চাই একটুখানি স্নেহের পরশ

চাই একটুখানি স্নেহের পরশ

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

আমাদের সমাজে একজন মেয়ে বা নারীকে সর্বত্র এবং সকল কাজে পেছনে ফেলে রাখার চেষ্টা করা হয়। আধুনিক উন্নয়ন সাহিত্যে ‘জেন্ডার’ নামক শব্দটির প্রচলনের মাধ্যমে নারীদের কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে। সমাজ থেকে একজন নারীকে তাঁর পরিচয় এবং কার্যক্রম চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে নারী থাকবে ঘরে। সে রান্না করবে, সন্তান লালনসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করবে। প্রথম ধাপ শুরু হয় পরিবার থেকেই। জন্মের পর পরই একজন মেয়ে শিশুকে বিভিন্ন বিধি নিষেধে আটকে ফেলা হয়। সে যখন বড় হতে থাকে নিষেধের পাল্লা যেমন ভারী হয় তেমনি সংকুচিত হয়ে আসে তাঁর সুযোগের রাস্তাটুকুও। সমাজ একজন সুস্থ নারীর প্রতি যদি এমন আচরণ করে তবে প্রতিবন্ধীর বেলায় তা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠে।

প্রতিবন্ধীতা কোনো রোগ নয়, মানব বৈচিত্র্যেরই একটি অংশ। কোনো ব্যক্তি যদি প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত হয় তখন সে মানব বৈচিত্র্যেরই একটি রূপ থেকে আরেকটি রূপে আবির্ভূত হয়। সকল ধর্মেই বলা আছে, পরিবারে মেয়ে সন্তান হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ। একজন মেয়ে শিশু তার সারাজীবনে অনেক রূপে ভূমিকা পালন করে। সে বাবা মায়ের রাজকন্যা, ভাইয়ের স্নেহময়ী বোন, আবেগ প্রবণ প্রেমিকা, কোমল হৃদয় স্ত্রী এবং সবশেষে মমতাময়ী মা। সম্পর্কের সূত্র ধরে নামের আগে এত উপনাম থাকা স্বত্বেও একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে পরিবারে বা সমাজে মেয়ে শিশু সব সময় অবহেলা আর নির্যাতনের শিকার হয়। পরিবার বা সমাজে সঠিক মর্যাদা পায়না।

IMG_20180318_115853
নেত্রকোনা সদরের মালনী ঋষিপাড়ার দরিদ্র মুচি সুধাংশু ঋষি। ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে তাঁর ঘর আলো করে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। প্রতিটি সুস্থ শিশুর মতই জন্মেছিল সে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে উঠছিল। সুধাংশু ঋষির ছয় সন্তানের সকলেই মেয়ে। এর মধ্যে রত্না ঋষি তৃতীয় সন্তান। ছোট শিশুদের মধ্যে বেড়ে উঠার যে ধরণের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় সে সকল গুণাবলী ছিল রত্নার মধ্যে। সঠিক সময়ে হাঁটতে শিখে, কথা বলা শিখে। নিজে নিজে খেতে পারে, এমনকি সমবয়সীদের সাথে খেলতেও পারে। কিন্তু তার বয়স যখন সাত বছর, তখন জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং হঠাৎ করে খিঁচুনি হয়। ডাক্তার দেখানোর পর জ্বর ও খিঁচুনি ভালো হয়। কিন্তু তারপর থেকে সে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারা শরীর শুকিয়ে যেতে থাকে। কিছুু খেতে পারেনা। শরীর দূর্বল হয়ে যায়।

দরিদ্র বাবা মা তাঁদের সাধ্যমতো চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বর্তমানে রত্নার বয়স সতের। অথচ তাকে দেখলে মনে হয় ছয় বা সাত বছরের মানুষ। সে সারাক্ষণ নীরব থাকে, কারো সাথে কথা বলেনা। খাবারের প্রতি তার প্রচণ্ড অনীহা। সে মাছ আর মাংস খেতে পছন্দ করে। অন্য কিছু দিলে খেতে চায়না। কিন্তু দরিদ্র বাবার পক্ষে প্রতিদিন মাছ, মাংস যোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠেনা।

শরীরের তুলনায় রত্নার মাথা অনেক বড়। হাত, পা খুবই চিকন একেবারে ছোট শিশুদের মতো। উচ্চতাও খুব বেশি নয়। বাড়ির সবাই কিংবা প্রতিবেশিরা যখন একসাথে গল্পে মেতে উঠে বা হাসি ঠাট্টা করে সময় কাটায়, রত্না তখন তাদের সাথে শুধু বসে থাকে। কথা বলা তো দূরে থাক হাসিতেও তাল মিলায়না। অন্যদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করেনা। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, উত্তর দেয়না।

