সাম্প্রতিক পোস্ট

একজন মা একটি গল্প

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
আমরা সবাই জানি, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। এই চিরন্তন সত্যি কথাটি আমরা সকলে জানলেও আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই ব্যর্থ হই নিজের পরিবারের সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে। দেশে অর্থে-বিত্তে বলিয়ান অনেক পরিবার রয়েছে যাদের অর্থ-সম্পদের কোন অভাব নেই, কিন্তু তাদের অনেকেই নিজ সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ। আবার গ্রামাঞ্চলে অনেক পরিবার রয়েছে, যারা আর্থিকভাবে অনেক দূর্বল। সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক কষ্টেও তারা সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছেন। সন্তানদের গড়ে তুলেছেন প্রথিতযশা ব্যক্তিতে। এমনই কত অজানা জীবনের সফল গল্পইনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের আনাচে কানাচে। নীরবে জীবনের সফলতার গল্প তৈরি করে দেশের উন্নয়নের পাটাতনকে করছেন মজবুত। এমনই একজন সফল নারীর গল্প তুলে ধরার সাহস করছি আমার আজকের লেখনির মাধ্যমে যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর তার ছোট ছোট দু’টি মেয়েকে অনেক চরাই উতরাই পার করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সফল হয়েছেন।


নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার বালি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সাধারণ গৃহিনী হাজেরা বেগম (৬৫)। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হাজেরা বেগম কোন রকমে তৃত্বীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়শুনা করেছেন। পড়াশুনার প্রচন্ড আগ্রহ থাকলেও পিতা-মাতার সংসারের অভাব অনটনের জন্য আর পড়াশুনা করতে পারেননি। দরিদ্র মা-বাবা তাকে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে দেয় (বাল্যবিয়ে) নিজ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের আব্দুর রহমান’র সাথে। স্বামীর পরিবারও দরিদ্র হওয়ায় সেখানেও অভাব তার পিছু ছাড়েনি। অভাব অনটনের সংসারে তিনি পর পর দু’টি মেয়ে সন্তানের মা হয়েছেন। স্বামীর সম্পত্তি বলতে বাড়িভিটাসহ মাত্র ৪০ শতাংশ জমি ছিল। নিজেদের জমি ছাড়াও তারা অন্যের জমি বর্গা চাষ করে যে ফসল ফলায় সে আয় দিয়ে চার সদস্যের সংসার অতি কষ্টে হলেও চলছিল। ছোট দুই মেয়েকে রেখে স্বামী আব্দুর রহমান মারা গেলে সমস্যা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে হাজেরার কষ্ট আরও দ্বিগুণ হয়। হাজেরা বেগম দুই মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন।


দুই মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে শুরু হয় হাজেরা বেগম এর দ্বিতীয় ধাপের জীবনযুদ্ধ। তিনি মনোবল না হারিয়ে অন্যের হাসঁ-মুরগি ও গরু-ছাগল বর্গা পালন করে এবং অন্যের জমি বর্গা নিয়ে শাক সবজি ও ধান চাষ করতে আরম্ভ করেন। আরম্ভ করেন বছরব্যাপী সবজি চাষ, বসতভিটার চারপাশে শীতকালীন সবজি, যেমন-মিষ্টিকুমড়া, ৩ জাতের লাউ, ৮ জাতের শিম, ২ জাতের বরবটি, ৫ জাতের আলু কীটনাশকমুক্ত চাষ করেন এবং এসবের বীজ নিজে সংরক্ষণ করে রাখেন। সংক্ষিত বীজ তিনি নিজ গ্রাম ছাড়াও অন্য গ্রামের নারীদের মাধ্যে বিতরণ করেন। সবজি চাষ এবং পাড়া-প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় দুই মেয়েকে নিয়ে কোন রকমে সংসার চলতে থাকে। এ অবস্থাতেও সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে তিনি ভুলেননি। নিজে সামান্য লেখাপড়া জানলেও শিক্ষার প্রতি ছিল তার বেশ কদর। সন্তানদের পড়াশুনা ও সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেলেও তিনি কখনো হতাশ হননি। অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেও তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েননি, সদা মনোবল রেখেছেন দৃঢ়। এই অভাবের মধ্যে দুই মেয়েও মায়ের স্বপ্ন পূরণে সদা থেকেছে সচেষ্ট।
তাঁর বড় মেয়ে নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে অনার্সসহ মাষ্টার্স সম্পন্ন করে নেত্রকোনা ইসলামী ব্যাংকে চাকুরি করছেন। বিয়ে হয়েছে নেত্রকোনা ইসলামী ব্যাংকে’র এক কর্মকর্তার সাথে। ছোট মেয়ে নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে অনার্সসহ মাষ্টার্স সম্পন্ন করে চাকরির খোঁজ করছেন। হাজেরা বেগম’র স্বপ্ন ছিল সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। সে স্বপ্ন আজ তার সফল হয়েছে। দু’টি মেয়েই অনার্সসহ মাষ্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছে। মেয়েগুলোও অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন এবং গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় আলাদা। হাজেরা বেগম দুই মেয়েকে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের অন্যান্য কাজও শিখিয়েছেন। হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন করে মেয়েদের ইউনিফর্ম, কলেজে যাতায়াতের খরচ, পরীক্ষা ফি, বই, খাতা, কলম ইত্যাদি কিনে দিয়েছেন।


