ছোট নয়, এটাই আমাদের বড় উদ্যোগ
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে মো. শহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪’ অনুযায়ী রাজশাহী শহরে বর্তমান ছোট বড় মিলে বস্তি সংখ্যা ১০৪টি। যার লোকসংখ্যা ৩৯০৭৭ জন। এই ১০৪টি বস্তির মধ্যে অন্যতম সমস্যা কবলিত একটি বস্তি হলো নামোভ্রদা বস্তি। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের পদ্মা আবাসিকের পাশে ১৯ ও ২৬ নং ওয়ার্ডের রাস্তার দুই প্রান্ত ঘেঁষে দুই ওয়ার্ডের সীমান্ত অবস্থানে এখানে প্রায় ২৫০ এর অধিক পরবিার বসবাস করেন।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য বস্তির তুলনায় এই বস্তির চিত্র অনেক বেশি করুণ। প্রায় সকল পরিবারই গাদাগাদি করে ছেলে, বাচ্চা ও স্বামী সংসার মিলে একটি ঝুপড়ি ঘরে মাটিতে বিছানা করে বসবাস করেন। যে ঘরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৬/১২ ফিটের বেশি নয়। বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষাসহ নাগরিক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে তারা প্রায় বঞ্চিত। প্রকল্প আসে প্রকল্প যায়। বস্তির মানুষগুলোর পরিবর্তন হয় না। বস্তিবাসীর সমস্যা সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি সেফটিনেট কর্মসূচিতে হাজারো উন্নয়নের কথা তুলে ধরা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবশেষে অবস্থানগত অবস্থায় খুব বেশি পরিবর্তন হতে দেখা যায় না। উন্নয়নের মাশুল তুলে নেয় অন্যকোন শ্রেণী। যাদের জন্যে উন্নয়ন তাদের উন্নয়নের মাত্রাটি তলানিতেই থেকে যায়। খাতা কলমে আর প্রতিবেদনে তবুও রচনা হয় উন্নয়নের উপন্যাসিক বর্ণনা। বস্তির মানুষগুলোকে যখন সম্পদ হিসেবে বিবেচনা না করে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হয়, তখনই ঘটে উন্নয়নের ভেলকিবাজি।
প্রতিটি মানুষের মানসে লুকিয়ে থাকে তার নিজের উন্নয়নের কথা। তার নিজের ভাবনায়, নিজের মতো করে সে নিজেই প্রতিনিয়িত তার উন্নয়নের কথা ভাবে। আর তার ভাবনা আর শক্তিগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে যখন চাপিয়ে দেয়া হয় অন্য কারো মতো উন্নয়ন, তখনই ঘটে আরেক বিপত্তি। উন্নয়ন প্রকল্পের হর্তাকর্তাদের কাছে বস্তিবাসীরাও হয়ে উঠেন তাদের মতো করে সমস্যার একটি মানুষ। কিছু সাময়িক লাভের আশায় রোলপ্লে শুরু করেন সেই উন্নয়নবিদদের ধারণার মতো করে। আর আমরা ধরেই নিই এই তো পেয়ে গেছি উন্নয়নের মূলসূত্র। চালিয়ে দিই উন্নয়নের বুলডোজার। কিন্তু, পরিশেষে প্রকল্প শেষে অজানাই থেে যায়ক বস্তিবাসীর সমস্যার কথা। সমস্যা জীবনের পাখা মেলে সমস্যাগুলো আরো বিস্তার লাভ করে। দিনে দিনে বাড়তে থাকে সংকটময় পরিস্থিতির। আর সেগুলো নিয়েই তৈরি হয় আরেক শ্রেণীর ব্যবসা বাণিজ্য।
বরাবরেই বলা হয় বস্তিতে মাদক আর সন্ত্রাসের আখড়া। কিন্তু সমস্যার গভীরে সমস্যার আসল চিত্রগুলো থেকে যায় অগোচরে। এতো কিছুর পরেও বস্তিবাসী ভালো থাকতে চায়। নিরাপদ থাকতে চায়। নিজের মান, সম্মান বজায় রাখতে চায়। প্রয়োজন শুধু আসল পথটি দেখিযে দেয়া। আবার কিছু সেবাদানকারী মানুষ ও প্রতিষ্ঠানও আছে যে তারা এগিয়ে আসতে চায় সত্যিকারের সমস্যা সমাধানে। বস্তির মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে তারা তাদের বস্তির সমন্বিত উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন। কাজও করেন। এরকম মানুষগুলোর প্রয়োজন শুধু পরামর্শ আর শক্তি সাহস সহযোগিতা। সেটুকু পেলেই তারাও অবদান রাখবে তাদের নিজের বস্তির উন্নয়নে।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নামোভদ্রা বস্তিতেও এরকম কিছু মানুষ আছে। নিজের পাশাপশি তার বস্তির সকল মানুষের উন্নয়নের কথা ভাবেন। একসময় এই বস্তিতে খাবার পানির কোন ব্যবস্থাই ছিলো না। অনেক চেষ্টা করেও তারা পরিবারের জন্যে একটি পানির কলও ম্যানেজ করতে পারেননি। কিন্তু এই বস্তির আন্তরিকতায় ভরপুর কিছু মানুষ যেমন নাঈম, সফিকুলের কথা না বললেই নয়। তারা পরামর্শ নিয়ে ওয়ার্ড কমিশনারের সাথে যোগাযোগ করে পানির সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। তাদের একটি পানির লাইন সংযোগ দেয় রাজশাহী ওয়াশা। কিন্তু পানির কলটি রাস্তার ধারে ময়লা ড্রেনের পাশে উচু নীচু জায়গায় সেট করার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটে দুর্ঘটনা। নারী শিশু, বৃদ্ধ এমনকি শক্তিশাবল মানুষগুলোও পিছলে পড়ে যায় ময়লা পানি যাতায়াতের বিশাল ড্রেনে। এ পর্যন্ত এমন দুর্ঘটনায় অনেকে ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
এমন সমস্যায় তারা বসে থাকতে পারেনি। পানির উৎস নিরাপদ করতে সভা ডাকেন বস্তিতে। সিদ্ধান্ত হয়, পানির কলটির গোড়ায় ইট, সিমেন্ট আর বালু দিয়ে সমান করা হবে। যাতে আর কেউ পিছলে ময়লা ড্রেনে পড়ে ক্ষতির শিকার না হন। শুরু হয় কাজ। তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। নিজেরা শ্রম দিয়ে, নিজে বালি আর মাটি কেটে এনে তারা পানির উৎসটি নিরাপদ করেন।
এ বিষয়ে বস্তিবাসী সফিউল বলেন, ‘পানি মানুষের জন্যে ভীষণ প্রয়োজন, আর সেই পানিই ছিলো না আমাদের বস্তিতে। নারীরা অনেক দুর থেকে পানি আনতো। এখন কিছুটা হলেও পানির সমস্যা মিটছে। আর পিছলে পড়া থেকেও আমরা বাচলাম।” তিনি আরো বলেন, ‘এটা ছোট নয়, এটাই আমাদের বড় উদ্যোগ।’