নগর দারিদ্র এবং দুর্যোগ সক্ষমতা শীর্ষক মতবিনিময় সভা
ঢাকা থেকে সুদিপ্তা কর্মকার
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বারসিক এর উদ্যোগে ঢাকার বাবর রোড এ অবস্থিত ‘আইইডি’ এর ‘এইচকেএস আরেফিন’ সভাকক্ষে ডিসেম্বর ২০১৮ ‘নগর দারিদ্র এবং দুর্যোগ সক্ষমতা শীর্ষক মতবিনিময় সভা’ এর আয়োজন করা হয়। উক্ত সভায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকার মোহাম্মদপুর, চাঁদ উদ্যান এ অবস্থিত পাইওনিয়র হাউজিং/ সোনামিয়ার টেক বস্তির ২৩জন বাসিন্দা সহ মোট ৩৩ জন যার মধ্যে ২৫ জন নারী এবং ৮ জন পুরুষ উপস্থিত ছিল। এছাড়াও জাতীয় পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’র (পবা) চেয়ারপারসন আবু নাসের খান, বস্তিবাসী ইউনিয়ন এর সাংগঠনিক সম্পাদক কুলসুম বেগম, বস্তিবাসী অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপতি হোসনে আরা বেগম রাফেজা, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ’জনউদ্যোগ’ এর সদস্য সচিব তারিক হোসেন মিঠুন পার্লামেন্ট নিউজ.কম এর সম্পাদক শাকিলা পারভিনসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল এর সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভার সভাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন জনাব আবু নাসের খান। পরিচয় পর্ব শেষে প্রকল্প সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর আলম সভার একটি ধারনাপত্র পাঠ করেন। সেখানে তিনি বর্তমানে ঢাকা শহরে বসবাসকারী বস্তিবাসীদের জীবন সংগ্রাম ও জীবনযাত্রার মান’র উপর একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। পরবর্তীতে সভাপ্রধান আবু নাসের খান সভায় অংশগ্রহণকারীদের বস্তিবাসীদের জীবন জীবিকার চলমান সমস্যা, সম্ভাবনা, করণীয় প্রভৃতি বিষয়গুলো তুলে ধরতে অনুরোধ করেন।
সভায় উপস্থিত বস্তিবাসীদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই ছিল ভোলা জলার স্থায়ী বাসীন্দা। এছাড়াও অনেকে বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল থেকে এসেছেন। তারা ৭ থেকে ২০ বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে অবস্থান করছেন। তাদের আলোচনায় গ্রাম থেকে শহরে আসার গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হচ্ছে-
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদী ভাঙন
- গ্রামে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকা
- মৌসুমী বেকারত্ব
- শহরের কাজ/আয়ের সুযোগ বেশি
- পারিবারিক সহিংসতা
- পূর্ব থেকে পরিবারের কেউ বা আত্বীয় স্বজনের বস্তিতে বসবাস
- আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার আকাঙ্খা
- অভাব
শহরে এসে পরিচিতদের মাধ্যমে বস্তিতে উঠেন তারা এবং এই বস্তিতে শুরু হয় তাদের নতুন জীবন যুদ্ধ। বিগত দিনের কষ্ট এবং এখন বস্তিতে অবস্থানের কষ্ট নিয়ে বস্তিবাসীদের মধ্যে কয়েকজন তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন।
আয়েশা আক্তার: আমার যখন বয়স তিন মাস তখন আমার বাবা মা মারা যায়। গ্রামে ভাই এর বাসায় আমি বড় হয়েছি এবং ছোট বেলা থেকেই মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে বড় কষ্টে হয়েছি। কিশোরী বয়সে অভাব আর মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে ও ভালভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে এক আত্মীয়র সাথে প্রথম ঢাকায় চলে আসি। শুরু হয় নতুন জীবনযুদ্ধ, দুমুঠো খাবারের জন্য মাসিক মাত্র ৫০ টাকায় বাসাবাড়ীতে কাজ শুরি করি। কিন্তু ময়লা কাপড়-চোপড় ও নোংরার অপবাদ দিয়ে অল্পদিনেই কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। সেখান থেকে বিতারিত হয়ে গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করি। কিছুদিন যেতে না যেতেই গার্মেন্টেসে কাজ করার বয়স হয়নি বলে