একটি উষ্ণতর পৃথিবী এবং আমরা
সিলভানুস লামিন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বাংলাদেশ। দিনকে দিন এই ঝুঁকির হার বেড়েই চলেছে। এ বছর বাংলাদেশের উপকূলসহ বিভিন্ন জায়গায় (আমফান, বুলবুলসহ) ঘন ঘন ঘুর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা মৌসুমে পানি সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এ বছর উত্তরাঞ্চলসহ মধ্যাঞ্চল ও পশ্চিম-পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের তাপমাত্রার মধ্যেও তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। এখন বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের তাপমাত্রা ও ভাদ্র-আশ্বিন মাসের তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে। বন উজাড়, নদী দূষণসহ নানান মানবসৃষ্ট কর্মকা- জলবায়ু পরিবর্তনের এই হারকে আরও তরান্বিত করছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ এবং এমনকি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অপরিকল্পিত নগরায়ন, অবকাঠামো, পরিকাঠামো নির্মাণ, কৃষিতে সার-বিষ ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ব্বিধংসকারী কর্মকান্ড পরিচালনা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, বৃক্ষ নিধন ইত্যাদি বিষয়গুলো জলবায়ু পরিবর্তনের মূল ও প্রধান কারণ বলে মনে করেন। এসব অপরিকল্পিত অবকাঠামো, পরিকাঠামো, যান্ত্রিক উপাদান থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন গ্যাস নির্গত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, ধ্বংস ও দূষিত করছে মানুষকে, তার আবাসভূমি ও চাষাবাদ জমিকে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দশকে এই পরিবর্তন আরও চরম আকার ধারণ করবে। ফলশ্রুতিতে এই পৃথিবী মানুষসহ অন্যান্য প্রাণের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে।
জলবায়ুর এই পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যের মানও পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ খাদ্য উৎপাদনে তাপমাত্রা একটি অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান। এই তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করেই ফসল চাষাবাদ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা নির্ভর করছে। তাপমাত্রার অস্থিতিশীল আচরণের কারণে কৃষি ফসলের গুণাগুণ কমে যাবে এবং কৃষি শস্য ও ফসলের জাত বিলুপ্তি ঘটবে আশংকজনকভাবে। পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচকতার কারণে মানুষ যে খাদ্য খায়, যে পানি পান করে সেগুলো তাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করছে। প্রভাবগুলো বেশির ভাগই নেতিবাচক। জলবায়ু এই দ্রুততর পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীটা দিন দিন উষ্ণতর হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, একটি উষ্ণতর পৃথিবী হবে অপেক্ষাকৃত রোগাক্রান্ত ও অস্বাস্থ্যকর! অর্থ্যাৎ তাপমাত্রা যত বাড়বে পৃথিবীটা ততই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে।
জলবায়ুর এই পরিবর্তনের কারণে প্রাণী ও উদ্ভিদপ্রজাতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভূমিভিত্তিক ও সরীসৃপ প্রাণীগুলো বিশেষ করে পশুপাখি, মাছ তাদের বসবাসের জায়গা ও প্রতিবেশ পরিবর্তন হওয়ায় তারা ওই জায়গা বা প্রতিবেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছে। নতুন আশ্রয় খোঁজার সময়ে অসংখ্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়েগেছে পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে। এছাড়া বিশ্বের অনেক উদ্ভিদ প্রজাতিও বিলুপ্তির দিকে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ক্রমবর্ধমান হার গ্রীনল্যান্ড, এর্ন্টাটিকা ও আর্কটিকে বরফ গলে যাওয়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনকে দিন। ফলশ্রুতিতে সেখানকার প্রাণবৈচিত্র্যও লোপ পাচ্ছে! বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্বে প্রতি ১০ কিংবা ২০ বছর পর পর মহামারি ও বিশাল বন্যা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ নিকট অতীতে প্রতি ১০০ বছরের মধ্যে একবার এরকম বন্যা বা মহামারি হতো! মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মহামারী বা বন্যা হওয়ার সময়ের এই ‘ব্যবধান’ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।
জলবায়ুজনিত এই পরিবর্তনে সবচে’ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর বাসিন্দা। উন্নত বিশ্বে গ্রীন হাউজের মাধ্যমে বিভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ায় যেসব গ্যাস নির্গত হয় তা বায়ুমন্ডলের একটি স্তরকে ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলেছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এ স্তরটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিনকে দিন। ফলে সুর্যের ক্ষতিক্ষারক অতিবেগুণী রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠের আছড়ে পড়ছে। এ কারণে আগের তুলনায় এই পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই যতদিন যাবে এই পৃথিবী আরও উষ্ণ হবে, সৃষ্টি হবে নানান ধরনের দুর্যোগ ও আপদ।
