আলোর পথে প্রতিবন্ধী গোলাম হোসেন

সাতক্ষীরা থেকে চম্পা রানী মল্লিক

প্রতিবন্ধী হয়েও সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আলোর মুখ দেখলেন গোলাম হোসেন। প্রতিবন্ধীরা যে সমাজের বোঝা নয় এটি শারীরিকভাবে অক্ষম গোলাম হোসেনের উদ্যোগগুলো দেখে তা সহজেই বোঝা যায়। গোলাম হোসেন (৩৬)।পিতার বাহাদুর তরফদার (৬০) ও মা রিজিয়া খাতুন (৪৯)। তাদের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মিরগাং গ্রামে। গোলাম হোসেনেরা চার ভাই ও দুই বোন। তিনি ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। আর ভাই বোনদের জন্ম গোলাম হোসেনের জন্মের দুই বছর পর পর । ১৬ শতক ভিটার উপরই ছিল তাদের বসবাস। তাছাড়া বাইরে চাষযোগ্য কোন জমি তাদের ছিলো না। গোলাম হোসেনের পিতা দিনমুজুরি কাজ ও অন্যের জমি ভাগে নিয়ে সবজি ও ধান চাষ করতেন। এভাবে কোন রকমে চলতো তাদের সংসারটা।

গোলাম হোসেনের বয়স যখন ৩ বছর তখন অন্য সব বাচ্চাদের মতো তিনিও হাঁটতেন, খেলতেন ও আনন্দ করতেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন দোলনায় ঘুমন্ত অবস্থায় গোলাম হোসেন উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে। কাছে গিয়ে তার মা তাকে কোলে নিতেই দেখলো তার গায়ে প্রচন্ড জ্বর এবং কিছুতেই কান্না থামছেনা। একপর্যায়ে যখন কোল থেকে নামাতে গেল, তখন দেখলো গোলাম হোসেনের দুটি পা বেঁকে যাচ্ছে। ভয়ে তার বাবা, মা, দাদি তাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। দেখে শুনে ডাক্তার তাদের জানায় পোলিও রোগের কারণে গোলাম হোসেনের দুটি পা অচল হয়ে গেছে এবং বলেন আর কিছু করার নেই। কারণ সে সময় পোলিও টিকা ছিল না। আর তাই সেদিনের সেই করুণ আর্তনাদ আর অক্লান্ত চেষ্টার কোন শুভফল তারা পায়নি।

১

এভাবে বড় হতে থাকে গোলাম হোসেন। আর তার বাবা মা ও দুশ্চিন্তায় থাকে, কি হবে এই সন্তানের উপায় তা নিয়ে। গোলাম হোসেনের ছোট থেকেই লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহ দেখে তার পিতামাতা এবং পাশের আরো কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বলে একটি প্রাইভেট মাস্টার ঠিক করে বাড়িতে পড়ানোর জন্যে। চলতে থাকলো তার পড়াশুনা এবং সেই সাথে ভর্তি করে দিল তার পরের ভাইটিকেও। এরপর গোলাম হোসেন যখন তার অন্যসব সঙ্গীদের মতো স্কুলে ভর্তি হতে চাইলো, তখন তার বাবা মার চিন্তা আরো বেড়ে গেল। কি হবে, কিভাবে প্রতিদিন সে স্কুলে যাবে, তাছাড়া কাঁচা রাস্তা, বৃষ্টির দিনগুলোতে ্কি করবে এসব নিয়ে। গোলাম হোসেন কোন কিছু শুনতে রাজি নয়। তাই তারা তাকে ভর্তি করে দিল। কাঁচা রাস্তা ধরে হাতের উপর ভর করে সারাটি পথ খুব কষ্ট করে স্কুলে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন গোলাম হোসেন। কিন্তু যখন বর্ষাকাল শুরু হয়, তখন তিনি আর স্কুলে যেতে পারতেন না। এভাবে তিনি পড়াশুনা থেকে অনেক পিছিয়ে যেতে থাকেন। তাই তার বাবা মা গোলাম হোসেনকে বুঝালেন এভাবে পিছাতে থাকলে তোমার শিক্ষকরা তোমার প্রতি কোন খেয়াল করবেন না এবং তোমার পড়াশুনাও ভালো হবে না। তাই তুমি আর একটি বছর বাড়িতে পড়াশুনা করো তাহলে তোমার ছোট ভাইয়ের সাথে তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেব। তাহলে সে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে এবং নিয়ে আসতে পারবে এতে আমাদের দুশ্চিন্তাটাও কম হবে।

