সুন্দরবনের মধু আহরণ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
পাভেল পার্থ
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২ ভাগ এবং দেশের মোট বনভূমির ৪৪ ভাগজুড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সুন্দরবন। স্থানীয়ভাবে বাদাবন, প্যারাবন হিসেবে পরিচিত দুনিয়ার সবচে’ বড় এই ম্যানগ্রোভ বনকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বলেশ্বর, পশুরসহ প্রায় ৪৫০টি ছোট বড় নদ-নদীর প্লাবণভূমিতে গড়ে ওঠা এই বনের ৬০১৭ কি.মি এলাকায় ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৭৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির ঝিনুকসহ অগণিত প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে স্থানীয় বাওয়ালী-মৌয়াল-মাঝি-জেলে-চুনরি-মুন্ডা-মাহাতো জনগণ গড়ে তুলেছে এক ঐতিহাসিক স্থায়িত্বশীল বননির্ভর জীবন। সুন্দরবনের ৫১.৭% জুড়ে সুন্দরী, ২.৩৫% গরান, ৪.৯৫% গেওয়া এবং সুন্দরবনের মোট আয়তনের ১২.৫০ বর্গমাইল জুড়ে কেওড়ার বন।
সুন্দরবনের মধু বাংলাদেশের এক অনন্য ভৌগলিক নির্দেশনা। সুন্দরবনের মধু ও মোম আহরণের উপর নির্ভর করে পৃথিবীর একক আয়তনের সবচে’ বড় ম্যানগ্রোভ বনে গড়ে ওঠেছে মৌয়ালি নামের এক ঐতিহ্যগত বননির্ভর পেশা ও জীবন। বাংলা চৈত্র মাস থেকে শুরু হয় সুন্দরবনের মধু সংগ্রহের ঋতু। এ সময় বনবিভাগের স্থানীয় কার্যালয় থেকে স্থানীয় বনজীবীদের জন্য এক এক জনের জন্য একটি করে মধু কাটার পাশ এবং বনে প্রবেশের জন্য সাত থেকে নয় জনের একটি মৌয়াল দলের নৌকার জন্য একটি বিএলসি পাশ দেয়া হয়। উক্ত পাশ নেয়ার জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে বনজীবীদের পরিচয় ও চারিত্রিক সনদপত্র সংগ্রহ করে বনবিভাগের কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। সম্প্রতি যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র হয়েছে তারা পরিচয়পত্রের ফটোকপিও সংযুক্ত করে দেন। নৌকার মালিক বা দলের প্রধান যাকে সাজুনী বলে তার নামে বিএলসি পাশ দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর এক একটি দল বনবিভাগের স্থানীয় কার্যালয়ের আওতাধীন বন বিভাগ কর্তৃক চিহ্নিত ও অনুমোদিত বনের ভেতর থেকে মধু সংগ্রহ করে। মধু সংগ্রহের পর সংগৃহীত মধূ মহাজনের কাছে বা স্থানীয় খোলা বাজারে জমা দিতে হয় বা কম দামে পাইকারি বিক্রি করে দিতে হয়। মধু আহরণের ক্ষেত্রে বনজীবীরা বেশ কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলেন। বনবিভাগ পশ্চিম ও পূর্ব সুন্দরবন নামে সুন্দরবনকে দু’টি ভাগে ভাগ করেছে। সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের অন্তর্গত সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ও মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের বনজীবীদের সাথে ধারাবাহিক কাজের অভিজ্ঞতায় বর্তমান গবেষণাটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। এ সমীক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবনের মধু ও মধু আহরণের সাথে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ও বননির্ভর জনগোষ্ঠীর আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতাকে জনপ্রতিবেশ বিজ্ঞানের জায়গা থেকে পাঠ করা।
