জয়ীতা জয়ী কপোতি ঘাগ্রা’র জীবনের গল্প

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা:
কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের নলছাপ্রা গ্রামে বাস করেন কপোতী ঘাগ্রা। পেশায় একজন শিক্ষীকা। শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য র্অজন কারী শ্রেষ্ট জয়িতা হিসেবে এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে জয়ীতা নির্বাচিত হয়েছেন। জীবনের অনেক চড়াই উৎড়াই পারি দিয়ে আজ একটা অবস্থানে নিজেকে দাড় করাতে পেরেছেন। নিজেকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসার পিছনে রয়েছে অনেক বড় একটি গল্প। সেই গল্পটিই সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে বারসিক নিউজডটকম এর পক্ষ থেকে গুঞ্জন রেমা।
ছেলেবেলার হাসি কান্না আনন্দ বেদনা বিজরিত অনেক স্মৃতি মনের মাঝে দোলা দেয় । অসহায় হয়ে বেড়ে উঠার তিক্ত স্মৃতি আমার মনকে তাড়িয়ে বেড়ায় । মধ্যবৃত্ত পরিবারেই আমার জন্ম। আমরা ৮ ভাই বোন, ৩ ভাই ও ৫ বোনের মাঝে আমি তৃতীয় সন্তান। আমার ছোট ২ ভাই ও ৩ বোন যতদূর মনে পরে শিশুশ্রেণী হতে ২য় শ্রেণী পর্যন্ত আমি নলছাপ্রা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করি । ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণী বালুচরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি। ১৯৮৮ বিরিশিরি মিশন বালিকা হোস্টেলে থাকার সুযোগ মিলেছিল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। বিরিশিরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বারের মত আমি চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলাম দ্বিতীয় বার চর্থুত শ্রেণীতে পড়ার অর্থ হলো ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বালুচরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যাালয়ে চতুর্থ শ্রেনীতে ছিলাম গ্রামের বাড়ি পালিয়ে আসার ব্যর্থ চেস্টাও করেছিলাম বহুবার । কারন মায়ের কথা মনে হলেই আমার চোখে পানি আসত। আমার মা অনেক সময়ই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তেন আর সেসময়গুলোতে তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যও মাকে নেওয়া হয়েছিল। স্কুলের হোস্টেলে থাকবার সময় প্রায় ৩/৪/ মাস হয়ে গেছে আমাকে বাবা আর দেখতে যায়না আর তারপরই জানলাম বাবা আর আমাদের পরিবারে নেই অন্যত্র চলে গিয়েছেন । মা আর বাবার বিচ্ছিনতা আমাদের দারুণভাবে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। বাবার এই নিষ্ঠুরতম দায়িত্বহীন কর্মে আমি মানসিক ভাবে অসহায় হয়ে পরেছিলাম । কিন্তু মনে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে স্বপ্ন বুনেছিলাম ।

