হারিয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু ফল ডেবু

সোনিয়া আফরোজ, সাতক্ষীরা থেকে

ডেবু একটি অপ্রচলিত ফল। অচাষকৃত গ্রামীণ ফল হওয়ায় শহরের অধিকাংশ মানুষ ডেবুকে চেনেন না। ফলটিকে না চেনার কারণে এবং এর পুষ্টিগুণ না জানার কারণে বাজারে বিক্রি হলেও শহরের মানুষ কেউ এটা কিনে খায় না। ডেবু খুবই সুস্বাদু একটা ফল। এটি টক-মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে।

ডেবুর ইংরেজি নাম Monky Jack। এর অনেক স্থানীয় নাম রয়েছে। সাতক্ষীরা অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি ডেউ, ডেবু, ডেওয়া বা ডেওফল নামে পরিচিত। অন্যান্য জেলায় এটি আবার ডেউ, ডেবু, ডেওয়া, ডেউয়া চাম বা বন কাঁঠাল নামেও পরিচিত। ডেবুর সংস্কৃতি নাম লকুচ।

Debu Fruit 1

ডেবু গাছ উচ্চতায় প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে। এটি ক্রান্তীয় চিরসবুজ প্রকৃতির এক ধরণের বৃক্ষ। এর পতা বড়, সরল, একান্তর ও বৃন্তযুক্ত। ডেবু আকৃতিতে গোলাকার হয় না। এর ত্বক অমসৃণ প্রকৃতির হয়।

ডেবু ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ বর্ণের হয়। ফল পাকলে হলুদ, কমলা, কমলা-লাল বা লালচে-কালো বর্ণ ধারণ করে। ফলের ভেতরের অংশ অনেকটা কাঁঠালের মতো। কাঁঠালের ভেতর যেমন কোষ থাকে ঠিক তেমনি ডেবুরও কোষ থাকে। এই কোষগুলো খেতে হয়।

কোষের মধ্যে দানা বা বীজ থাকে। বীজ দেখতে সাদা রঙের হয়। বীজগুলো দেখতে চীনা বাদামের মতো। এই বীজ ভেজে বা পুড়িয়েও খাওয়া যায়।

ডেবু কাঁচা অবস্থায় প্রচুর টক স্বাদের হয়ে থাকে। একারণে অনেকে ডেবু ভর্তা বা চাটনি করে খেয়ে থাকেন। ডেবু ফল রান্না করেও খাওয়া যায়। পাকা ডেবু টক-মিষ্টি বা মিষ্ট স্বাদযুক্ত হয়।

Debu Fruit 2

ডেবু ফলটি যে সুস্বাদু শুধু তাই নয় এর রয়েছে অনেক ভেষজ গুণ। ডেবুকে ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যালসিয়ামের আধার বলা হয়। এছাড়াও ভিটামিন ‘এ’, লৌহ, খনিজ, ক্যারোটিন ইত্যাদি পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ এই ডেবু ফল। ডেবু ছোট-বড় সবার মুখের রুচি বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। গ্রামের বাচ্চারা এই ফলটিকে খুব পছন্দ করে।

ডেবুর উপকারিতা সম্পর্র্কে পাইকগাছা উপজেলার শ্রীকণ্ঠপুর গ্রামের ভেষজ চিকিৎসক মো. আফায উদ্দীন বলেন, “ডেউয়া শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে সহায়তা করে। এক থেকে দেড় চামচ পরিমাণ ডেউয়ার রস ঠাণ্ডা পানিতে মিশিয়ে রোজ একবার করে এক মাস খেলে অতিরিক্ত মেদ থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া সম্ভব।”

এ ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, “এটি প্রচুর আঁশযুক্ত খাবার হওয়ায় আমাদের কোলনকে পরিষ্কার রাখে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।”

ব্রহ্মরাজপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. কফিল উদ্দীন বলেন, “ডেবু ফলটিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। গ্যাসট্রিকের রোগীদের জন্য খুব ভালো উপকারী ফল এটি। ডেবু স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সক্ষম।”

উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের তথ্য মতে, ‘ডেবুর বৈজ্ঞানিক নাম Antocarpus lakoocha। এটি Moraceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ। ডেবু উদ্ভিদের ফুল ও ফল ধারণ হয় এপ্রিল-জুন মাসে। এটি বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। ডেবু উদ্ভিদের কা-ের বাঁকল ফিতা কৃমি নাশক। বাঁকলের ক্বাথ মুখের ব্রণ, ত্বক ফাঁটা ও ক্ষত সারাতে ব্যবহৃত হয়। ডেবু উদ্ভিদের শিকড় থেকে এক প্রকার হলুদ রঙ নিষ্কাশন করা হয়। কোন কোন স্থানে ডেবুর বাঁকল পানের সাথে চিবিয়ে খাওয়া হয়।

Debu Fruit 3

ডেবু উদ্ভিদটি শহরে তো দেখাই যায় না। তবে গ্রামে কিছু কিছু স্থানে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের মানুষ উদ্ভিদটির উপকারিতা না জানার কারণে এটিকে কেটে ধ্বংস করছেন। মানুষের সচেতনতার অভাবে ডেবু গাছ আজ বিলুপ্তি পথে।

ব্রহ্মরাজপুর বাজারে ডেবু কিনতে পাওয়া যায়। এমনকি এই এলাকা থেকে ডেবু নিয়ে সাতক্ষীরা শহরে ভালো দামে বিক্রি করে অনেকে।

সাতক্ষীরা শহরের বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে, পোস্ট অফিস মোড়ে, থানা মসজিদের সামনেসহ বিভিন্ন জায়গায় ডেবু কিনতে পাওয়া যায়। শহরের বিভিন্ন স্থনে ডেবু বিক্রি করতে দেখা গেলেও কেনার লোক খুবই কম। এর একমাত্র কারণ শহরের অধিকাংশ মানুষ এই ফলটি সম্পর্কে জানেন না। ডেবুর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে তারা অবহিত না থাকার কারণে মানুষ এটিকে গুরুত্ব দেন না। ভালো বিক্রি না হওয়ার কারণে খুচরা ব্যবসায়ীরাও এই ফল বিক্রি করতে চায় না। ফলে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম ও শহর থেকে ডেবু নামক ফলটি।

তবে প্রচুর পুষ্টিকর ও ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় ডেবু পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম। এই উদ্ভিদটি সংরক্ষণে আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

happy wheels 2

Comments