অভিজ্ঞ বনজীবীদের মতে, সুন্দরবনে তিন রকমের মৌমাছি দেখা যায়। এর ভেতর আগুনে মৌমাছিই (অঢ়রং ফড়ৎংধঃধ) বেশি চাক বানায় এবং এদের চাকের মধুই সুন্দরবনের সেরা মধু। লালচে আভার মিষ্টি স্বাদের এই মধুকে পদ্মমধু বলে এবং খলিশা ফুল থেকে এই মধু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা। বনজীবীদের মতে, এক ফোঁটা মধু সংগ্রহের জন্য একটি মৌমাছিকে প্রায় আশিটি ফুলে যেতে হয়। সুন্দরবনের মৌমাছিকে স্থানীয়রা পরিযায়ী মৌমাছি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমীর দিন মৌমাছিরা সুন্দরবনে চলে আসে। বনজীবীদের ধারণা এসব মৌমাছি মাঘ মাস থেকে সুন্দরবন এলাকায় আসতে শুরু করে এবং সুন্দরবনে তাদের মধুচক্রের সময়টা পাড় করে আষাঢ় মাসে আবার চলে যায়। বনজীবীরা বলেন, “ফুল ফোটার ঋতুকে মৌমাছিরা টের পায় এবং ঝাঁক বেঁধে ফুল ফোটার ঋতু মূলতঃ বসন্তকালে সুন্দরবনে চলে আসে।” বনজীবীদের মতে, একটি চাকে একজন রাণী মৌ পোকা থাকে এবং একে ঘিরে থাকে অনেক শ্রমিক মৌপোকা। শ্রমিক মৌপোকারা প্রতিদিন নতুন নতুন মধু উৎসের সন্ধানে যায়। চাকে ফেরার পর তারা উপর-নিচ, ডান-বাম নাচের মাধ্যমে চাক থেকে মধু উৎসের দূরত্ব চিহ্নিত করে। তবে প্রত্যেকে নমুনা মধু সাথে করে নিয়ে আসে। চাকের অপেক্ষাকৃত দায়িত্বপ্রাপ্ত মৌপোকারা সিদ্ধান্ত নেয় কোন মধু উৎস থেকে মধু সংগ্রহ করা হবে। মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক দূরত্বের পথ হলে মৌমাছি কাহিল হয়ে পড়ে, অনেকে মারা যায়, অনেকে দলছুট হয়ে যায়, অনেকে আবার অন্য চাকের অর্ন্তভূক্ত হয়ে পড়ে। মৌমাছির মধুগ্রন্থি যখন মধু রসে পূর্ণ থাকে তখন একে বনজীবীরা ‘ভারী পোকা’ বলে। ভারী পোকা তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে ওড়ে এবং ডানে-বামে না গিয়ে সোজা চাকের দিকে ওড়তে থাকে। মৌয়ালরা ভারী পোকার চলন এবং গতিপথ দেখে তার পেছন পেছন গিয়ে চাকের সন্ধান করেন।
জরায়ুজ অংকুরোদগম, শ্বাসমূলের উপস্থিতি, খাড়া লম্বা ঠেসমূল, লবণগ্রন্থি, রসালো পাতা, পাতায় পানি সংরক্ষণ কলার উপস্থিতি এরকম নানান হ্যালোফাইটিক বৈশিষ্ট্য ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদসমূহকে লবণাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার শক্তি তৈরি করেছে। ভিন্ন ভিন্ন আকার ও বৈশিষ্ট্যের শ্বাসমূল যেমন ম্যানগ্রোভ বনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তা মৌমাছিদের চাক বানানোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। জানা গাছের ছড়ানো ঝোপের মত শ্বাসমূলে অনেক সময় মৌমাছি চাক বানায়, কারণ এ গাছের শ্বাসমূল ঝোপ তৈরি করে যেখানকার পরিবেশ তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা থাকে এবং আড়াল থাকে। বনজীবীদের মতে, এমন পরিবেশই মৌমাছির বেশি পছন্দ।
