বন অধিকার আইন প্রণয়ন করা হোক

পাভেল পার্থ

বান্দরবানের মিজো জনগণ নিজেদের বনপাহাড়ের সন্তান মনে করেন। মিজো ভাষায় মি মানে মানুষ আর জো মানে পাহাড়। শালবনভূমির আদি বাসিন্দা মান্দি পুরাণ মতে, ঈশ্বর দুনিয়ায় পয়লা সৃষ্টি করেছেন বন। বনজংলার সাথে ঐতিহাসিকভাবেই এই জনপদের এই গভীর গোপন সম্পর্ক আছে। মহাভারতে আছে, দেবতা অগ্নির ক্ষুধামান্দ্য হলে খান্ডববন আগুন বাণ মেরে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এক ময়দানব ছাড়া আর কেউ বেঁচে থাকে না ঐ বনের। মহাভারতের কাল শেষ হয়ে গেলেও আমরা দেখছি এখনও বনবিভাগের ক্ষুধামান্দ্য শেষ হয়ে যায়নি। আর তাই একটির পর একটি মুমূর্ষু শীর্ণকায় বনের টুকরাও আর আস্ত রাখে না কেউ। সব বিক্রি হয়ে যায়। দেশে বিদ্যমান ক্ষয়িষ্ণু প্রাকৃতিক বনভূমির কোনো কোনো নির্দিষ্ট অংশকে জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, গেম রিজার্ভ, রক্ষিত বন, সংরক্ষিত বন নাম দিয়ে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা তৈরির যেমন রেওয়াজ আছে তেমনি প্রাকৃতিক বনভূমিতেই প্রশ্নহীনভাবে গড়ে তোলা হয় নানান সামরিক বেসামরিক স্থাপনা, খনন ও প্রকল্প। অথচ দেশে বন সংরক্ষণের জন্য আইন আছে নীতিমালা আছে, যার কোনোটিকেই এসব ক্ষেত্রে আমলে নেয়া হয় না।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ)(সংশোধন) আদেশ ১৯৭৪ এর ২নং অনুচ্ছেদ এর জ ধারা অনুযায়ী ‘জাতীয় উদ্যান’ মানে হল, মনোরম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবিশিষ্ট অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর এলাকা যার মূখ্য উদ্দেশ্য প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর চিত্রানুগ দৃশ্য, উদ্ভিদকুল রক্ষা এবং সংরক্ষণ করা এবং যেখানে বিনোদন, শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য জনসাধারণের প্রবেশ অনুমতি দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় বিস্তৃত মৌলভীবাজার রেঞ্জের ২,৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৯৬ সালে ঘোষণা করা হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ১৯৬২ সনেই টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ)(সংশোধন) আদেশ ১৯৭৪ এর ১নং অনুচ্ছেদের ধারা বলে জাতীয় উদ্যানের ভেতর কোনো বিস্ফোরক পোঁতা এবং গর্ত খোঁড়া বা খনন নিষিদ্ধ। কিন্তু এই আইন এবং জনগণের আপত্তিকে বিবেচনায় না এনে দেশের ১৪ নং মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মার্কিন কর্পোরেট তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরন লাউয়াছড়ার বনতল এলোপাথারি পরিস্কার করে হাজার হাজার বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

বন আইনের (১৯২৭) ২৬নং ধারা অনুযায়ী বন বিপদাপন্ন হতে পারে এমন কিছু বনের ভেতর রেখে যাওয়া আইনত: দন্ডনীয় অপরাধ। একই ধারা বলে কোনো সংরক্ষিত বনের কোন অংশ নতুনভাবে পরিষ্কার করাও আইনত: দন্ডনীয় অপরাধ। রাষ্ট্রীয় বন আইনকে অগ্রাহ্য করে মধুপুর শালবনের ভেতর তৈরি করা হয়েছে বিমান বাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ। বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২ ভাগ এবং দেশের মোট বনভূমির ৪৪ ভাগ জুড়ে সুন্দরবন। স্থানীয়ভাবে বাদাবন, প্যারাবন হিসেবে পরিচিত দুনিয়ার সবচে’ বড় এই ম্যানগ্রোভ বনকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ২১ মে ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে দেশের প্রথম রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে সুন্দরবনে কর্পোরেট কোম্পানি শেলকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কক্সবাজার চকরিয়া প্যারাবন নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের তৈরি করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমির অধিকাংশ অংশ নিশ্চিহ্নকরণের ক্ষেত্রে সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা ও অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াই দায়ী।