কোনো বিষয়ে তার মতের অমিল হলে সেটা সহ্য করতে পারেনা। খুব জেদ করে। কোনো কোনো সময় জেদের কারণে নিজের শরীরে আঘাত করে। তার মুখে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের অনেক চিহ্ন রয়েছে। সে নিজের কোনো কাজ যেমন গোসল করা, কাপড় ধোয়া, চুল আঁচড়ানো, দাঁত মাজা ইত্যাদি প্রাত্যহিক কাজগুলো একা একা করতে পারেনা। এ সব কাজে সাহায্য করেন তার মা। সংসারের কাজের পাশাপাশি মেয়ের বাড়তি কাজে সময় দিতে গিয়ে তিনি মাঝে মাঝে বিরক্তবোধ করেন। কিন্তু যখন নিরবে মেয়ের অবস্থার কথা ভাবেন তখন নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসে। ছয় সন্তানের মাঝে তিন জন জীবিত আছে। রত্নার বড় দু বোনের বিয়ে হয়েছে। তারা রীতিমতো সংসার করছেন। কিন্তু রত্না এ সবের কিছুই বোঝেনা। অসুস্থ থাকার কারণে লেখাপড়াও শেখা হয়নি তার।

এত বড় হবার পরও সে ছোট শিশুদের মতোই রয়ে গেছে। তার চেয়ে ছোট বয়সের শিশুরা তাকে নিয়ে অনেক সময় মজা করে। হাসি ঠাট্টার ছলে ভ্যাংচি কাটে, একা বসে থাকলে বিভিন্ন কথা বলে বিরক্ত করে। তখন সে খুব রেগে যায়। নিজের শরীর কামড়ে দেয়, খামচি কাটে। কাঁটা জায়গা থেকে রক্ত পড়লেও তার বোধগম্য হয়না। মা দেখার পর শুশ্রুষা করে সুস্থ করেন। এখনো মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যায় রত্না। তবে খিঁচুনি আর হয়না। অসুস্থ হলে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনা। খাওয়া দাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।

রত্নার মায়ের সাথে কথা বলে জানা যায় নেত্রকোনা সদর হাসপাতালের ডাক্তার বলেছেন সে শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, আর কখনো সুস্থ হবেনা। ডাক্তারের চিকিৎসায় সুস্থ হয়নি দেখে তাকে বিভিন্ন কবিরাজের কাছেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাতেও কাজ হয়নি। পরিবারের কেউ শিক্ষিত নয় বলে তারা সঠিক জানেনা কোথায় গেলে এ রোগের চিকিৎসা করানো যাবে। তাদের পার্শ্ববতী এলাকা মালনী রোডে বেসরকারী সংগঠন স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির হাসপাতাল আছে। যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবা ও থেরাপি দেয়া হয়। এই বিষয়টি রত্নার পরিবার জানেই না। শুধুমাত্র অজ্ঞানতার কারণে রত্না তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

রত্নার শারিরীক এই অবস্থার জন্য তাকে এবং তার পরিবারকে অনেক কথা শুনতে হয়। প্রতিবেশিরা রত্নাকে দেখে দূরে সরে যায়। মনে করে ওর শরীরে কোনো খারাপ ‘বাতাস’ লেগেছে। নিজের কাজ করতে পারেনা বলে সে প্রায় সময়ই নোংরা অবস্থায় থাকে। যে কারণে কেউ তার কাছাকাছি বসেনা। নানা ধরণের সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্য করে। কেউ কখনো আর্থিক সহায়তা বা পরামর্শ দেয়নি, বরঞ্চ আঘাত দিয়ে কথা বলে। পরিবারের লোকজন এসব শুনতে শুনতে মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে। রত্নার মা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তিনি যতদিন জীবিত আছেন ততদিন মেয়েকে কোনো কষ্ট পেতে দেবেননা। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে মেয়ের কি হবে এই ভেবে তিনি দিশেহারা।
প্রতিবন্ধী পরিচর্যা কেন্দ্র ‘সুইড বাংলাদেশ নেত্রকোনা শাখা’য় কর্মরত শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে স্নেহ-সুলভ আচরণ করতে হয়। হাসি খুশি পরিবেশে থাকতে তারা পছন্দ করে। তাদের মনের অবস্থা বুঝে কথা বলতে হয়। নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য সহ্য করতে পারেনা। সবারই সমাজে সমানভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। বিশেষ করে নারী প্রতিবন্ধীদের সব ধরনের সুযোগ দিতে হবে, যা তাঁদের প্রয়োজন। তাঁরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজের সকলের উচিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন করা, তাদের সাথে সংবেদনশীল আচরণ করা। রত্না ঋষির মতো শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সঠিক চিকিৎসা, আনন্দময় পরিবেশে বেড়ে উঠার সুযোগ পেলে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারতো।

happy wheels 2

Comments