সুন্দরবনের সকল প্রজাতির গাছে মৌমাছি চাক বানায় না। যেসব গাছে ৪৫০ থেকে ৯০০ কোণে গাছের লম্বা ডাল মাটি থেকে প্রায় কমপক্ষে ২-৩ হাত উপরে থাকে সেসব গাছের ডালে মৌমাছিদের চাক বেশি দেখা যায়। তবে অনেকসময় পানির উপর হেলে পড়া ডালেও চাক দেখা যায়, সেক্ষেত্রে জোয়ারের সময় অনেকক্ষেত্রে চাক ডুবে যায় এবং এতে চাক ও মৌপোকাদের ক্ষতি হয়। কাঁকড়া ও জানা গাছে মৌমাছি বেশি চাক বানায়। কারণ এসব গাছে তুলনামূলকভাবে হেলানো ডাল বেশি থাকে। পশুর, ঢালচাকা গাছেও চাকের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। অনেকসময় বয়স্ক গাছের খোড়লে চাক দেখা যায়। সেক্ষেত্রে চাকগুলো প্রায় গোলাকার ও আকৃতিতে ছোট হয়। পশুর ছাড়াও ধুন্দল ও কেওড়ার খোঁড়লেও চাক দেখা যায়। চান্দা ও সুন্দরী গাছে চাক খুব কম দেখা যায়। গোল গাছের ঝোপে এবং বন লেবুতেও চাকের সংখ্যা কম থাকে। কারণ এসব গাছে চাক বানানোর জন্য প্রশস্ত জায়গা থাকে না। বন লেবুর ডাল চিকন এবং গোলের ডাল পিচ্ছিল বলে এতে চাক খুব কম দেখা যায়।
সুন্দরী গাছের ফুলে পরাগরেণু বেশি হয়। এ গাছ থেকে মৌমাছি মধু রস সংগ্রহ না করলেও চাক রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই ফুলের রেণু সবচে’ বেশি সংগ্রহ করা হয় এ গাছের ফুল থেকেই। মধু চাকে জমা করার পর বাইরে যাতে না পড়ে যায় বা এতে যাতে জলীয়বাষ্প না জমা হয় তাই মৌমাছিরা পরাগরেণু দিয়ে মুখগুলো ঢেকে দেয়। একে বনজীবীরা গুটলি বলেন। সুন্দরী ও কেওড়া ফুলের গুটলি হলুদ রঙের। কেওড়া, বাইন ও গরানের গুটলি হলদেটে খয়েরি রঙের।
বৈশাখ মাসে সুন্দরবনের লতা জাতীয় গাছে ফুল ফোটে। জ্যৈষ্ঠে ফোটে বাইনের ফুল। এ মাসে ধুন্দুলের ফল ঝড়ে পড়ে ও অংকুরোদগম হয়। আষাঢ় মাসে গোলের ফল ঝরে পড়ে এবং আবার ফুল হয়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কেওড়া ফল ধরতে শুরু করে। অগ্রহায়ণে ধুন্দুলের ফুল পাওয়া যায়। ফাল্গুন মাসে গেওয়া ও পশুরের পাতা ঝড়ে যায় এবং গাছে নতুন পাতা দেখা দেয়। গেওয়ার ফুল শ্রাবণে হয় এবং ভাদ্রে ঝরে যায়। সুন্দরবনের প্রায় বৃক্ষের ফলই জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে পাকে এবং বীজসহ কাদা মাটিতে ঝড়ে পড়ে যায় এবং অংকুরোদগম হয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে সুন্দরবনে গাছের নতুন চারা জন্মে।
আনুভূমিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে সুন্দরবনকে তিনটি প্রধান স্তরে ভাগ করা যায়। বনের নিচু স্তর, মধ্যম স্তর ও উঁচু স্তর। মৌমাছি সাধারণত বনের মধ্যম ও উঁচু স্তর থেকেই মধু সংগ্রহ করে বেশি। সুন্দরবনের উদ্ভিদ প্রজাতি বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এখানে বৃক্ষের সংখ্যা বেশি এবং লতা-গুল্ম ও ঘাস জাতীয় তৃণের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। মৌমাছি মূলতঃ বৃক্ষের পরাগায়ণে বেশি ভূমিকা পালন করে। কারণ মৌমাছি মধ্যম ও উঁচু স্তরে বেশি বিচরণ করে এবং সুন্দরবনের অধিকাংশ বৃক্ষের ফুল এ দু’টি স্তরেই থাকে। মৌমাছি ফুলের পরাগ ও মধুরস খেয়ে বেঁচে থাকে। পাশাপাশি এ দু’টি স্তরে পাখি থাকে যারা মৌমাছিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। পাখি আবার সাপ ও বাঘের মতো প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এভাবে দেখা যায় উদ্ভিদ-মৌমাছি-সাপ-বাঘ এরকম একটি জটিল খাদ্যচক্র সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থানকে ঠিক রাখে।
