টমেটো চাষ করে সফল মাহমুদুল হাছান
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
প্রথমবারের মতো বর্ষা মৌসুমে টমেটো চাষ শুরু করে সফলতা অর্জন করেছে নেত্রকোনা জেলা বিশ্বনাথপুর গ্রামের বিশেষভাবে সক্ষম যুব মাহমুদুল হাছান।
সবজি চাষে নতুনত্ব ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন মাহমুদুল। তাই তো জুনমাসে শেষদিকে কলম দেওয়া টমেটোর চারা এনে ২০ শতাংশ জমিতে রোপণ করেন তিনি। জমি প্রস্তুতের সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ তিনি বারসিক থেকে নেন। মাঠিতে উঁচু বেড করে চারা রোপণ করেন। কোনিয়া গ্রামের সফল কৃষকদের কাছে থেকে চাষ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করলেও চারা রোপণের পর থেকে সকাল বিকেল প্রতিটি সময় সবজি ক্ষেতে নজর রাখতে হয়েছে তাকে। ৪০ দিনে গাছে ফুল ধরবে-এমনটি জেনেও তিনি খুব বেশি আশ্বস্ত হতে পারেননি। তাই তো এ ৪০টি দিন তাকে বহুবার ছুটে যেতে হয়েছে সফল চাষীদের বাড়িতে, প্রয়োজনীয পরামর্শ নেয় বারসিক অফিস থেকেও!
চারা রোপণ সম্পর্কে মাহমুদুল বলেন, ‘১৫ টাকা দরে ২৫০টি চারা ৩৭৫০ দরে কিনে এনে বেড় করে চারা রোপণ করেছি। বেড এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে পানি জমে না থাকে। এছাড়া প্রতিটি চারার দুই পাশে খুঁটি দিতে হবে যাতে করে গাছ কোন দিকে হেলে না পড়ে। গাছের উপর পলিথিনের মাচা তৈরি করে দিতে হবে এমনভাবে যাতে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস ঢুকতে পারে। কিন্তু বৃষ্টির পানি পড়বে না! কারণ টমেটো গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়লে পাতা কুকড়ে গিয়ে গাছ নষ্ট হয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাচা থাকায় আরেকটি বড় উপকার হয় বুলবুলি পাখির হাত থেকে পাকা টমেটো রক্ষা করা যায়। বুলবুলি পাখির আক্রমণ বর্ষা মৌসুমে টমেটো চাষের একটি বড় সমস্যা। কারণ এ সময় গাছে ফল কম থাকায় টমেটো ক্ষেতে পাখি আক্রমণ বেড়ে যায়।’
প্রথমবার টমেটো চাষ করে সফলতা অর্জন করেছে মাহমুদুল। গাছে পাতায় পাতায় টমেটো ঝুলছে। নিজেদের পরিবারে চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেছেন। বর্তমান প্রতি কেজি টমোটোর বাজার দর ১০০ টাকা। তাই টমেটো বিক্রি করে ভালোই আয় হচ্ছে তার। শীতের শুরুতে উৎপাদন বাড়বে। এছাড়া এই টমেটো গাছ থেকে তিনি ফেব্রæয়ারি মাস পর্যন্ত ফলন পাবেন বলে আশা করেন।
টমেটো বিক্রয়ের পাশাপাশি তিনি নিজের টমেটো গাছ থেকে কিভাবে টমেটোর চারা করা যায় তার প্রস্তুতি নিয়েছেন। চারা তৈরি করে নিজেদের গ্রামের আগ্রহী অন্যান্য কৃষকদের মাঝে বিক্রয় করবেন। এতে করে নিজের যেমন আয় বাড়বে সেই সাথে গ্রামে আগ্রহী কৃষকদের মাঝে টমেটো চাষে আগ্রহ বাড়বে। তার এ সফলতা দেখে অনেক কৃষক আগামী বর্ষা মৌসুমে টমেটো চাষের পরিকল্পনা করছেন। কৃষিতে আগ্রহ বেড়েছে এলাকার যুবদের মাঝেও।
উল্লেখ্য যে, নেত্রকোনা জেলা সদরে আমতলা ইউনিয়নের একটি গ্রাম বিশ্বনাথপু। এই গ্রামে উদ্যোগী যুব মাহমুদুল হাছান নেত্রকোনা সরকারি কলেজে অর্থনীতিতে অনার্সে পড়াশুনা করছেন। দারিদ্রতার ও পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সাথে কৃষিকাজে সহায়তা কাজ করতেন ছেলেবেলা থেকে। বাবার হাত ধরেই সবজি চাষ করার কাজে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। মেধাবী শিক্ষার্থী মাহামুদুল দরিদ্র পরিবারে বাবার সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ শুরু করলেও হঠাৎ এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় তার জীবনকে প্রায়ই থামিয়ে দেয়।
রাইস মিলে চাল ভাঙাতে গিয়ে ২০০৬ সালে মেশিনের আঘাতে তার একটি হাত কেঁটে যায়, জীবন মূত্যুর মুখোমুখি হয়ে বেঁচে গেলেও হারাতে হয় বাম হাতটি চিরতরে। জীবন চলার পথের শুরুতে এ আঘাত তার শরীরকে দূর্বল করে দিলেও মনকে বিচলিত করতে পারেনি। সুস্থ হওয়ার পর আবার এক হাতের উপর ভর করে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। ভাঙা ঘরে বৃষ্টির পানিতে চোখের পাতা, বইয়ে পাতা ভিজে গেলেও পড়াশোনা বন্ধ করেননি। স্কুলের গণ্ডি পাড় করেছেন ভালো রেজাল্ট করে। এখন নেত্রকোনা সদরে অনার্সে পড়ছেন অর্থনৈতিতে। মাহমুদুলের নিজের পড়ার খরচ তো রয়েছেই এর সাথে রয়েছে ছোট ৪ ভাইয়ের পড়ার খরচও। তাই তারা সবাই মিলে নিজের বসতভিটা ও বাবার যতটুকু ধানী জমি আছে তা চাষ করে সংসার চালান।