সমাজের অন্যরা যেখানে মেয়েদেও বেশি পড়াশুনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি, হাজেরা বেগম সেখানে মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতি জোড় দিয়েছেন। মন্দ লোকদের থেকে মেয়েদের সব সময় আগলে রেখেছেন। কারো কথায় তিনি কখনো বিচলিত হননি। পরিবারের অন্যরা কখনো কখনো বিচলিত হলেও তিনি তাদের বুঝিয়েছেন। হাজেরা বেগমের কথা, ‘ধানের চারা রোপণ করেছি, চারা বড় হবে, আর চারার বড় হওয়ার জন্য পানি ও সার দিতে হয়ে। ফলনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তেমনি আমি আমার মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কুলে, স্কুল থেকে কলেজে পাঠিয়েছি। কষ্ট করে তাদের খরচ যুগিয়েছি, তাদের লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কষ্ট করেছি। আজ মেয়ে দু’জনই অনার্সসহ মাষ্টার্স পাশ করেছে। আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। মেয়ে দু’জনকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরেছি।


হাজেরা বেগম আরও বলেন, ‘আমার সহায় সম্পদ কম থাকলেও মনে অনেক সাহস রয়েছে, সবাই বলে তোর মেয়েদের বিয়ে দিসনা কেন? মেয়েদের কলেজে পড়াই বলে আমার বাড়ির সবাই হাসা-হাসি করত, সবাই অপমান করত বিয়ে দেইনা বলে। আজ আমি গর্ববোধ করি দু’জন মেয়ের জন্য, তারা মানুষের মত মানুষ হয়েছে। এখন আমার বড় মেয়ে নেত্রকোনা ইসলামী ব্যাংকে চাকুরি করে, ছোট মেয়ে বেসরকারি প্রথিমিক বিদ্যালয়ে চাকরির পাশাপাশি গ্রামের অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের গণিত প্রাইভেট পড়ায়। দুই মেয়ের সহায়তা ও নিজের চেষ্টায় হাজেরা বেগম একটি পাকা ইটের বাড়ি (বিল্ডিং ঘর) তৈরি করেছি। নিজের পরিশ্রমের টাকায় ১০ শতাংশ জমি কিনেছি।’ হাজেরা বেগমের শুধুমাত্র ছোট একটা ঘর ছিল, এখন একটা বড় পাকা ইটের বাড়ি হয়েছে। অর্থ সম্পদ না থাকলে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি ভালোভাবেই সংসার চালিয়েছেন। মেয়েরাও মাকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে এজন্য যে, মায়ের তেমন পড়াশুনা না থাকার পরও তাদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষ করেছেন। গ্রামের সকলেই এখন হাজেরা বেগমের দেখাদেখি তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। গ্রামের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরা এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা হাজেরা বেগমকে জেঠিমা বলে ডাকে, এতে তার খুব আনন্দ হয় ও মন ভরে যায়। হাজেরা মনে করেন, সকল মেয়েদেরকে ছেলেদের মত পড়াশুনা করার দরকার আছে, প্রত্যেক মা-বাবার কাছে ছেলে-মেয়ে উভয়ই সমান হওয়া উচিত। হাজেরা বেগম পরিবেশ সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন। তিনি বাড়িতে জ¦ালানি সাশ্রয়ী চুলা ব্যবহার করেন এবং গ্রামের অন্যদেরও জ¦ালানি সাশ্রয়ী চুলার উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলা ব্যবহারের পরামর্শ দেন।


হাজেরা বেগম একজন অনুপ্রেরণাময়ী মা। হাজেরা বেগম এর মত উদ্যোগী মায়ের পক্ষেই সম্ভব অসম্ভবকে সম্ভব করা। এমন স্থিরমনা নারীর পক্ষেই সম্ভব চিরদিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে। প্রতিটি গ্রামে ও পরিবারে তাই তার মত উদ্যোগী নারী প্রয়োজন। হাজেরা বেগম এর মত সকল পরিবারের নারীরা তাদের মেয়ে সন্তানদেরকে পড়াশুনা করিয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে এগিয়ে আসলেই দেশের সকল গ্রামের মেয়েরা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে পরিবার ও সমাজের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। আর দেশ পরিণত হবে স্বপ্নের দেশে।

happy wheels 2

Comments