দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মুজিবুর রহমানের উদ্যোগ

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

সকল পেশার মানুষকে নিয়েই তো আমাদের এই সমাজ। সকলের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শ্রম ও ঘাম দিয়ে এই আধুনিক সভ্যতায় পৌছেছে আমাদের এই সমাজ। যে সমাজে বাস করে কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, হরিজন, ঋষি, মাঝি, কবিরাজ, প্রবীণ, যুব, ভিন্নভাবে সক্ষম (প্রতিবন্ধী) জনগোষ্ঠী, হাজারো প্রাণসম্পদসহ সকল উদ্ভিদ। মানুষসহ সকল প্রাণ শতশত বছর ধরে টিকে পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতার উপর ভিত্তি করে। তাই সকলের স্থায়িত্বশীল জীবনযাপন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন পরস্পর পরস্পরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা এবং পরস্পরের জীবনধারাকে চলমান রাখতে সহযোগিতা করা। একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য যেমন শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তি সবদিক থেকে সুস্থ মানুষসহ সকল প্রাণের সুষম অংশগ্রহণ প্রয়োজন তেমনি ভিন্নভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠীর (প্রতিবন্ধি) অংশগ্রহণও জরুরি। প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরাও সুযোগ পেলে সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

20180710_102358-W600
নেত্রকোনা সদর উপজেলা মদনপুর ইউনিয়নের সাজিউড়া গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া এমনই একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মুজিবুর রহমান। পড়ালেখায় প্রবল আগ্রহ থাকলেও প্রতিবন্ধি হওয়ায় মা-বাবা তার পড়ালেখায় কোন মনোযোগ দেয়নি। বেশিরভাগ সময় তাকে কৃষি কাজে যুক্ত রাখা হত। মা-বাবা, ভাই-বোনের নিকট তার ইচ্ছা কখনো মূল্যায়িত হয়নি। তার ইচ্ছার অমূল্যায়ন তাকে এখনও খুব পীড়া দেয়। ১২ বছর বযস থেকে তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করে অর্থ উর্পাজন করেন সেই অর্থে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পড়াশুনা ক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে বেশ সহযোগিতা করেন। বেশ কৃতিত্বের সাথে ৫ম শ্রেণী পাশ করেন এবং টেলেন্টপুলে বৃত্তি পান। অষ্টম শ্রেণীতেও তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৯৯০ সালে এএসসি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৯২ সালে এইচএসসি পাশ করেন। নিজে প্রতিবন্ধি হওয়ায় তিনি প্রতিবন্ধিদের সমস্যা সহজেই বুঝতে পারেন, তাই তিনি সবসময় প্রতিবন্ধিদের জন্য কিছু করার কথা ভাবেন। কোথাও প্রতিবন্ধি শিশুর খবর পেলেই তিনি সেখানে যান এবং অভিভাবকদের সাথে কথা বলে তাদের পড়াশুনা করতে স্কুলে পাঠাতে বলেন। তাদেরকে দিয়ে ভিক্ষা করানো ও মানুষের বাড়িতে কাজে না দেয়ার পরামর্শ দেন। প্রতিবন্ধি শিশুদেরও যে সমাজে ভালোভাবে বাঁচার অধিকার আছে, তাদেরও যে সমাজকে অনেক কিছু দেয়ার আছে তা তিনি সকলকে বোঝান।

মুজিবুর রহমান ১৯৯৭ সালে গ্রামে নিজ উদ্যোগে ‘পল্লী দৃষ্টিহীন উন্নয়ন সংগঠন’ নামে একটি প্রতিবন্ধি সংগঠন গড়ে তোলেন। পরর্তীতে ২০০০ সালে তিনি একটি প্রতিবন্ধি স্কুল স্থাপন করেন। স্কুলে পরিচালক মুজিবুর রহমান নিজে। প্রতিবন্ধি শিশুদেরদের স্কুলে আসা যাওয়া জন্য ২টি সিএনজি কিনেছেন। কেন্দুয়া, নেত্রকানা সদর ও আটপাড়া থেকে ৪০ জন প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী দু’টি সিএনজিতে করে স্কুলে আসেন। মুজিবুর রহমানের স্কুলে চার ধরনের প্রতিবন্ধি শিশু (বাক, শ্রবণ, দৃষ্টি ও অটিজম) লেখাপড়া করে। প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে গানের টিচার, রয়েছে প্রতি সপ্তাহে একদিন বিনোদনের ব্যবস্থা (গান, হারমুনিয়াম ও তবলা বাজানো শেখা)। টিফিনের সময় বিভিন্ন ধরণের পুতুল, খেলানা গাড়ি, অন্যান্য খেলনা খেলারও ব্যবস্থা রেখেছেন। স্কুলে রয়েছে ৫ জন শিক্ষিকা ও ৪ জন শিক্ষক, যারা প্রতিবন্ধি শিশুদের শিক্ষাদানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। শুধু প্রতিবন্ধি শিশুদের শিক্ষাই নয়, মুজিবুর রহমান প্রতিবন্ধি শিশুদের নিয়ে তিনি পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ রোপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। চলতি মৌসুমে প্রতিবন্ধি স্কুলের উদ্যোগে তিনি স্কুল ক্যাম্পাসে ১০০টি ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছেন।

happy wheels 2

Comments