গোলাম হোসেন সব কিছু মেনে নিলেন। কিন্তু তিনি অনেক কষ্ট পেল এই ভেবে যে, দু’টি পায়ের কারণে তিনি তার জুটিদের হারিয়ে ফেলছেন। তবুও সব কষ্ট মেনে নিয়ে তিনি বাড়িতে পড়াশুনা করতে থাকেন। শেষ হলো একটি বছর। তারপর তার বাবা মা, দুই ভাইকে ভর্তি করে দেন। দুজন একসাথে যাওয়া আসা করে। আর যখন বড় ভাই যেতে না পারে, তখন তার ছোট ভাই পড়া দেখিয়ে দেয়। এভাবে বছর দুই পরে তার বাবা অনেক কষ্ট করে একটি পুরানো সাইকেল কিনে দেন। সাইকেল পেয়ে গোলাম হোসেনের ছোট ভাই দ্রূত সাইকেল চালানো শিখে নেয়। তারপর তারা দুই ভাই একসাথে স্কুলে সাইকেলে যাওয়া আসা করতে থাকেন। বাড়ি থেকে তাদের বাবা মা উঠিয়ে দিতেন এবং স্কুলে তারা তাদের কোন না কোন বন্ধুদের সহায়তা নিতেন নামার জন্যে। তাদের দুই ভাইকে শিক্ষকরা খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু গোলাম হোসেন অসুস্থ থাকায় কিছুদিন স্কুলে অনুপস্থিত ছিলেন। ততদিনে ওই স্কুলে একজন নতুন শিক্ষক যোগদান করেছিলেন যিনি যানতেন না গোলাম হোসেনের কোন সমস্যার কথা। প্রতিদিনের ন্যায় তিনি গোলাম হোসেনদের রুমে ক্লাস নিতে যান। রুমে ঢুকতেই সকল ছাত্র-ছাত্রী তাকে সম্মান জানাতে দাঁড়িয়ে উঠে। গোলাম হোসেন প্রতিদিন এই সময়টা খুব কষ্ট পেত। কারণ তিনি দাঁড়াতে পারতেন না বলে।

সেদিন তার নতুন স্যার দেখলেন, সবাই দাঁড়ানো কিন্তু একজন বসা, আর সেই ব্যক্তি হলো গোলাম হোসেন। তিনি অপমানিত করার অপরাধে, গোলাম হোসেনকে লাঠি দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করেন। তখন গোলাম হোসেন নিজেও জানতো না তাকে কি জন্যে এত আঘাত করা হচ্ছে। কিন্তু মারতে মারতে একপর্যায়ে যখন তার স্যার বললেন, ‘তোর এত বড় সাহস যে তুই দাঁড়াস না। তখন গোলাম হোসেন সহ তার সকল সহপাঠীরা কারণ টা বুঝতে পারলো। তখন গোলাম হোসেন উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতার কষ্টে, কিন্তু কিছুই বলেনি,নিজেকে শাস্তি দিতে, এটা তার প্রাপ্য মনে করে। ভয়ে সবাই চুপচাপ। মার বন্ধ করে স্যার যখন ক্লাস করবেন, এরই মাঝে তার ছোট ভাই স্যারকে বললেন, ‘আমার ভাইয়াতো দাঁড়াতে পারেনা স্যার, ওরতো পায়ের সমস্যা। একথা শুনে তিনি তার কাছে গিয়ে দেখলেন, সত্যিই তার দু’টি পা অকেজো, তা দেখে তীব্র অনুশোচনায় হাতের বই ফেলে দিয়ে গোলাম হোসেনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। ২

