কৃষকের বীজ ব্যাংক পরিদর্শন করলেন ১৫টি সংগঠনের প্রতিনিধি
মানিকগঞ্জ থেকে কৃষিবিদ মো. জিল্লূর রহমান
এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন এলাকার ১৫টি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিগণ সম্প্রতি মানিকগঞ্জ জেলার বরুন্ডী গ্রামে কৃষক পরিচালিত বীজ ব্যাংক ও বোরো মৌসুমে এলাকা উপযোগী ধানেরর জাত নির্বাচন কার্যক্রম বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিদর্শন ও পারস্পারিক তথ্য অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এ সময় বরুন্ডী গ্রামের ২৫ জন কৃষক-কৃষাণী এই কাজে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বীজের সমস্যা সমাধানে মানিকগঞ্জ এলাকার কৃষকরা একত্রিত হয়ে কৃষক বীজ ব্যাংক, এলাকা উপযোগি ফসলের জাত বাছাই, কৃষি উপকরণের জন্য বাজার নির্ভরশীলতা কমানো, জৈবকৃষি চর্চা প্রভৃতি বিষয়ে প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এছাড়াও কৃষি ও কৃষকের সমস্যা সমাধানে কৃষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিভিন্ন কার্যক্রম ও ক্রর্মপ্রক্রিয়া তুলে ধনের কৃষক সংগঠনের সভাপতি বৈদ্যনাথ সরকার।
বরুন্ডী কৃষক বীজ ব্যাংক
অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে অংশগ্রহণকারীরা প্রথমে বরুন্ডী কৃষক বীজ ব্যাংক পরিদর্শন করেন। কৃষক বীজ ব্যাংকে ১৫২ জাতের ধান বীজ, ৫৯ জাতের শাকসবজি, মসলা, ডাল, তৈল, পাট ও অন্যান্য ফসলের বীজ ও ৫ ধরনের জৈব বালাইনাশক তৈরি ও ব্যবহার বিষয়ক তথ্য সহভাগিতা করেন কৃষকরা। এসময় বীজ ব্যাংকের বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি, বীজ ব্যাংক তৈরি, বীজ বিনিময়, বীজ ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, বীজের সজীবতা রক্ষা, বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ, বাজরজাতকরণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কৃষকরা আলোচনা করেন। এই প্রসঙ্গে বীজ ব্যাংকের সদস্য বৈদ্যনাথ সরকার, ‘‘কৃষক সংগঠন এবং বীজ ব্যাংক আমরা নিজেদের প্রয়োজনেই তৈরি করেছি। কেননা বাজারের বীজ কিনে আমরা নানাভাবে প্রতারিত হয়েছি, কিন্তু আমাদের নিকট যেসব বীজ আছে তা যে কোনসময় ব্যবহার করতে পারি, বীজের মান সম্পর্কে আমাদের জানা থাকে, বাজার থেকে ক্রয় করতে হয় না, একই জায়গা থেকে বীজ পাওয়া যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলে পুনবায় বীজ সংগ্রহ করা যায়।” তিনি বলেন, “বীজ ব্যাংক তৈরির যাবতীয় অর্থ আমরা নিজেরাই যোগান দিয়েছি। বীজ ব্যাংকের ঘর তৈরির ক্ষেত্রে বারসিক আমাদের কিছুটা সহযোগিতা করেছে।” বীজ ব্যাংক পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুশীল রায় বলেন, “সব ধরনের বীজ প্রতি মৌসুমেই একাধিক কৃষক বীজ ব্যাংক থেকে নিয়ে যান আবার ফসল উঠার পরে জমা দিয়ে যান। বীজ সমস্যা সমাধানে এটি একটি আপদকালীন ব্যবস্থা।” তিনি আরও বলেন, “কৃষকরা তাদের নিজ বাড়িতেই বীজ রাখবেন কিন্তু কোন সমস্যা হলে যেন সে এখান থেকে বীজ নিতে পারেন। প্রতি চাষীই চাষকৃত ফসলের বীজ নিজের বাড়িতে সংরক্ষণ করেন এবং কিছু অংশ বীজ ব্যাংকে বিনিময়ের জন্য প্রদান করেন। এভাবে সব কৃষক প্রতি মৌসুমে মানসম্মত বীজ ব্যবহার করতে সক্ষম হন।”
ধান জাত গবেষণা
মানিকগঞ্জ এলাকায় সাধারণত আমন ও বোরো মৗসুমে ধান চাষ হয়। এলাকার ধান চাষে প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা, অসময়ে বন্যা, খরা, রোগবালাই ও পোমাকড়ের আক্রমণ, মানসম্মত বীজের অভাব, উৎপাদন খরচ ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানে গ্রামের কৃষকরা এলাকা উপযোগি ধানের জাত বাছাই করার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধানের বীজ সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। সে লক্ষ্যে বোরো মৌসুমে ৩৬টি জাত নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এলাকার কৃষকরা ইতোমধ্যে আমন ও বোরো মৌসুমের ৮টি জাতকে প্রাথমিকভাবে এলাকার কৃষকদের জন্য উপযোগী জাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জাতগুলো হলো-কাইশ্যাবিন্নি, মকবুল, রাজভোগ, বেগুনবিচি, চিনিগুড়া, আমশাইল, মোল্লাদিঘা ও হিজলদিঘা। এ বিষয়ে কৃষক গোসাই দাস বলেন, “আমাদের এলাকায় চাষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন স্থানীয় ধানের বীজ আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করি। এগুলো সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে চাষ করা হয় এবং পরিপক্কতা আসলে মাঠ দিবসের মাধ্যমে কৃষকরা ধান জাত নির্বাচন করেন।” তিনি আরও বলেন, “পরবর্তী মৌসুমে আগ্রহী কৃষকরা ক্ষুদ্র পরিসরে তার নিজস্ব জমিতে চাষ করে বীজের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন। পরবর্তীতে সেই বীজ তিনি এলাকার অন্য কৃষকদের সহযোগিতা করে এলাকার কৃষকদেও কাছে উপযোগি বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে।” এছাড়া সংকরায়নের মাধ্যমে ধানের জাত উন্নয়নে এলাকার অনেক কৃষক সম্পৃক্ত রয়েছে বলে তিনি জানান। জাত উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত কৃষক পংকজ রায় পরিদর্শনকারী দলের কাছে সংকরায়নের মাধ্যমে ধানের জাত উন্নয়ন বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
কৃষক সংগঠনের সভাপতি বৈদ্যনাথ সরকার সংগঠনের অন্যান্য কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি কৃষি ছাড়াও অবকাঠামো তৈরি, শিক্ষা, চিকিৎসা বিষয়ে আলোকপাত করেন। এছাড়াও অংশগ্রহণকারীরা এ প্রক্রিয়ার জাত গবেষণা ও বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষকদের অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর আয়োজন করার উপর গুরুত্ব্ারোপ করেন।