সুন্দরবনের সরগরম মধু মৌসুম চৈত্র থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। এসময় খলিশার মধু বেশি পাওয়া যায়। তারপর গেওয়ার মধু এবং পরবর্তীতে বাইন, কেওড়ার মধু পাওয়া যায়। আগে মহাজন থেকে লালগেতি ধান নিয়ে এক একটি মৌয়াল দল মধু কাটতে যেত তারপর সব মধু এনে মহাজনের জিম্মায় দিয়ে দিতে হত। মহাজন তাদের নৌকা, বাড়ির খরচ এবং মধুর কিছু দাম দিয়ে দিতেন। ১৯৭৫ সনে এক সের মদুর দাম ছিল ৩৯ টাকা, ১৯৮৫ সনে ৭০ টাকা, বর্তমানে মৌয়ালরা প্রতি কেজি খলিশার মধু ১২০-১৫০ টাকা করে বিক্রি করলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এক কেজি মধু ৩০০ টাকা করে বিক্রি করেন।
মধু আহরণ ঋতুতে যখন বাড়ির পুরুষেরা বনে থাকে তখন বাড়ির নারীদের নানান নিয়ম পালন করতে হয়। তারা এ সময় বাড়ির বাইরে খুব একটা দূরের এলাকায় যান না। নারীরা এ সময় মাথায় তেল-সাবান ব্যবহার করেন না, চুলায় মরিচ পোড়ান না। গোসল করার পর গামছা নিংড়ে পানি ফেলা যায় না। বাড়িতে ভোরবেলা রান্না করা হয় এবং সন্ধ্যায় রান্না করা হয়। এ সময় নারীরা দুপুরবেলা কোনোভাবেই চুলায় আগুন জ্বালান না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন বাড়িতে এ সময় আগুন ধরালে বন এবং মধুর চাকের ক্ষতি হবে। মধু কাটার মাসে মৌয়ালিরা কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ করেন না, এ সময় মিথ্যা বলা ও কোনো ধরনের অন্যায় আচরণ থেকে সকলেই বিরত থাকার চেষ্টা করেন।
মধু সংগ্রহের সময় মৌয়ালিরা বেশ কিছু নিয়ম পালন করেন। একটি মৌয়াল দলের সকলেই দল প্রধান বা সাজুনীর দিকনির্দশনা মেনে চলেন। দলের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কর্মবিভাগ আছে। প্রথমে তারা পূর্বঅভিজ্ঞতা অনুযায়ী বা মৌমাছির গতিপথ দেখে বনের কিনারে নৌকা রেখে বনের ভেতর চাকের সন্ধান করেন। চাক খোঁজার সময় মৌয়ালদের দৃষ্টিটা উপরের দিকে থাকে বলে মৌয়ালরাই বাঘের আক্রমণের শিকার হন সবচে’ বেশি। চাক খুঁজে পাওয়ার পর হেন্তালপাতা দিয়ে কারু বানানো হয়। এতে ধোঁয়া তৈরি হয়। ধোঁয়া দিয়ে প্রথমে চাক থেকে মৌমাছিদের তাড়ানো হয়। মৌয়ালদের সকলের মুখ তখন মৌমাছির হুল থেকে বাঁচার জন্য ঢাকা থাকে। তারপর ধারালো দা দিয়ে চাকের কেবলমাত্র মধুর অংশটুকু কাটা হয়। চাকের যে অংশে বাচ্চা ও মৌপোকারা থাকে তাদেরকে রেখে দেয়া হয়। কাঁচা গাবের রসের প্রলেপ দেয়া বেতের তৈরি ঝুড়িতে মধু নেয়া হয়। মধু ঝরা শেষ হলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা হয়। আবার চাকে মৌমাছিগুলো ফেরত আসতে থাকে। ফেরার সময় কারুটি পানিতে ডুবিয়ে নিভিয়ে দেয়া হয়। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা মিষ্টি পানিতে হাত পরিষ্কার করে হাতে চেপে চেপে মধু বের করা হয় এবং বড় মুখের পাত্রে মধু সংরক্ষণ করা হয় যাতে মধুুর জলীয়বাষ্প উড়ে চলে যায়।