আমাকে মানুষের মত মানুষ হতেই হবে। ১৯৯০ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় আমি ৭ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করি। অনেক অভাব অনটন সংকটাপন্ন সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে লেখা পড়ার সময়ে । কে শুনবে আমার অভাব অভিযোগ সমুহ বাবা থেকেও নেই আর মা থেকেও না থাকার সমতুল্য ্কারণ মনসিক ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি । আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে নতুন বছরে পুনরায় বোডিং এ যাই তখন আমার নিকট আত্বীয় স্বজনেরা সম্মিলিত ভাবে ৩০ কেজি চাল সংগ্রহ করে হোস্টেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহযোগীতা করেছিলেন, আজও সেই স্মৃতি মনে পড়ে আর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে উঠে। সেই দু:সময়ে আমার মামা সুবোধ চন্দ্র ঘাগ্রা (প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক নলচাপ্রা উচ্চবিদ্যালয়) আমার পাশে দাড়িয়েছিলেন পরম মমতায় । প্রায়ই তিনি প্রয়োজনীয় বই খাতা তেল সাবান ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপকরন হোস্টেলে পৌছে দিতেন । পড়া লেখার বিষয়েও খোঁজ খবর নিতেন । ১৯৯৫ সালে এসএসসি পাশ করলাম ১ম ভিবাগে । আমার নানা দাদু বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন । আমাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রবল মনের ইচ্ছা ছিলো তাদের কিন্তু উপায় কি? কলেজে পড়াশুনা করার প্রবল ইচ্ছ্া আমার কিন্তু ব্যয়ভার বহন করতে পারবে তেমন কেউ নেই । সেসময় আমার নিকট আত্মীয়া (অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা) সাবেত্রী ঘাগ্রা দিদির সহযোগীতায় কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য ওর্য়াল্ড ভিশন অপিস ও ওয়াই,এম,সি এ অফিস হতে অর্থ সংগ্রহ করি আবেদন দিয়ে । সংগৃহিত টাকা দিয়ে সাবিত্রী দিদির সহযোগীতায় কলেজে ভর্তি হলাম ময়মনসিংহ মহিলা কলেজ । ময়মনসিংহ পরিবার উন্নয়ন প্রকল্প ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের অফিসে খন্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ দেয়ার জন্য লিখিত আবেদন করি । ১১৯ জন পরিক্ষার্থীর মাঝেও আমার এই খন্ডকালীন চাকুরি হয়ে গেলো। প্রতিদিন বিকাল ৪ টা হতে বিকাল ৬ টা র্পযন্ত ময়মনসিংহ পাঠগুদাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গরীব শিশুদের শিক্ষা সেবা দিয়ে আমার কলেজে পড়ার ব্যয়ভার হয়ে গেলো।


জীবনে বহু ঘাতপ্রতিঘাত চরাই উৎরাই পার করে আমার অবস্থার রুপ পাল্টাতে চেস্টা করেছি । আমার ভাই বোন সবাইকে আমার সাধ্য মত টেনে তুলতে চেস্টা করেছি । সব সময় জীবনে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন মনের রং তুলিতে একেছিঁ । কলেজের অধ্যাপিকা হব স্বপ্নে দেখেছিলাম কিন্তু সব স্বপ্ন বাস্তব রুপে প্রকাশিত হতে নাও পারে। তাই মেনে নিয়েছি। এখন আমি কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের নলচাপ্রা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি । আমার স্বপ্ন র্দশনে আমি সাফল্যের অনেক আনন্দঘন মুহুর্ত পেয়েছি । জীবনে উন্নতি ও সফলতার প্রধান মাধ্যমই হলো কঠোর পরিশ্রম, সাধনা এবং ধৈর্য্য অনিবার্য ।
নেত্রকোনা কলমাকান্দা উপজেলা প্রশাশন ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার যৌথ আয়োজনে গত ৯ ডিসেম্বর ২০২০ বেগম রোকেয়া দিবস ও আর্ন্তজাতীক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে বেগম রোকেয়া দিবসে শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ট জয়িতা হিসেবে আমাকে সংর্বধনা সহ ক্রেস্ট প্রদান করায় আমি খুবই আনন্দিত । আমার ৪১ বছর বয়সে এই সম্মানন্ প্রদান করায় নিজেকে গর্বিত মনে করছি । উপজেলা পর্যায়ে এবং জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে আমাকে সম্মাননা প্রদান করায় আমি উপজেলা মহিলা বিষয়ক ও জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের র্কমর্কতা সহ উপজেলা এবং জেলা প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি । জয়িতা সম্মাননা প্রাপ্তি আমার জীবনের নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে বলে আমি মনে করি । এতে আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেলো। আমি পিছিয়ে পড়া নারী যারা মনের দুঃখ কষ্ট অত্যাচার সহ্য করে নিরবে চোখের জল ফেলে দিন কাটাচ্ছে তাদের প্রতি জন্য কাজ করে যাব। এ আমার অঙ্গিকার।
কপোতি ঘাগ্রার শখ বই পড়া, গানশুনা এবং গান গাওয়া। তিনি বিশ্বাস করেন সংস্কৃতি র্চচা ও লালন করা সভ্যতা ও সমাজ বিকাশের একটি বড় কাজ। ব্যক্তিজীবনে ২০০২ তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এক ছেলে, মেয়ে ও স্মামী নিয়ে তাদের সংসার চলে আনন্দে আর সংগ্রামে।

happy wheels 2