কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শখের মৃৎশিল্প
নেত্রকোনা থেকে রিকু রানী পাল
বর্তমান সভ্যতার উন্নত প্রযুক্তি আর শিল্পকর্মের পণ্যের ব্যবহারের ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি পেশা মৃৎশিল্প। অতীতে গ্রামীণ পরিবারগুলো সাংসারিক সকল কাজে মাটির উপকরণ ব্যবহার করতো। মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না করা, মাটির কলসে পানি রাখা, সানকিতে ভাত খাওয়াসহ সকল কাজেই মাটির বাসন ছিল একমাত্র ভরসা। মাটির কলসে পানি রাখলে এই পানি খুব ঠাণ্ডা লাগতো। এটি ছিল গরিবের ফ্রিজ। অনেক ধনী পরিবারও শখের বশে মাটির কলসে পানি সংরক্ষণ করতো। এখন পানি রাখা তো দূরের কথা, এসব জিনিস আর চোখেও দেখা যায়না। এমন আক্ষেপই রয়েছে আটপাড়া থানার তেলিগাতী ইউনিয়নের কামারগাতি গ্রামের ২৬টি পরিবারের। যাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় হচ্ছে মাটির হাঁড়ি, পাতিল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি ও বিক্রি করা।
তাঁরা মনে করেন যে, এমন একটা সময় ছিল যখন অন্য পেশার মানুষেরা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে ব্যবহার করতো মাটির তৈরি আসবাবপত্র। এ সমস্ত উপকরণ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাটি বিনামূল্যেই পাওয়া যেতো। তাছাড়া জ্বালানিও কিনতে হতোনা। কামারগাতী গ্রামের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সারাদিন ব্যস্ত থাকতো মাটির আসবাব তৈরিতে। হাতের সাহায্যে মাটি নরম করে অনেক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন আদলে তৈজসপত্র বানাতো তারা। এরপর এগুলো নির্দিষ্ট সময়ে আগুনে পুড়িয়ে ব্যবহার উপযোগি করে গড়ে তুলতো। কুমার পাড়ার অতীতের সেই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়েনা।
কারণ বর্তমান সময়ে সরকারের অনেক খাস জমি সমাজের বিত্তশালী মানুষদের আওতাধীন রয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় মাটি এখন অনেক মূল্য দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এবং এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জ্বালানিও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচুর টাকা ব্যয় করে মাটির এসব পণ্য তৈরি করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা সঠিক মূল্যে বিক্রি করা যায়না। কারণ বর্তমান বাজারে বিভিন্ন ধরণের প্লাস্টিকজাত পণ্য সুলভে কিনতে পাওয়া যায়। এই সব পণ্যের বাহারী রঙ দেখে আকর্ষিত হয়ে মানুষেরা এগুলোই কিনে।
কামারগাতী গ্রামের কুমার সম্প্রদায়ের মানুষেরা মনে করেন, আমাদের জিনিস উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি করার কোনো সুযোগ নাই। এবং গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো নয়। আবার উপকরণ রেখে বিক্রি করার মতো বাজারে নির্দিষ্ট কোনো দোকান বা জায়গা নেই। যে কারণে বিভিন্ন গ্রামে চাহিদা থাকা স্বত্বেও সংরক্ষণ ও যাতায়াতের ব্যবস্থার অভাবে তৈরিকৃত পণ্য বিক্রি করতে সমস্যা হচ্ছে। একদিকে প্লাস্টিক সামগ্রীর বাজার দখল অন্যদিকে মাটি ও জ্বালানির স্বল্পতা, যে কারণে আমরা আমাদের পেশা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছি। পরিবার চালাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।
জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছিনা। খুব কম বয়সেই ছেলে মেয়েদেরকে আয়বর্ধনমূলক কাজে নিয়োজিত করতে হচ্ছে। সুশিক্ষার অভাবে আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মেয়েরা বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছে। আবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সকলে সচেতন নয়। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো জটিল সমস্যা আমাদের গ্রামে রয়েছে। নারী ও শিশু স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ইত্যাদি সচেতনতামূলক বিষয়েও তারা অজ্ঞ।
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামের প্রত্যেক নাগরিকের সমানভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য ছয়টি মৌলিক চাহিদার প্রাপ্যতাও তাঁদের অধিকারে রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের অন্যান্য দলিত শ্রেণির মানুষের মতোই তাঁদের বর্তমান অবস্থা। খাবারের নিশ্চয়তার পাশাপাশি রয়েছে সুস্থভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশের অভাব। সুশীল সমাজ, সরকার একটু মানবতার দৃষ্টিতে তাঁদের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারলে অসহায় ২৬টি পরিবারের বেঁচে থাকা সহজ হতো।