করোনা ক্রান্তিকালে সামাজিক সম্পর্ক অবনমনে উপকুলীয় সুপেয় পানির সংকট
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বর্তমান সময়ে যেদিকে কান দিয়ে শোনা যায শুধু একটায় নাম। করোনা করোনা নামক একটি ভাইরাসের নাম। আমরা যখন কোন বিপদে পড়ি তখন ঠিক যেমন ঈশ্বরকে ডাকি। আর এ যেনো এক মরনব্যাধি নাম উচ্চারন। সকালে ঘুম থেকে উঠলে আগে যেমন মানুষের হাঁক-ডাক, গাড়ীর শব্দ, গবাদী পশুর নানান ধরনের ডাক, পাখির ডাকে ঘুম ভাঙা। এসব গুলোর বাদে এখন যেন চারিদিকে নিস্তব্ধতা যেন জন মানব শুন্য হযে পড়েছে। কেউ কারো বাড়িতে যেতে পারছে আবার কারো বাড়িতে আসতে পারছে না। আত্নীয় স্বজনদের তো আগে থেকেই বারণ করে দেওয়া হযেছে। এখন পাড়া প্রতিবেশিদের আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। যেকোন বিপদ সংসারের খুটি নাটি জিনিষ প্রযোজন হলে একে অন্যের কাছ থেকে নিয়ে আসা দেওয়া এভাবেই চলতো। যেনো ছিলো এক আত্নীয়তার মেল বন্ধন। কিন্তু এখন যেনো সে মেল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু কি করে বেঁচে থাকা যায নিজের আপন জন পরিজনদের নিয়ে সেটাকে ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন যেনো পাড়া প্রতিবেশী সবাই দুসম্পর্কের মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেখানে ছিলো পারস্পারিক আদান প্রদানের মাধ্যমে একে অন্যের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক সে সম্পর্কে আজ যেনো ঘুন ধরেছে। আর এটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি এটা হয়েছে এক অদৃশ্যমান ভাইরাসের কারণে। যার উৎপত্তি হয় ২০১৯ সালে ডিসেম্বর মাসে আমাদের এশিয়া মহাদেশের দেশ চীনের উহান শহর থেকে। যা আজ এক বিশ্ব থেকে আরেক বিশ্ব, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে প্রতিনিয়ত নির্বার গতিতে ছুটি বেড়াছে। আর এ ছুটে পড়াতে বিশ্ব যেনো এক মৃত্যুর মিছিলের সামিল হচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়, প্রতি সেকেন্ডে মানুষের আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছে। কখন কার প্রিযজন আক্রান্ত হবে? হারাবে তার প্রাণ; কখনো হযতোবা সেসব প্রিয়জনদের মুখ দেখতে পারবে কিনা তা নিয়ে আছে সংশয়। প্রতিটিা দেশে তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনায়, জ্ঞান দক্ষতা দিযে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কি করে প্রলংকারী এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তেমনি ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশ বাংলাদেশ ও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই চেষ্টার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হলো লকডাউন ঘোষনা করা। আর সেটা হয়েছে অনেক পরে এবং তা প্রশাসনের নানান মুখী পদক্ষেপ গ্রহনের পরে।
আর এ লকডাউনের কারণে মানুষ একঘরে হযে পড়েছে। আর তার এই ঘরে হয়ে যাওয়াতে সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের সমস্যা। যেমন বাহিরে কোন কাজ কর্ম করতে পারছে না। এতে করে অর্থ সংকট যেমন তৈরি হচ্ছে আর তার সাথে দেখা দিচ্ছে থাদ্য সংকট। যদিও সে খাদ্য সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সুশিল সমাজ, এলাকার যুবরা নানান জনের কাছ থেকে চেয়ে চিনতে এনে সহায়তা করছে। কখনোবা আবার নিজের আত্নীয় স্বজনদের মধ্যে যারা প্রভাবশালী তাদের নিকট থেকে চেয়ে নিচ্ছে, এলাকা বিভিন্ন স্থান থেকে শাক সবজী তুলে কোন রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সরকারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এ সহায়তা কতদিনে দেবে তাও বলা যাচ্ছে না আর যা পাচ্ছে তাও তো পর্যাপ্ত না। এভাবে হযতো বা কিছু দিন চলবে। কিন্তু সব থেকে বড় যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা হযতো বা আরো ভয়ংকার রুপ নিতে পারে। আর তা হলো সুপেয় পানির সংকট।
করোনা ভাইরাস থেকে প্রতিরোধের জন্য লকডাউন যেমন একটা উত্তম উপায়। সেইসাথে যেমন দিনে আধা ঘন্টা, এক ঘন্টা পরপর হ্যান্ডওয়াস, ছাই, বিভিন্ন ধরনের সাবান দিয়ে বার বার হাত ধুতে বলা হচ্ছে। সেটা যেন আরো কঠিন হয়ে পড়ছে উপকুলীয় অঞ্চলের জন্য। আমারা যেহেতু জানি যে, ভৌগলিক ও কৃষি প্রতিবেশগত ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ভু-গর্ভস্থ পানি লোনা। এ এলাকার সুপেয় পানির উৎস খাল, ডোবা, নালা ও পুকুর। এছাড়াও এলাকায় অপরিকল্পিত ভাবে চিংড়ি চাষের কারণে ভু-গর্ভের উপরিভাগ এসব উৎস গুলোও লবণ হয়ে গেছে। সাথে তো আছে নানান সময়ে নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ একাকার হযে এখানকার মিষ্টি পানি লবণাক্ততায় রুপান্তরিত হচ্ছে। মানুষের জীবন হচ্ছে যেনো লবণাক্তময়।
করোনার এই দুর্যোগ কালে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কালমেঘা, কল্যানপুর, কাঠালবাড়ি, জাওয়াখালী, গুমানতলী, দুর্গাবাটি, বাদঘাটা, সোনামুাগারী সহ বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় জনগোষ্টীর সাথে কথা হলে জানা যায় যে, করোনা দুর্যোগে তাদের বর্তমান সমযে বড় সমস্যা হতে চলেছে সুপেয় পানি। কারণ হিসাবে তারা জানান যে, আমাদের এলাকায় প্রত্যেক পরিবারে পুকুর নেই। কখনো ৫, ১০ পরিবার মিলে একটি পুকুর ব্যবহার করে। আবার কোন গ্রামে পিএসএফ (Pond Sands Filter) সম্মিলিত বা শুধু একটিও সুপেয পানির পুকুর আবার কোন গ্রামে পুকুরও নেই পাশ্ববর্তী গ্রামে যেতে হয। যাদের পুকুর নেই তারা যার পুকুর আছে তার পুকুরে থালা বাসন ধোওযা, গোসল করা, খাওযার কাজে পুকুরের পানি ব্যবহার করে। কিন্তু বর্তমান সমযে করোনাতে যে লক ডাউন শুরু হয়ে গেছে তাতে করো কারো পুকরে যাওযা তো দুরের কথা কারো বাড়িতে পর্য়ন্ত ঢুকতে দিচ্ছে না। যার পুকুর সে বিভিন্ন ধরনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখার চেষ্টা করছে। এতে করে যাদের পুকুর নেই তারা তাদের সাংসারিক কাজের জন্য পানি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।
কি ধরনের সমস্যা এখন পর্য়ন্ত সম্মুখীন হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে জাওয়াখালী গ্রামের কৃষাণী শেফালী বেগম জানান যে, আমরা এখানে প্রায় ৪০ ঘর মানুষ বসবাস করি। আমাদের মৃধার পাড়ায় একটা পুকুর আছে সেখানে তারা যে ১০-১৫ ঘর আছে তারা ব্যবহার করে সেটা সাধারনের পুকুর। আর আমরা বাকী পরিবার গুলো ও গুমানতলী গ্রামের কিছু পরিবার আটুলিয়া গ্রামের গাইন বাড়ির পুকুরের পানি এনে সাংসারিক কাজে ব্যবহার করতাম গত কয়েক দিন সে পুকুর যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখন লবন পানি দিয়ে রান্না বান্না করতে হচ্ছে। আবার খাবার পানির জন্য দুরবর্র্তী গ্রামে মাজাট ও নকিপুর যেতাম কিন্তু রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে আটকে দেওয়া এবং বাহিরে বের হওয়া নিষেধ সেটা মাথায় রেখে বাহিরে যেতে পারিছিনা। এতে করে বাড়ির পাশে যে রিফাইন পানি বিক্রি হয় সে পানি এবং দোকান থেকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে। যেকানে এখন কোন আয় রোজগার নেই বাহিরে যেতে পারছিনা সেখানে পানি কিনে খাওযা যেনো আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। করোনা থেকে যেনো আরো বড় দুর্যোগ মনে হচ্ছে আমাদের কাছে সুপেয় পানির সংকট।
যদিও উপকুলীয় এলাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ এসেছে এবং তা সবা্ই কোন না কোন ভাবে মোকাবেলা করেছে। কিন্তু এ মরণব্যাধি করোনা এমন এক অদৃশ্যমান ভাইরাস যা প্রতি পদে পদে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করছে। উপকুলীয় এলাকায় পানির সমস্যা জরুরূী ভাবে সমাধান না হলে প্রলংকারী এই করোনার কারণে সুপেয় পানির মারাত্নক সংকট দেখা দিতে পারে এলাকায়। এতে করে করোনায় আক্রান্ত হওযার আগেই বড় কোন দুর্ঘটনায পরতে না হয়। যেহেতু বর্তমান সময়ে এই করোনা দুর্যোগে সব মানুষ প্রশাসনের সকল নির্দেশনা মেনে চলার চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে জরুরী ভাবে পানি সংকটের উত্তোরনের উপায় খোঁজা জরুরী হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে এলাকাতে পানি পরিশোধন করার যে মেশিন তৈরি হয়েছে সেগুলো কোন কোন নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করা দরকার। সাথে যেগুলো আছে সে গুলো দিয়ে বিনামুল্যে পানি প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে করোনা ক্লান্তিকালে উপকুলীয় এলাকায় সুপেয় পানি সংকটের হাত থেকে রেহায পাওযা যেতে পারে।