রোকেয়া বেগম এক সংগ্রামী মায়ের জীবনগাঁথা

মানিকগঞ্জ থেকে শুকুফে ইসলাম

৬২ বছর বয়সী এক নিরলস সংগ্রামী মা রোকেয়া বেগম। বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের বেতিলা গ্রামে। প্রায় ১৫ বছর ধরে বেতিলা বাজার সংলগ্ন মাঠের এক কোণে মুদির দোকান চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী-চিপস, চকোলেট, বাদাম ভাজা, কোমল পানীয়, চা, বিস্কুট, বিশেষত স্কুল ফেরত বাচ্চাদের নানা রকম মুখরোচক খাবার, খেলনা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রভৃতি তাঁর দোকানে বিক্রয় করা হয়। এই পেশায় কিভাবে যুক্ত হলেন, সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জানান, স্বামী হঠাৎ ফুসফুসের সমস্যাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে, সংসারের হাল ধরতে তিনি উদ্যোগী হন। একটি বেসরকারি সংস্থার আর্থিক সহায়তায় এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার যাত্রা শুরু করেন। ৩ মেয়ে ও এক ছেলে মোট ৪ সন্তানের গর্ভধারিণী হওয়া সত্ত্বেও জীবনের বাস্তবতা তাকে ছাড় দেয়নি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন আর একমাত্র ছেলে পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান হলেও, দুর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে বাড়িতে শয্যাশায়ী। রোকেয়া বেগম বলেন, ”এহন আমার মাথার উপরে ৯ জন মানুষ গো মা। পোলার ঘরের ২জন আর মেয়ের ঘরের ২জন নাতি-নাতকররে পড়াইতাছি।” ৮ জন সদস্যের এত বড় একটি পরিবারে সকল দায়িত্ব একা একা সামলাতে হিমশিম খেতে হলেও তেমন কোনো সহযোগিতা তিনি পান না কারোর কাছ থেকে। স্বামীহারা প্রবীণ এই নারী বলেন, “কত কইলাম একটা কাট কইরা দেও, কইরা দেও, কেও দিল না.. কইছিল মেম্বরে যে বিধবা ভাতা পামু, কিন্তু দেয় নাই।”

13118831_10202025605959064_383766152862752895_n-1

নিজস্ব কোন মূলধন না থাকায়, এখনও তাকে ঋণ করে দোকানের জিনিসপত্র কিনতে হয়। আর বিক্রি-বাট্টা শেষে যা থাকে, তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চালাতে হয় রোকেয়া বেগমকে। নাতি-নাতনীদের দেখাশোনা করা, তাদের পড়াশোনা চালানো, অসুস্থ ছেলের দেখভাল করা, সংসারের যাবতীয় চাহিদা একাধারে সামলিয়ে যাচ্ছেন এই কর্মনিষ্ঠ জননী। আবার, রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকান চালিয়ে রাতে বাড়ী থেকে খাবার খেয়ে দোকানেই ঘুমান তিনি। বলেন, “এই আমার সম্বল, এই নিয়া আমার বাঁচন। আইতে আইসে যদি কেও ভাইঙ্গে নিয়া যায়, তাই এক নাতি নিয়া এইহানেই ঘুমাসি।”

রোকেয়া বেগমের মতো অনেক মহিয়োসী মা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন আমাদের সমাজে। নিজে না খেয়ে, না পরে, অক্লান্তভাবে পরিবারের জন্য নিজেকে বিলীন করে যাচ্ছেন। কতটুকু মূল্যায়ন করছি আমরা তাদের এই নিস্বার্থ ভালোবাসার? আজ ৮ মে “বিশ্ব মা দিবস”। এই দিবসে বিশ্বব্যাপী মায়েদের বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। প্রতিটি সন্তানের জীবনে মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অবদানের কথা আজ ফলাও করে আলোচনা হয়। কিন্তু বিশ্ব মা দিবস পালন শেষ হলেই আমরা সবকিছু ভুলে যাই। মায়ের নিঃশর্ত ভালোবাসা আমরা ভুলে গেলে মায়েরা কখনও ভুলেন না। রোকেয়া বেগম সেটাই প্রমাণ করলেন। পরিবারের সব সদস্যরা যখন নিঃশব্দে সবকিছু ভুলে যায় মায়েরা কিন্তু ভুলেন না। রোকেয়া বেগম একা ৮ জনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর জীবনের এই অন্তিম সময়েও। তাকেসহ বাংলাদেশ ও সারাবিশ্বের মায়েদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিঃশর্ত ভালোবাসা দিয়ে আজও এই পৃথিবীকে যান্ত্রিকতা থেকে রক্ষা করে চলেছেন। তাই “বিশ্ব মা দিবস” নামক একটি দিনকে কেন্দ্র করে যেন এই মায়েদের প্রতি আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে না যায়। ভুলে না যাই তাদের দ্ব্যর্থহীন অবদানের কথা। প্রতিটি দিন যেন শুরু হয় মাকে নিয়েই।

happy wheels 2