আমাদের দেশ বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের প্রায় ৮০ ভাগ ভূমিই সমতল। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ বলে পরিচিত বাংলাদেশ আজ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ও আপদে সবচে’ বেশি বিদীর্ণ, সবচে’ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতিবছরই আমাদের এই প্রিয় দেশে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। একটি দুর্যোগ ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হতে না হতেই আরেকটি নতুন দুর্যোগ আঘাত হানে আমাদের এই মাতৃভূমি। বিশেষ করে এ দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষকে অহর্নিশ দুর্যোগের সাথেই বসবাস করতে হচ্ছে! এ বছর করোনার আড়ালে অনেকগুলো দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি খুব বেশি আলোচিত হয়নি। তারপরও আমফান এবং বন্যার সংবাদগুলো কমবেশি সবার চোখেই পড়েছে। এ দু’টি দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে পরবর্তী কয়েক মাসে আমরা টের পেয়েছি। প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত ক্ষতি তো আছেই! পাশাপাশি বন্যায় ধানসহ শাকসবজিও খেত ভেসে গেছে। তাই তো দেশের বাজারে শাকসবজির দামে আগুন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এই দেশটির ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব, দরিদ্রতা, মৌসুমী বায়ুর প্রভাব, আঞ্চলিক নদী প্রবাহ প্রণালী, মৌসুমে অতি বৃষ্টি ও শুষ্ক মৌসুমে খরা প্রভৃতি। এদেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থানের ওপর এই জলবায়ু গত পরিবর্তনের একটা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের জলবায়ুতে বর্ষার আধিক্য সবচেয়ে বেশি। ইন্টারনেট উন্মুক্ত উৎস থেকে পাওয়া একটি প্রতিবেদন মতে, প্রতিবছর ৯২% বর্ষার পানি বিভিন্ন নদী-নালা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। ফলে অতিবৃষ্টি এদেশের জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রণালী ও খাদ্যের নিশ্চয়তাকে প্রভাবিত করছে। আগামী ২০৩০ সালে ১১% এবং ২০৭০ সালে ২৭% মৌসুমী বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ সময়ে ভূ পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যথাক্রমে ১.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। এসব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, নিকট ভবিষ্যদে বাংলাদেশের বন্যা কবলিত এলাকার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। আবার জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী খরা। অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। দীর্ঘমেয়াদী খরা ও স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে নদীগুলোতে পানি প্রবাহ কমে যাবে। ফলে এলাকার কৃষি ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষকরা। দীর্ঘমেয়াদী খরার কারণে এলাকার প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হবে এবং নষ্ট হবে মানুষের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেঃমিঃ পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে উপকূলীয় এলাকায় অধিকাংশ বাঁধহীন এলাকা লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাবে। লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে। উপকূলীয় এলাকায় ড্রেনেইজ কাঠামো ও ভূমিক্ষয়ের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। সুপেয় ও লবণাক্ত পানির মিশ্রিত উৎসের পরিবর্তন ঘটবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এ পরিবর্তনের কারণে গঙ্গা নদীর প্রবাহ কমে যাবে। ফলে সুন্দরবনের উদ্ভিদের বংশগতির বৃদ্ধিকে বিপদসংকূল করে তুলবে এবং দিন দিন কমে যাবে বনের উদ্ভিদ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বনের প্রাণবৈচিত্র্য। আবার লবণাক্ততার কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, সাথে সাথে অধিকতর শক্তিশালী সাইক্লোন মানুষ তথা অবকাঠামোর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
ভূ-পৃষ্ঠকে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণ ও জীবের বসবাসপযোগী রাখার জন্য গ্রীনহাউজ প্রভাবের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এর মাত্রাধিক্যের ফলে প্রাথমিকভাবে বায়ুমন্ডল ও ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। সে কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হলে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাসের মতো নানান প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো ঘন বসতিপূর্ণ ও উন্নয়নশীল দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আইপিসিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী অব্যাহত গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমণ হ্রাস করা সম্ভব না হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বাড়বে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে এই পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হবে। ফলে নানান নানান রোগবালাইয়ের আর্বিভাব বাড়বে, মানুষসহ অন্যান্য প্রাণের স্বাস্থ্যহানি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। একটি উষ্ণতর পৃথিবী মানুষকে রোগাক্রান্ত করবে এবং বসবাসের পরিবেশকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলবে। তাই আসুন আমাদের অতি কার্বননির্ভর জীবন-জীবিকা বদলাই, এই পৃথিবীকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করে তুলি।
ফিচার ছবিটি ইন্টারনেট উন্মুক্ত উৎস থেকে সংগৃহীত