ পুষ্টিবাড়ি হিসেবে গড়ে তুলতে সংগঠনটি সামর্থ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা (বীজ, চারা, উপকরণ) দিয়ে আসছে। গ্রামের অন্যান্য কৃষক পরিবারগুলোও এই তিনটি শতবাড়ি মডেলের বাড়িগুলোর দেখাদেখি নিজ নিজ বাড়িগুলোকে আদর্শ পুষ্টি বাড়ি হিসেবে গড়ে তুলে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের উদ্যোগ নিচ্ছে। সংগঠনের সকল সদস্যরা বিশ্বাস করেন একটি আদর্শ পরিবারই তাদের সকল পুষ্টির চাহিদা পূরণে সক্ষম। এ ধরনের বাড়ি হবে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। এটি তারা তাদের সম্পদ, জ্ঞান ও শ্রম পারস্পারিক আদান-প্রদানের মধ্য দিয়েই করতে চান।

কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া গ্রামটি এখন কৃষি, পরিবেশ, বৈচিত্র্যময় ও পারস্পারিক ও আন্তঃনির্ভরশীল একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। এ গ্রামের সকলে এখন সংগঠিত। বিভিন্ন সমস্যা, বিপদে আপদে তারা ব্যক্তি ও সাংগঠনিকভাবে পরস্পরের পাশে দাঁড়ায়। এ গ্রামের মানুষের মন সকল প্রাণের প্রতি সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল।

happy wheels 2

Comments