সুন্দরবনে বাংলা চৈত্র মাসের ১৮ তারিখ থেকে মধু সংগ্রহের পাশ দেয় বনবিভাগ। কিন্তু বনজীবীদের মতে, ঋতুগত পরিবর্তন এবং ফুলের প্রস্ফুটনকাল এগিয়ে আসায় বর্তমানে এই পাশ আরো এগিয়ে এনে ৭-১০ চৈত্রের ভেতর করা উচিত। কারণ সময়মত মধু সংগ্রহ না করতে পারলে চাকের ভেতর মধু খাবার হিসেবে জমা থাকে এবং মধু সংগ্রহের প্রয়োজন না থাকায় মৌমাছিরা অলস হয়ে পড়ে এবং চাকের মধ্যে বসে থাকে। এভাবে সুন্দরবনের ভেতর প্রাকৃতিক পরাগায়ণের পরিমাণ কমে যায় যা পরবর্তী সময়ে বনে ফুলের পরিমাণ কমে যায়। এটি মধু সংগ্রহকারীদের জন্যও সমস্যা। কারণ মধুর পরিমাণ কমে যাওয়ায় মৌয়ালিদের জীবন জীবিকাতেও এর সরাসরি প্রভাব তৈরি হয়। পাশাপাশি মৌয়ালরা দাবি করেছেন, ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত মাছ ও কাঁকড়া সংগ্রহের পাশ দেয়া যাবে না, যদি দিতে হয় তবে বনবিভাগকে খুব সর্তক থাকতে হবে তারা যেন মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাশ নিয়ে মধু কেটে না আনে।
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরাগায়ণ এবং মূলতঃ উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধির জন্য মৌমাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ বনজীবীরা মনে করেন সঠিক পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহের ফলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হয় না বরং তা সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্যের বিকাশ ও বনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক নিয়মে এবং ঋতুতে মধু সংগ্রহ না করলে প্রাকৃতিক পরাগায়ণ কমে বনের বাস্তুসংস্থানে সমস্যা তৈরি করবে বলে তাদের অভিমত। তবে অনেকে মধু সংগ্রহের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মনীতি মেনে চলে না। তারা পুরো চাক কেটে ফেলে। অনেকে চাকে আগুন দেয় তাতে বাচ্চা মৌপোকারা মারা যায়। অনেকে মধু কাটার নাম করে বনের গাছ কেটে ফেলে। অনেকসময় চাক বানানোর হেলে পড়া ডালগুলো কেটে ফেলে অনেকেই যা সার্বিকভাবে কেবলমাত্র মৌমাছি নয় বনজীবীদের জীবনকেই নিরাপত্তাহীন করে তুলে।
কেওড়া ও বাইন গাছ থেকে ঝরে পড়া ফল নদীর পাঙ্গাশ মাছের প্রিয় খাদ্য। যদি সুন্দরবনে ব্যাপক পরিমাণে মৌমাছিদের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরাগায়ণ না হয় তবে কেওড়া ফুলের পরিামাণ কমে যায়। কেওড়া সুন্দরবনের হরিণের খাবার। হরিণ আবার বাঘের খাবার। নদীতে যখন কেওড়া ঝরে পড়ে তখন পাঙ্গাশ মাছ তা খায় এবং তাতে পাঙ্গাশের ওজন ও আকার বেড়ে যায়। এটি সুন্দরবনের জেলেদের জন্য আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। কারণ তখন জেলেরা নদী থেকে বেশি মাছ ধরতে পারেন এবং বিক্রি করে দামও তুলনামূলকভাবে বেশি পান। একটি ঘটনায় দেখা গেছে ২০০৯ সনে কেওড়ার ফুল ফোটার মওসুমে তাপমাত্রার তারতম্য অনেক বেশি ছিল এবং গরম বেশি ছিল এবং বৃষ্টি ছিল না। এ আবহাওয়া মৌমাছিদের জন্যও বেশ সমস্যাজনক ছিল। ফলে পরাগায়ণ যেমন কম হয়েছে তেমনি শুষ্কতা ও বৃষ্টিহীনতার ফলে কেওড়া গুটি ঝরে