গোলাম হোসেনের পড়াশুনা চলতে থাকে। কিন্তু অভাব তাদেরকে যেন কিছুতেই ছাড়ছিলো না। বই, খাতা, কলম একটা না একটা সমস্যা থাকতোই। তাই তার ছোট ভাই যোগাযোগ করলো এক মাছ ব্যবসায়ীর সাথে। সে রোজ তার বড় ভাইকে স্কুলে রেখে চলে যেত মাছ কেনা বেচার ব্যবসায় এবং তার আসার সময় পর্যন্ত যদি দু-একটা ক্লাস বাঁকি থাকতো তাহলে সেই ক্লাসগুলো করে ভাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরতো। এভাবে চলতে থাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। কিন্তু এভাবে তার ছোট ভাইও পড়াশুনা থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে। তারপর সে পুরোপুরি মাছ ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে, এবং পড়াশুনোও বন্ধ করে দেয় এই ভেবে যে, কেউ না কেউ সংসারের হাল না ধরলে অন্য ভাই বোনেরা ও অভাবের কারণে পড়াশুনা করতে পারবে না। কিন্তু তার সাথে সাথে আগের সমস্যাগুলোয় আবারও জড়িয়ে পড়ে গোলাম হোসেন। তাই তারও পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনি খুব ভেঙে পড়েন, ভাবেন কি হবে তাকে দিয়ে। তবে সে বরাবরই বাড়িতে থেকে যেটুকু পারতো বাবা মায়ের হাতের কাজে সহযোগিতা করতেন।

৩

গোলাম হোসেন তাদের গ্রামে ছোট বাচ্চা যারা এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি, তাদের পড়ানো শুরু করেন। তিনি এসব ছেলেমেয়েদের পড়াতে থাকেন এবং একটি আয়ের উৎস খুঁজে পান। এছাড়া তিনি ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও একটি প্রতিবন্ধী কার্ড লাভ করেন। ছেলে মেয়ে পড়ানো টাকা এবং প্রতিবন্ধী কার্ড থেকে যে টাকা পেতেন তা থেকে তার বাবা মার প্রয়োজনে দিতেন এবং বাকিটা জমিয়ে রাখতেন। মোটামুটি চলছিল তাদের সংসারটা। কিন্তু অন্যরাও ছেলেমেয়ে পড়ানো শুরু করে দিলে গোলাম হোসেনের পড়ানোতে যে আয় হতো সেটাও প্রায় বন্ধ হলো। উপায় খোজার এক পর্যায়ে তিনি দোকান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গোলাম হোসেন তার জমানো কিছু টাকা এবং পরিবারের কিছু টাকা নিয়ে শুরু করলেন দোকান দেওয়ার। অনেক কষ্টে একটি দোকান তৈরি করে এবং কিছু মালামালও ক্রয় করেন। তাতেই দোকানটি ভালোভাবে চলতে থাকে। কিন্তু ভাগ্যের কি করুণ পরিণতি! মাসখানেকের মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ “আইলা”। সবকিছুর সাথে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তার সেই শখের দোকানটিও। কিন্তু গোলাম হোসেন হাল ছাড়েননি, ঠিকমতো টাকা না পেলেও এখনো ছেলে মেয়ে পড়িয়ে চলেছে এবং আজও স্বপ্ন দেখেন কিছু টাকা জমিয়ে আবারও তৈরি করবেন তার বেঁচে থাকার অবলম্বন সেই দোকান ঘরটি।

শারীরিক প্রতিবন্ধী গোলাম গোসেন সমাজের বোঝা না হয়ে নিজেই বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম করে চলেছেন সেটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষণীয় আধেয়। সমাজের জন্য কিছু করার প্রবল ইচ্ছাশক্তি আছে তাঁর। আমাদের সমাজের প্রতিবন্ধী মানুষদের মনের ইচ্ছা, শক্তি ও সাহসকে কাজে লাগাতে পারলে সমাজের জন্য তারা সম্পদে পরিণত হবে।

happy wheels 2

Comments