রাসায়নিকে মিলেনি মুক্তি বাড়িয়েছে কৃষকের ক্লান্তি
রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম
অতিরিক্ত রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার করলে প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না কৃষি ফসল। এমনটিই জানালেন পবা উপজেলার অভিজ্ঞ কৃষক জাকির হোসেন। তার মতে, চিরচেনা বরেন্দ্র অঞ্চলের জলবায়ু দিনে দিনে পরিবর্তন হওয়ার কারণে ফসল চাষের সমস্যা আরও বেড়েছে। তিনি জানান, এলাকার পুরাতন জাতগুলো এলাকা সহনশীল হলেও সেগুলো সংরক্ষণ ও জমিতে চাষ কম হয় বলে দিনে দিনে এগুলো বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এছাড়া যতœ এবং উদ্যোগের অভাবে পুরাতন জাতগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “স্থানীয় কৃষিফসলের জাত সরকারিভাবে সংরক্ষণ করার কোন উদ্যোগ নেই।” অন্যদিকে আধুনিক কৃষিফসল আবাদের ক্ষেত্রে নানান রোগ ও পোকার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন কৃষকরা। রাসায়নিক ও কীটনাশক দিয়ে মাটির ক্ষতি তো হচ্ছে আবার দেখা যায় অতিরিক্ত রাসায়নিক দিলে প্রতিকুল আবওয়া সহ্য করতে পারে না ফসলগুলো।
বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ু এই বিরূপ আচরণে রবিশস্যসহ বিভিন্ন শস্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে পবা উপজেলার পানচাষীরা জানান, তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় পানের মধ্যে রোগ পোকার আক্রমণ বেশি হচ্ছে। ফসলে বেশি পরিমাণ রাসায়নিক এবং কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে আবাদকৃত শস্য-ফসলগুলো বিরূপ আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না। অভিজ্ঞ কৃষক আলহাজ্জ্ব সাইফুল ইসলাম বলেন, “অতিরিক্তি রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার করলে ফসল অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়, বিরূপ আবহাওয়া সইতে পারে না। কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদকৃত ফসল বিরূপ আবহাওয়া সহ্য ক্ষমতা বেশি।” অন্যদিকে পবা উপজেলার মাধাই পাড়ার কৃষক মো. গাজিয়ার রহমান বলেন, “১৫-২০ বছর আগেও তাপমাত্রা ছিলো, তবে এখনকার তাপমাত্রার চেয়ে ওই তাপমাত্রার প্রখরতা কম, ঘুমট সিস্টেম তাপমাত্রা।” তার মতে, “এখন গরমের মধ্যে আদ্রতা বেশি, যার ফলে এই গরমে বেশি ক্ষতি হয়।” একই সুরে কথা বলেছেন তানোরের প্রবীণ কৃষক ইউসুফ আলী মোল্লা। তাঁর মতে, “ফসলে বেশি রাসায়নিক কীটনাশক দিয়ে গাছকে দুর্বল করার কারণে চলমান আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না।”
তবে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক না দিলে এবং স্থানীয় প্রজাতির ফসল আবাদ করলে বিরূপ তাপমাত্রার মধ্যেও এ ফসলগুলো ভালো ফলন দেয়। কারণ এসব জাতগুলো এলাকার পরিবেশের সাথে মানানসই এবং স্থানীয় আবহাওয়া উপযোগী। দুর্যোগ সহনশীল এ জাতগুলো যদি কৃষক ব্যবহার করেন এবং জমিতে আবাদ করেন তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তারা হ্রাস করতে পারে বলে অভিমত অনেক কৃষক। এই প্রসঙ্গে পান চাষী অভিজ্ঞ কৃষক সুমন মিয়া তার পান চাষের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানান, তার পান বরজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম দেন বলে তার বরজে রোগ ও পোকা কম হয়, পানও সুস্থ আছে। তিনি জানান, জলবায়ু বিরূপ আচরণে কৃষকরা ধান বাদ দিয়ে অন্য ফসল চাষের দিকেও মনোযোগী হচ্ছেন যদিও তাতেও তাদের ক্ষতি কোন অংশে কম নয়।
প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চলতি আউশ মৌসুমের শুরুতে এবার কাঙ্খিত বৃষ্টিপাত না হওয়ার ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে আউশের চাষ ব্যাহত হয়েছে। তৃণমূল কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই অঞ্চলের আউশ আবাদ মূলতঃ বৃষ্টিনির্ভর। এ পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কাঙ্খিত বৃষ্টি হয়নি। ফলে আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে। উপরোন্তু বাজারে ধানের মূল্য না থাকায় কৃষগণ ভুট্টা, পাট ও সবজি চাষে ঝুঁকে পড়ছে। কিন্তু এখানেও বাজারের অবস্থা স্থিতিশীল নয় বলে অনেকসময় ক্ষতির শিকার হন কৃষকরা। রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে আউশের চাষ কম হয়েছে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে আউশের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিলো ৪৪ হাজার ৬২২ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৪০ হাজার ২৬৯ হেক্টর। গত বছর রাজশাহীতে আউশের আবাদ হয়েছিলো ৪২ হাজার হেক্টর।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব পানচাষীদের ওপরও পড়েছে। তারা জানান, পানের বরজে রোগ ও পোকা এবং হঠাৎ মড়ক লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া পান বরজে সেচের জন্য তারা পর্যাপ্ত পানিও পাচ্ছেন না বলে জানান। তারা জানান, পানের বরজে প্রাকৃতিকভাবে খাল, খাড়ি বা পুকুর থেকে পানি ব্যবহার করলে পানের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হওয়ার ফলে পানি বিষাক্ত এবং জলবায়ু ও মানুষ সৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে খাড়িগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পানি তারা পাচ্ছেন না। পান চাষী মো. টুটুল মিয়া বলেন, “তাপমাত্রা বেড়ে গেছে, ফলে পানের বেশি রোগবালাই ধরছে।” তিনি আরও বলেন, “পানের এলাকার বৈচিত্র্য যেমন বিভিন্ন পাখি কমে গেছে, যেগুলো পানের পোকা খেতো, এগুলো কমে যাওয়ায় পানের বরজে পোকার আক্রমণ বেড়েছে।”
এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কৃষকরা নানান দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নত জাত ও রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে সমস্যা থেকে উত্তরণে তাদের প্রচেষ্টা উল্টো তাদের বিপদে ঠেলে দিয়েছে। কেননা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগে তারা দেখেছেন যে, ফসলগুলোতে রোগ ও পোকার আক্রমণের হার বেড়েই যাচ্ছে। তাদের মতে, এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় জাতগুলো থেকে এলাকা উপযোগী ও দুর্যোগ সহনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। কিছু কিছু কৃষক স্থানীয় জাত ব্যবহার করে সফল হয়েছেন। তবে বৃহৎ পরিসরে এই স্থানীয় জাতকে সংরক্ষণ ও আবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।