পড়েছিল। এ ঘটনাটি সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল স্থানীয় জেলেদের জীবনে। কারণ সেসময় নদীর পাঙ্গাশ কেওড়া খেতে পারেনি। তাদের ওজন এবং আকারও ছোট ছিল। বাজারে পাঙ্গাশও কম পাওয়া গিয়েছিল। ফলে জেলে পরিবারগুলো এক কঠিন সময় পাড়ি দেয়। সুন্দরবনের আবহাওয়াগত পরিবর্তনের বিষয়টি বনজীবীরা টের পান। তারা বলেন, “ঋতু বদল ঘটছে এবং বৈচিত্র্য কমে এসেছে। পানির লবণাক্ততা বাড়ছে এবং তাপমাত্র বেড়ে গেছে। বৃষ্টিপাত কমে গেছে।” আবহাওয়াগত এ পরিবর্তনের ফলে বনজীবীদের ধারণা বিগত দু’বছরে সুন্দরবনের মৌমাছিদের আচরণগত পরিবর্তনও ঘটেছে। গত দু’বছরে মৌমাছিরা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষিপ্র ও হিংস্র আচরণ দেখিয়েছে। এতে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বনজীবীদের মৌমাছির কামড় বেশি খেতে হয়েছে। তবে সিডর এবং আইলার পর সাতক্ষীরা রেঞ্জে মধুর পরিমাণ কমে যায়নি বলে বনজীবীরা মন্তব্য করেন।
১৯০৩ সনে ডেভিস প্রেইন সুন্দরবন মানচিত্রের যে বর্ণনা দেন সেখান থেকে দেখা যায় সুন্দরবনের বিস্তৃৃতি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে হুগলীর পশ্চিমপ্রান্ত এবং গঙ্গার পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত। অবিভক্ত বাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, খুলনা ও বাখেরগঞ্জ নিয়ে ছিল সুন্দরবনের বিস্তৃতি। কিন্তু দিনে দিনে সুন্দরবনের এলাকা কমে যাচ্ছে এবং আশেপাশে নদ-নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্যের বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক অংকুরোদগম হওয়ার মত সুন্দরবনের চরে আগের মত ঘাস ও ধনচে ঘাস জন্মাচ্ছে না। এসব ঘাস না থাকলে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা ফল ও বীজগুলো আটকে রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সুন্দরবনে প্রাকৃতিক অংকৃরোদগম কমে যাচ্ছে। প্রজাতিবৈচিত্র্য এবং বনভূমির প্রাকৃতিক স্তরবিন্যাস নষ্ট হয়ে অধিকাংশ এলাকাতেই একক প্রজাতির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ, কুমীরসহ অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর বিচরণএলাকা ও খাদ্যচক্র ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় এলাকায় কৃষিকে বাদ দিয়ে বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের করাতে এককালের কৃষকেরা কৃষিউদ্বাস্তু হয়ে সুন্দরবনে বৈধ কি অবৈধ উপায়ে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করছে। একটি মৌপোকা মারলে ৫০ টাকা জরিমানা দেয়ার বিধান থাকলেও বনবিভাগ গুরুত্বপূর্ণ বনআইনগুলো মৌয়ালদের জানাচ্ছে না। কিন্তু এরকম আইনের মারপ্যাচে আবার নিরীহ বনজীবীদের নামে নানান সময়ে মিথ্যা বনমামলাও দেয়া হচ্ছে। বনবিভাগ প্রতিবছর কেবলমাত্র মৌমাছিদের সংরক্ষণের জন্য বনের বেশ কিছু এলাকাকে মৌ-অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করলেও সেখানে কোনো সাইনবোর্ড বা অন্য কিছু দিয়ে সীমানা নির্দিষ্ট না করাতে বনজীবীরা জেনে না জেনে অনেকসময় সেই মৌ-অভরারণ্যে