সাজনা গ্রামে কিশোরী ও যুব সংগঠনের সাজনা ডাল রোপণ

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
নেত্রকোনা কর্মএলাকার বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠা ছোট ছোট জনসংগঠনগুলো নিজ নিজ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় ও এলাকার পরিবেশ সুরক্ষার মাধ্যমে সাংগঠনিক উদ্যোগে এলাকার রাস্তার দু’পাশে ও এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৃক্ষ রোপণের মত উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে। নেত্রকোনা অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার জনসংগঠনগুলোর ন্যায় সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের দরুনবালি গ্রমের ‘ফুল পাখি কিশোরী সংগঠন’ গ্রামের পরিবেশ সুরক্ষা, পুষ্টির চাহিদা পুরণ, বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা, এলাকার প্রাণবৈচিত্র্যের উন্নয়নে গ্রামে একটি কিশোরী তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করে অসহায় জনগোষ্ঠীকে সরকারি/বেসরকারী সেবা পরিসেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে। এছাড়াও সংগঠনটি সামাজিক সংস্কারমূলক কাজ, যেমন-বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, মাদক প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, যুব ও কিশোরীদের বই পড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধকরণ এবং খেলাধূলার মাধ্যমে বিনোদনের আয়োজন করে আসছে। সংগঠনের সদস্যরা সাজনা, সাজনা শাক ও সাজনা গাছের শিকড়ের পুষ্টিগত উপকারিতা জানার পর নিজ গ্রামটিকে (বালি) সাজনা গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চলতি মৌসুমে (এপ্রিল ২০২১) সাংগঠনিক উদ্যোগে ২০০টি সাজনার ডাল সংগ্রহ করে গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবারে ২টি করে সাজনার ডাল সংগঠনের সদস্য, যুবক, প্রবীণ ও নারীদের অংশগ্রহণে রোপণ করেছে।

একই ইউনিয়নের ‘রক্তের বন্ধন যুব সংগঠন/অক্সিজেন যুব সংগঠনের উদ্যোগেও গ্রামে সাজনার ডাল রোপণ করেছে। সাজনার ডাল রোপণের পাশাপাশি সংগঠনের উদ্যোগে জনগোষ্ঠীকে সাজনা শাক ও সাজনার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতন করা হয়। এর ফলে গ্রামের জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবারভিত্তিক সাজনা ডাল রোপণ করে গ্রামটিকে সাজনা গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলে সকলের মধ্যে সাজনা ও সাজনা শাক খাওয়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ বিষয়ে ‘ফুল-পাখি কিশোরী সংগঠন’র সভাপতি রতœা আক্তার বলেন, ‘সাজনা শুধুমাত্র পুষ্টি ও ভিটামিনের চাহিদাই পূরণ করেনা। সাজনা ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধেও ঔষধ হিসেবে কাজ করে। সজনা ও সাজনা শাক্ মানব দেহের হরমোন বৃদ্ধি করে। ভিটামিন এ, বি, সি, সাজনা ও সাজনা শাকে যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। সাজনা ও সাজনা শাক অনেক সুস্বাদু এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। সাজনার ডাল ও শিকড় দিয়ে ঔষধ বানানো যায়, সেই ঔষধের অনেক উপকারিতা। সাজনা পাতা ভাজি শরীরের বিষ ব্যাথা নিরাময়ে সহায়ক, কুষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়েও সাজনা শাকের জুড়ি নেই। কয়েক বছর আগেও আমাদের বালি গ্রামে সাজনা গাছের সংখ্য হাতে গোনা ছিল, কিন্তু বিগত তিন বছর যাবৎ আমাদের গ্রামের কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এখন ১৫০টি সাজনা গাছ হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, গত এপ্রিল মাসে আমরা আরও ২০০টি সাজনা ডাল গ্রামের রাস্তার দুইপাশে ও বসতভিটায় রোপণ করেছি। কিন্তু আমরা অনেকেই সাজনা কদর করিনা। বাজারে প্রতি কেজি সাজনার মূল্য সর্বনি¤œ ৬০ টাকা। মৌসুমের শুরুতে সাজনার মূল্য সর্বনি¤œ ১০০ টাকা থাকে। শহরের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নিকট সাজনা শ্ােকর বেশ কদর রয়েছে। শহরের বাজারের সাজনা শাক তোলার সাথে সাথেই ভালো দামে বিক্রি হয়ে যায়। তাই আমি অনেক গবির্ত আমাদের সংগঠনের কাজে। গ্রামের কিশোরী ও যুব সংগঠনের উদ্যোগেই আমাদের গ্রামে আজ ২০০টি সাজনা চারা রোপণ করা হয়েছে। আগামী দুই এক বছরের মধ্যে আমরা গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে দু’টি করে সাজনা গাছ দেখতে পাব বলে আশা করি। আমাদের বালি গ্রামটিকে সাজনা গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে এলাকায় সাজনা ও সাজনা শাক যেমন সহজলভ্য হবে, তেমনি সাজনা বাজারে বিক্রি করে গ্রামের পরিবারগুলো আর্থিক ভাবেও লাভবান হতে পারবে।’

একই গ্রামের ‘অক্সিজেন যুব সংগঠন’র সভাপতি পরাগ আহমেদ বলেন, ‘সাজনা পাতা ও সাজনায় লেবুর চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ আছে। সাজনা ও সাজনা পাতায় যে, প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন আছে সে বিষয়টি আমরা অনেকেই জানিনা। আমাদের দরুনবালি গ্রামটিকে আমরা তিনটি সংগঠন মিলে ‘সবুজ গ্রাম’ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। তাই প্রত্যক বছর আমরা সংগঠনের উদ্যোগে সাজনা চারা, ঔষধি গাছের চারা, বৈচিত্র্যময় ফলের চারা, জ¦ালানি সাশ্রয়ী চুলা, পলিথিন ব্যাগ বর্জন, মাদকমুক্ত ও বাল্যবিয়ে মুক্ত সমাজ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। গ্রামের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা ও বৃদ্ধিতে প্রতিবছর বেশি বেশি করে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণ করতে গ্রামের সকলকে উদ্বুদ্ধ করছি এবং সাংগঠনিক উদ্যোগে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা বিতরণ ও রোপণ করছি। বেঁচে থাকতে হলে সকলে মিলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার করতে হবে। সবুজ গ্রামকে সবুজের সমারোহে ভরে রাখতে হবে। তাই আমরা সাজনার মৌসুমে বারসিক’র পরামর্শ ও সহযোগিতায় এবং ‘ফুল-পাখি কিশোরী সংগঠন’ ও ‘অক্সিজেন যুব সংগঠন’র উদ্যোগে গ্রামের রাস্তার দু’পাশে ও বসতভিটায় ২০০টি সাজনা চারা রোপণ করেছি।’


একই ইউনিয়নের বালুয়াকান্দা ‘রক্তের বন্ধন যুব সংগঠন’র আহবায়ক রাজন আহমেদ বালি গ্রাম পরিদর্শন করে বলেন, ‘আমরা সংগঠনের কয়েকজন যুবক সবুজ গ্রামে (বালি) এসে দেখতে পেলাম গ্রামটিতে সত্যি সবুজের সমারোহে ভরপুর। গ্রামের কিশোরী ও যুব সংগঠনের গৃহীত উদ্যোগগুলো খুবই প্রশাংসনীয়। সাজনা গ্রামে রাস্তার দুইপাশে সাজনা ডাল রোপণ করতে আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে দু’টি সংগঠনকে ৫০টি সাজনার ডাল দিয়ে সহযোগিতা করেছি। আমাদের বালুয়াকান্দা গ্রামে সাজনা গাছ না থাকায় সাজনার গুণাগুণ সম্পর্কে আমাদের তেমন কোন ধারণা ছিল। সাজনা ও সাজনা শাক্ আমাদের খাওয়া হয় না বললেই চলে। সাজনার অনেক দাম। আমি আমাদের সংগঠনের সভায় সাজনা ও সাজনা শাকের গুণাগুণ নিয়ে সদস্যদের সাথে আলোচনা করব। প্রতিবছর বসতভিটায় সাজনার ডাল রোপণ করতে গ্রামের সকলকে উদ্বুদ্ধ করব। এ মৌসুম থেকেই সাজনা ডাল রোপণের মাধ্যমে আমাদের গ্রামটিকেও সাজনা গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করবো।’


গ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও সমাজ উন্নয়নে যুব সংগঠনের এহেন উদ্যোগ এলাকার ভবিষ্যত প্রজন্মের পুষ্টির চাহিদা যেমন পূরণ হচ্ছে, তেমনি তারা প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠারও সুযোগ পাচ্ছে। ফুল-পাখি কিশোরী সংগঠন ও অক্সিজেন যুব সংগঠনের ন্যায় দেশের সকল এলাকার যুব ও কিশোরীরা যদি সংগঠিত হয়ে লকডাউন চলাকালীন সময়ে নিজ নিজ এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষাসহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে গোটা দেশটাই সবুজে সমারোহে ভরে উঠবে। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরে থাকবে সকল গ্রাম, নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে আগামী প্রজম্মের ভবিষ্যৎ।

happy wheels 2

Comments