আন্তর্জাতিক রামসার সনদের (১৯৭১) ৩নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, চুক্তিবদ্ধ কোনো রাষ্ট্র যদি তালিকাভূক্ত জলাভূমির সীমানা সংকুচিত করে ফেলে তবে উক্ত রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে জলাভূমির সম্পদের যে কোনো ক্ষতির যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণ করা বিশেষত একই স্থানে বা অন্য কোথাও জলচর পাখির মূল আবাস্থলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণজুড়ে জলচর পাখির জন্য অতিরিক্ত প্রাকৃতিক অঞ্চল গড়ে তোলা। বাংলাদেশ রামসার সনদ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরকে দেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা ঘোষণা করলেও হাওর এলাকার জলাবনের প্রতি এখনও পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় মনোযোগ তৈরি হয়নি। বরং প্রশ্নহীনভাবে হাওর এলাকার জলাবনকে কেটে কেটে তুলে দেয়া হয়েছে কাগজ তৈরির মন্ড কারখানায়।

১৯৭৩ সালে গৃহীত বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির বাণিজ্য সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ (Convention on International Trade in Endangered Species of wild fauna and flora/CITES) অনুযায়ী যেসকল প্রাণবৈচিত্র্য এই সনদের অর্ন্তভূক্ত সেসবের কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আজো বাংলাদেশে নিশ্চিত করা হয়নি। প্রাকৃতিক বনভূমি থেকে এখনও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও প্রাণীর যে বিশাল চোরাচালান ঘটে তা বন্ধ করার মতো কোনো রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা আজো তৈরি করা হয়নি। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক বনের সংরক্ষণ ও গুরুত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করলেও, বাংলাদেশে বন সংশ্লিষ্ট কিছু আইন ও নীতি বহাল থাকলেও প্রাকৃতিক বনভূমির গুরুত্ব আমরা রাষ্ট্রের তথাকথিত মূলধারার উন্নয়ন উদ্যোগ বা বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে তেমন একটা দেখতে পাই না।

দেশে বিদ্যমান বন আইন (১৯২৭) এর শরীরে যে উপনিবেশিক কর্তৃত্ব রয়ে গেছে তা ঘষা মাজা করার চেয়ে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বন ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের জন্য একেবারেই নতুন করে জনআইন করা দরকার। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ)(সংশোধন) আদেশ ১৯৭৪ বনের সাথে আদিবাসীসহ অনেক পেশাগত জনগণের সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক জীবিকাগত ঐতিহাসিক সম্পর্ককে অস্বীকার করেছে। সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০০০ যা ইতোমধ্যে আদিবাসী ও পরিবেশবাদীদের তীব্র সমালোচনার কবলে রয়েছে, সেখানে বন বিভাগ কর্তৃক নির্দেশিত আগ্রাসী গাছের বাগান করার জন্যই কেবলমাত্র উপকারভোগী নির্বাচনের কথা আছে। এমনকি ‘বনজ সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালে’ বননির্ভর বনজীবী জনগণের বনঅধিকারের বিষয়গুলোকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। উক্ত ম্যানুয়াল অনুযায়ী সুন্দরবনে প্রতিবছর মধু মোম গোলপাতা গরান মাছ আহরণের জন্য যে বিএলসি পাশ দেয়া হয় সেখানে কেবলমাত্র নৌকার মালিককেই এই পাশ দেয়ার বিধি আছে। এই বিধি অনুযায়ী বহিরাগত যে কেউ যাদের সাথে বনের নূন্যতম কোনো ঐতিহাসিক পারস্পরিক সম্পর্ক নেই তারাও বনে প্রবেশ করে বনজ দ্রব্য সংগ্রহ করতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (Convention on biological diversity/CBD 1992) এর আলোকে ১৯৯৮ সনে বাংলাদেশ Biodiversity and community knowledge protection act নামে যে খসড়াটি তৈরি করে তাতে কিছুটা হলে প্রাকৃতিক বনের উপর বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। রহস্যজনকভাবে এই আইনটি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনভূমি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, সিলেট অঞ্চলের বর্ষারণ্য, মধুপুর-ভাওয়াল ও উত্তরবঙ্গের শালবন, হাওরের জলাবন ঘিরে এখনও দেশের ৪৫ কি তারও কম বেশি আদিবাসী ও পেশাগত মৌয়াল-বাওয়ালী-চুনারি-মাঝি-জেলে জনগণের বসবাস।