প্রবেশ করে। আবার জানা গেছে, বনবিভাগের একদল দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা মৌ-অভরারণ্য থেকে মধু সংগ্রহ করার অন্যদের দিয়ে। সুন্দরবনের মধু সংগ্রহের আরেকটি প্রধান সমস্যা জলদস্যু ও ডাকাত। নিরীহ বনজীবীদেরকে যারা জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয়। এছাড়া আরেকটি বিষয় হলো যে, নতুন প্রজন্ম সুন্দরবন এলাকায় বেড়ে ওঠছে তাদের অনেকেরই ঐতিহ্যগত মধু সংগ্রহের জ্ঞান ও পদ্ধতিগুলো জানা নেই। জীবনের প্রয়োজনে আজ এরা বাধ্য মধু সংগ্রহ করতে কিন্তু তাদের অজ্ঞতার ফলে মধু সংগ্রহের কারণে মধুর চাক ও বনের যেমন ক্ষতি হয় তারাও বাঘের আক্রমণে মারা যান সবচে বেশি এবং তাদের সংগৃহীত মধুর মান ও দামও অনেক কমে যায়। কারণ তাতে ময়লা ও জলীয়বাষ্প বেশি থাকে।
বনবিভাগ প্রতিটি বনজ সম্পদের জন্য একটি নিজস্ব কোড ব্যবহার করে। সুন্দরবনের মধু আহরণের কোড হল ২৩৪৬। ২০ কেজির অধিক মধু এলাকা থেকে বৈধ উপায়ে স্থানান্তর বা পরিবহন বা বিক্রির জন্য বনবিভাগ থেকে পরিবহন অনুমতিপত্র নিতে হয়। এই ট্রানজিট পারমিট ছাড়া মধু অবৈধ বনজ সম্পদ হিসেবে বন আইনে আটক করার ব্যবস্থা আছে। বনবিভাগের এরকম অনেক ইতিবাচক আইন ও নীতিমালা এবং বন্যপ্রাণী আইন ২০১০ এসব কিছু বনজীবীদের মধু জীবনকে নিশ্চিত না করতে পারলেও এসব আইনের ভালো দিকগুলো ব্যবহার ও প্রয়োগের কোনো উদ্যোগ স্থানীয় বনবিভাগের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। পাশাপাশি বন আইন ১৯২৭ সকলের অংশগ্রহণে সংশোধন করার দাবি ওঠেছে। বনজীবীদের ন্যায্য মধু বাজার, সুন্দরবনের মধুকে নিয়ে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, জাতীয় বাজেটে সুন্দরবনের মধুকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ, বনজীবীদের বনঅধিকারের আইনগত স্বীকৃতির বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার প্রস্তাব উক্ত সমীক্ষায় ওঠে এসেছে। উক্ত সমীক্ষা থেকে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, সুন্দরবনের সকল প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে স্থানীয় বননির্ভর জনগণের এক জটিল আন্তনির্ভরশীল আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। এদের একটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে অন্যটিও সমস্যার সম্মুখীন হয়। এরা সকলেই একই বাস্তুসংস্থানচক্রের সদস্য। এখানে সঠিক লোকায়ত নিয়মে মধু সংগ্রহ করলে বনভূমির কোনো ক্ষতি হয় না, বরং এটি বনভূমির প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনারই একটি অংশ হিসেবে দেখেন বনজীবীরা। পাশাপাশি এই সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে বনজীবীরা জমা করেন বিপুল রাজস্ব, যা দিয়ে তৈরি হয় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট এবং জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচি। একটু পরোক্ষভাবে বলতে গেলে বলতে হবে সুন্দরবনের মৌমাছি ও মৌয়ালিরা এক জটিল প্রতিবেশীয় সহাবস্থানের ভেতর দিয়ে এখনও বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন।