পাখির সাথে মেজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্ব
গাইবান্ধা থেকে হেদায়তুল ইসলাম বাবু
গাইবান্ধায় পোস্টিং হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই নির্বাহী মেজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান এলাকার মানুষের মনে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। ব্যতিক্রমী বিভিন্ন উদ্যোগসহ মানুষের সাথে সাবলীলভাবে মেশা এবং আন্তরিকতা দিয়ে তিনি তাদের খুব কাছের একজন হওয়ার চেষ্টা করেন। শুধু এলাকার মানুষের মনে নয়; প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের সাথে বন্ধুত্ব করতে তিনি বদ্ধপরিকর! সবার সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করার জন্য তিনি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এই অঞ্চলের প্রাণ, প্রকৃতি আর মানুষের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা দিনে দিনে আরও গভীর রূপ ধারণ করে। তাই তো তিনি এলাকার পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল তৈরির জন্য প্রতিটি গাছে মাটির হাঁড়ি বা কলসী বেঁধে রাখেন যাতে পাখিরা সেখানে বাসা বাঁধে! রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ও অন্যান্য দুর্যোগ নিজেদের রক্ষা করতে পারে। এই কাজটি তিনি পাখি বা প্রকৃতিকে ভালোবাসার তাগিদ থেকে করেছেন; কেউ তাকে এ কাজ করতে বাধ্য করেননি। সরকারি একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও নানান ব্যস্ততার মাঝে ঠিকই সময় করে নিয়েছেন প্রকৃতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে। তাই তো তাঁর এ উদ্যোগ প্রকৃতিপ্রেমী থেকে শুরু করে তরুণ ও বিভিন্ন বয়সের মানুষকে উজ্জীবিত করে, সাহসী করে তুলে এবং আশা জাগিয়ে তুলে!
আবু সুফিয়ান পাখির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরির জন্য গাছে গাছে বাঁধেন মাটির কলস। কোন কোন গাছে বাঁধেন মাটির হাঁড়ি। নিজেই গাছে চড়ে তিনি এই কাজটি করেন। গাইবান্ধা পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় গাছের দিকে নজর দিলে আবু সুফিয়ানের এ কাজ যে কারও চোখে পড়বে। সরকারি এই কর্মকর্তার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে পাখিরাও! কারণ তাঁর বেঁধে দেওয়া এসব কলস ও হাঁড়িতে তারা বাসা বেঁধেছে। ঝড়-বৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষা করছে। এমন নিরাপদ আবাসস্থল পেয়ে পাখিরাও খুশি! আর পাখিদের এই খুশি দেখে প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে মানুষের বন্ধুত্ব যেন আবার নতুন করে জেগে উঠে!
কীভাবে এবং কার অনুপ্রেরণায় তিনি এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন জানতে চাইলে মেজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান বলেন, “পাখিদের উপযোগী গাছপালা কমে যাওয়ায় পাখির নিরাপদ আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। আবাসস্থল সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাখির প্রজননও হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। এছাড়া সামান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মরে যায় পাখি। এসব দেখে নিজেকে সবসময় প্রশ্ন করতাম, আমারা (মানুষরা) কতো আরাম আয়েশে থাকি, আর যারা আমাদেরকে টিকিয়ে রাখছে, পরিবেশ ভালো রাখতে প্রতিদানহীন সবসময় ভূমিকা পালন করছে, সেই পাখিগুলো কতো কষ্ট আর জীবন সংকটে পড়ছে। তাদের জন্যে আমাদের কি কোনই করণীয় নেই? অবশ্যই আছে। আমরাই পারি তাদের জন্যে নিরাপদ খাদ্য আর আবাসের ব্যবস্থা করতে। মূলত ব্যক্তিগত তাড়না থেকেই আমি এমন উদ্যোগ নিয়েছি।” তাছাড়া পাখির প্রতি মমতা আর ভালোবাসা তৈরির পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে আরো সচেতন করার জন্যই এমনটি করছেন বলে তিনি জানান।
আবু সুফিয়ানের টাঙানো বা বাঁধানো এসব মাটির হাঁড়ি বা কলসে পাখিরা বাসা তো বেঁধেছেই সাথে সাথে তাদের কোলাহলে মূখরিত প্রতিটি এলাকা! তাদের গুঞ্জন ও গান বিনোদিত করে মানুষকেও! মানুষ ও পাখির ভেতরকার আন্তঃসম্পর্ক আবার যেন জেগে উঠেছে। মানুষকে দেখে পাখি যেমন পালিয়ে বেড়ায় না আর মানুষও পাখিকে দেখে শিকার করার কোন কুবাসনা তাদের মনে একটিবার হলেও জাগেনি। এ যেন আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতার একটি দুর্লভ উদাহরণ!
আবু সুফিয়ানের এই উদ্যোগকে প্রশংসা করেছেন প্রকৃতি প্রেমী ও প্রাণিবিদরা। তারা মনে করেন, এভাবে প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও অস্তিত্বকে রক্ষার উদ্যোগ নিলে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা পাবে, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান ও প্রাণের মধ্যে আদান-প্রদান বেশি হবে। এতে করে লাভবান হবে মানুষ! প্রকৃতি প্রেমীরা বলছেন, “বন জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় পাখির জন্য এখন নিরাপদ আবাস প্রয়োজন। না হলে শুধুমাত্র গল্প আর কবিতার লাইনে থাকলেও বাস্তবে সব প্রজাতির পাখি রক্ষা করা সম্ভব হবে না।” গাইবান্ধা সরকারি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রধান খলিলুর রহমান বলেন, “পাখিদের বাঁচাতে না পারলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না।”
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলাটিতে নানা দিক থেকেই দিনে দিনে প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একদিকে নদী ভাঙন অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যাগসহ উন্নয়ন দুর্যাগেও কম নেই। হারহামেশা প্রকৃতি আর স্থানীয় মানুষের মতামত এবং যাচাই বাছাই না করেই নানামূখী কর্মসূচি গ্রহণ করার কারণে স্থানীয় বন্যপ্রাণী ও –পািখ দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ ও প্রকৃতি প্রেমী আবু সুফিয়ানের এই উদ্যোগ এ অঞ্চলে তরুণসহ অন্যান্য শ্রেণীর ও পেশার মানুষের ভেতরে সচেনত করে তুলবে, পাখি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় তারাও স্ব স্ব অবস্থান থেকে উদ্যোগী হবে।