আদিবাসী ও পেশাগত বননির্ভর জনগোষ্ঠীসহ প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এখনও কোনো না কোনোভাবে দেশের প্রাকৃতিক বনভূমির উপর নির্ভরশীল। ৩৫ লাখ জনগণের এই ঐতিহাসিক বননির্ভরশীলতা দেশের কোনো আইন বা নীতি এখনও পর্যন্ত বিবেচনা করেনি। অথচ বননির্ভর বনজীবী জনগণের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের এক টুকরা বনও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক বন ছাড়া সভ্যতা টিকে থাকে না। প্রাকৃতিক বনভূমি ছাড়া জনজীবন ও প্রতিবেশের জটিল বাস্তুসংস্থানের ধারাবাহিক বিকাশ ও রূপান্তর অচল হয়ে পড়ে। আদিবাসীসহ বননির্ভর জনগণ বনভূমিকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। এই অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দিকে রাষ্ট্রের বুক মেলানো উচিত। বননির্ভর জনগণের কাছে বনের অধিকার একটি প্রাথমিক মৌলিক নাগরিক অধিকার।

সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। নানান উন্নয়ন মারদাঙ্গার কবল থেকে দেশের ক্ষয়িষ্ণু বনভূমিকে বাঁচাতে আদিবাসী জনগণ প্রতিনিয়ত বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন অকাতরে। বর্তমান নির্বাচিত সরকারের উচিত সেই পরিবেশবাদী রক্তপ্রবাহকে সম্মান জানিয়ে বনঅধিকার আইন প্রণয়ন করা। যেখানে বননির্ভর জনগণের প্রাকৃতিক বনভূমির উপর প্রথাগত লোকায়ত অধিকার, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের দায়িত্ব বন্টিত থাকবে। হয়তো এভাবেই দেশের বিপন্নপ্রায় মুমূর্ষু বনভূমির প্রাণ আবারো তরতাজা করে তোলা সম্ভব। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের এই টালমাটাল দুনিয়ায় তৃতীয় দুনিয়ার এক গরিব দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেখানে সারা বিশ্বে গর্বের উদাহরণ হতে পারে। প্রাকৃতিক বনভূমির গুরুত্ব ও বনের অধিকারকে সম্মান জানাতে প্রতিবছর ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস পালিত হয়। আশা করি মাননীয় পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী এ বছরের বিশ্ব বন দিবসে দেশের সামগ্রিক প্রয়োজনে বন অধিকার আইনের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন। দেশের বঞ্চিত বননির্ভর জনগণ এবং নিশ্চিহ্নপ্রায় বনভূমির জন্য এক অনন্য নজির তৈরি করতে মাননীয় সরকারকে আবারো আহবান জানাই।

happy wheels 2

Comments