তারিয়ে দেয়। পরে আত্মীয়ের কাছ থেকে জামা কাপড় ধার করে পুনরায় বাসাবাড়ীতে কাজ শুরু করি। বিয়ের পরে দুই ছেলে-মেয়ে হলেও এখনও বাসাবাড়ীতেই কাজ করি। আগে যেখান এক কাজ ৫০ টাকায় করতার এখন সেটি করি ৮০০-১০০০ টাকায়। কিন্তু বাসাভাড়াসহ নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের অবস্থার সেভাবে পরিবর্তন আসেনি। সন্তানদের পড়া শোনার খরচ, খাওয়া-দাওয়া এর খরচ, ঘরভাড়া, পানির বিল, কারেন্ট বিল, টয়লেট বিল সব দিয়ে মাস শেষে কোন টাকাই আর হাতে থাকেনা। সবকিছুর জন্য টাকা দিলেও কোন সেবাই মান সম্মত নয়। একটি টয়লেট ব্যবহার করি ৭০-৮০ জন নারী-পুরুষ মিলে, দিনে দুইবার পানির জন্য ধরতে হয় লম্বা লাইন, জ্বালাতে পারিনা একটির বেশি বাল্ব, ৪-৬ হাত ঘরের মধ্যে থাকতে হয়, সারতে হয় রান্নাসহ পরিবারের সকল ধরনের কাজ- যার চারপাশে দূর্গন্ধ আর ময়লা। সরকার যদি বস্তির পানি নিস্কাশন, ময়লা ফেলার জায়গা, কয়েকটি টয়লেট ও বস্তিবাসীর জন্য কম টাকায় চাল-ডাল সহ মাসের বাজার করার ব্যবস্থা করতো, বস্তির মানুষের জন্য বিভিন্ন ভাতার ব্যবস্থা করতো- তাহলে আমাদের জন্য খুব উপকার হতো। তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারের কাছে যেতে পারিনা; আপনারা যদি আমাদের কথাগুলো সরকার এর কাছে পৌঁছে দিতেন তাহলে আমাদের খুব উপকার হতো। কোথায় বললে আমাদের এই দূর্দশা লাঘব হবে আমরা সেটাও জানিনা।
ইয়ানুর বেগম: অভাব এবং গ্রামের বাড়িতে কাজ না থাকার কারণে শহরে আসা। শহরে এসে টাকার অভাবের জন্যই বস্তিতে ছোট্ট একটি ঘরে এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তানদের নিয়ে থাকা। পানি, ইলেক্ট্রিসিটি, বাথরুম, মশা-মাছি, ড্রেনের গন্ধ এসব কিছুর কষ্ট তো রয়েছেই- কিন্তু তার উপরও রয়েছে যে কোন সময় বস্তি ভেঙে দেবার ভয়। সরকার এর কাছে আমাদের একটাই চাওয়া সরকার যদি আমাদের জন্য একটা স্থায়ী থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতো তাহলে আমাদের মতো সহায় সম্বলহীন মানুষের খুব উপকার হতো।
শাহনাজ বেগম: নদী ভাঙনের কারণে নি:স্ব হয়ে ঢাকায় আসা। ঢাকায় এসে এই বস্তিতেও নানা কষ্টের মধ্যে আছি। আমি আর আমার স্বামী যা আয় করি সব ঘর ভাড়া, খাবার, পানি, কারেন্ট, টয়লেট, সন্তানদের পড়াশোনা ইত্যাদি কাজে শেষ হয়ে যায়। কিছুই থাকেনা জমা। সরকার এর কাছ থেকেও আমরা কোন সাহায্য পাইনা। এদিকে মেয়ে বড় হচ্ছে, মেয়ের বিয়ে দিতে হলে অনেক টাকা যৌতুক দিতে হবে। কোথায় পাব আমরা টাকা, আর যৌতুক না দিলে কেউ মেয়েকে বিয়ে করবেনা।
রেখা খাতুন: আমার ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যায়। শাশুড়ি খুব নির্যাতন করতো। সহ্য করতে না পেরে শহরে চলে আসি। এখানে এই বস্তিতে এসেও নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে কোনরকমে দিন যাপন করি। স্বামী কোন কাজ করেনা। নেশা করে আর আড্ডা দেয়। আমার একার আয়ে সংসার চালাতে হয়। কোন কোন দিন না খেয়েও থাকতে হয়, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে জানিনা। সরকার যদি আমাদের মত মানুষের জন্য কিছু সাহায্য করতো তাহলে আমরা বেঁচে যেতাম।
ফয়সাল রহমান: বাবা মা এর সাথে ছোট বেলায় এই বস্তিতে আসি। এখন আমি বিয়ে করেছি আমার একটি সন্তানও রয়েছে। এতদিন এখানে আছি কিন্তু আমাদের জীবন যাত্রার মান ঠিক আগের মত খারাপই রয়েছে। এই বস্তিতে অনেক সমস্যার কথা আপারাতো বললই, সাথে আমি যোগ করতে চাই বস্তির অপরিস্কার এবং দূর্গন্ধযুক্ত পরিবেশের কথা। আমাদের বস্তিতে ময়লা ফেলবার কোন জায়গা নেই। তাই সবাই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে পুরো বস্তিটাই ময়লার স্তুপ হয়ে গিয়েছে। আগে সুয়ারেজ এর লাইনও ছিলনা, সিটি কর্পোরেসন এ জানানো হলে টাকা চায় আমাদের কাছে। আমরা বস্তির সব ঘর থেকে কিছু কিছু টাকা তুলে সিটি কর্পোরেসন এ দিলে অল্প পরিসরে কিছুদিন আগে আমাদের সুয়ারেজ এর লাইন দিয়েছে। আর একটি সমস্যা বাল্য বিবাহ, কম বয়সের কোন মেয়ের বিয়ে হতে থাকলে আমরা যদি পুলিশের কাছে জানাই তাহলে পুলিশ এসে টাকা খেয়ে চলে যায় আর বাবা-মা বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়। বস্তির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মাদক। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বস্তির মধ্যে মাদক বিক্রি করে। তাদের পুলিশও ধরতে পারেনা। কোন কোন সময় ধরলেও আবার তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে যায় এবং পূনরায় মাদক বিক্রি করে। আর এই কারণেই বস্তির পরিবেশ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।
কুলসুম বেগম: “বান্দি পরের পা ধুইতে পারে নিজের পা পারেনা”, “আমরা অন্যকে সুন্দর রাখি নিজেদের সুন্দর রাখিনা।” আমরা বস্তিবাসীরা সবসময় নিজের কথা নিজের লাভ এর কথা আগে চিন্তা করি তাই এক হতে পারিনা। ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া, সংগঠিত হওয়া ছাড়া আমরা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবোনা। কিসে এবং কি করলে আমাদের ভাল হয় আগে তা আমাদের বুঝতে হবে। কথায় আছে “দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ”। কয়েক হাজার লোক আমরা যদি এক হয়ে কোন স্থানে গিয়ে আমাদের কথা বলতে চাই তাহলে মানুষ একটু হলেও আমাদের কথা শুনবে, প্রসাশন আমাদের দিকে তাকাবে, সর্বোপরি সরকার ও আমাদের দাবি শুনতে চাইবে। দেশের রাজনীতিবিদদের শক্ত করে আমাদের দাবি বোঝাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে আমরাই শহরের চালিকাশক্তি, আমরা না থাকলে শহর নোংরা হবে, যান চলাচল বন্ধ থাকবে, গার্মেন্টস অচল হয়ে যাবে আরও অনেক কিছু। তাই সরকার যখন বাজেট প্রণয়ন করে তখন বস্তিবাসীর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে। আমাদের জন্য স্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। সরকারকে বোঝাতে হবে “যার যার যার নীতি, বস্তিবাসীর এক নীতি।” এই সব কিছুর জন্য এক হয়ে আমাদের আন্দোলন করতে হবে। আমাদের কেউ ঘরে এসে ভাগ্য পরিবর্তন করে দিবেনা। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন এর জন্য আমাদের একত্রিত হতে হবে।
তারিক হোসেন মিঠু: নাগরিক ঐক্যের সদস্য সচিব তারিক হোসেন বলেন, নিন্ম আয় এর মানুষের এর জন্য সরকার এর অনেক সেবা রয়েছে সেই সম্পর্কে আগে আপনাদের জানতে হবে। কারণ আপনি যদি না জানেন আপনাদের জন্য কি কি সেবা রয়েছে এবং কোথায় গেলে সেবাগুলো পাওয়া যায়, তাহলে আপনারা সেগুলো প্রশাসনের এর কাছে চাইতে পারবেননা। আর এই তথ্যগুলো আপনাদের বারসিক এর মত উন্নয়ন সংস্থা গুলো দিতে পারে। কিন্তু আপনাদের আগে একতাবদ্ধ হতে হবে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে। আপনাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, সন্তানদের পড়াশোনা শেখাতে হবে, স্কুলে পাঠাতে হবে এবং যৌতুক এব বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সর্বপরি নিজেকে জানতে হবে, ভালবাসতে হবে এবং ভাল থাকার জন্য সকলে মিলে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
শাকিলা পারভিন: এই পর্যায়ে পার্লামেন্ট নিউজ.কম এর সম্পাদক শাকিলা পারভিন সকলের উদ্দেশ্যে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, তিনি কিছুদিন আগে আমাদের পার্শবর্তী দেশ ইন্ডিয়ার দিল্লিতে অবস্থিত সবচেয়ে বড় বস্তির উপর কিছুদিন গবেষণা করেছেন। সেখানকার অবস্থা বাংলাদেশের বস্তির অবস্থা থেকে অনেক খারাপ। সেখানে কোন টয়লেট নেই, মানুষ খোলা যায়গায় ভোর রাতে টয়লেট করে। অনেকের বাসা মাটির নিচে, সেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে কারেন্ট ও থাকেনা। কারেন্ট থাকলেও হয়তো ছোট্ট একটা ফ্যান চলে আর একটা লাইট। অসম্ভব গরম সেখানে। সেখানকার বস্তিবাসীরা এখন নিজেদের অধিকার এর জন্য এখন লড়ছেন। ওরা একতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের জন্য আন্দেলন করছেন। সম্প্রতি সরকার তাদের টয়লেট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন বাংলাদেশে আপনাদেরও এক হয়ে কিছু চাইতে হবে। আপনাদের বুঝতে হবে, ‘দাবী আমার কাজ আমার, আমার কাজ আমাকেই করতে হবে।’ উন্নয়ন সংস্থাগুলো আপনাদের একত্রিত করতে পারবে, আর আমরা সাংবাদিকরা আপনাদের কথা পত্রিকার মাধ্যমে সরকারকে জানাতে পারবো। কিন্তু একত্রিত হয়ে দাবিটা আপনাদেরই করতে হবে।
হোসনে আরা বেগম রাফেজা: বস্তিবাসী অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপ্রধান হোসনে আরা বেগম রাফেজা বলেন, নদীভাঙন, মহাজনের সুদ, অভাবসহ বিভিন্নকারণে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষগুলো বস্তিতে এসে খারাপ পরিবেশে আরও মানবেতর জীবনযাপন করে। এই মানুষগুলো বোঝেনা তারা কোথায় গেলে তাদের এই সমস্যাগুলো থেকে পরিত্রাণ পাবে। আমাদের সবার এক হয়ে যেকোন দাবি দাওয়া চাইতে হবে। সরকার এর বিভিন্নসেবা সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের নিজেদেরও আত্মনির্ভরশীল হতে হবে এবং নিজেদের মনে সাহস আনতে হবে যেন নিজের কথা নিজেরা বলতে পারি। সরকার এর পরিকল্পনায় যেন বস্তিবাসীর অধিকার রক্ষা পায় সে বিষয়ে আমাদের এক হয়ে সরকার এর কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করতে হবে। আমাদের সরকারকে বোঝাতে হবে বস্তি উচ্ছেদ করতে হলে আগে আমাদের প্রথমে পূনর্বাসন করতে হবে। ’একতাই বল’ এই বিশ্বাস নিয়ে আমাদের সংগঠিত হয়ে নিজেদের অধিকার আদায় করতে হবে। ’বারসিক’ এর মত উন্নয়ন সংস্থাগুলো কথাবলার সুযোগ করে দিবে- কিন্তু কথা আমাদেরই বলতে হবে।
আবু নাসের খান: মতবিনিময় সভার শেষ পর্যায়ে এসে সভার সভাপ্রধান আবু নাসের খান বলেন, সবার আলোচনা শেষে আমরা এটাই বুঝতে পারি, ঢাকা শহরের এই নিম্ন আয় এর মানুষেরা যারা সহায় সম্বলহীন হয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসে বস্তিতে অসম্ভব কষ্টের মধ্যে বসবাস করে। তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে এতটাই হতাশ যে, নিজেদের মানুষ হিসেবে যে নূন্যতম কিছু অধিকার রয়েছে সে সম্পর্কেও তারা জানেন না। এই বস্তিবাসী নিম্ন আয়ের মানুষেরা একতাবদ্ধও হতে পারেনা এবং তাদের মধ্যে সচেতনতার অনেক অভাব, যার ফলে সরকার পর্যন্ত তাদের দাবী দাওয়া পৌঁছাতে পারেনা। এছাড়াও সরকার এর বিভিন্ন সেবা রয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সে সম্পর্কে তারা জানেননা। এছাড়াও তারা তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পেছনেও খুব একটা আগ্রহী থাকেননা। আপনাদের বুঝতে হবে একজন যোগ্য সন্তান নিজের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি সংসার এর ভাগ্যেরও উন্নয়ন হয়। আপনাদের আরও সচেতন হতে হবে নিজের এবং বাসার আশেপাশের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে রোগ বালাই কম হবে। সরকার এর বিভিন্নসেবা সম্পর্কে জানতে হবে এবং একতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের দাবী দাওয়া সরকার এর কাছে পেশ করতে হবে। আপনাদের এটা মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমেই অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। সবশেষে সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে আবু নাসের খান সভার সমাপ্তি ঘোষনা করেন।
নগর দারিদ্র এবং দুর্যোগ সক্ষমতা শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এ সবার আলোচনার মাধ্যমে কিছু সুপারিশ উঠে আসে:
- বস্তিবাসী নিম্নআয় এর মানুষদের নিজেদের অধিকার এবং দাবি দাওয়ার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে;
- বস্তিবাসী নিম্নআয় এর মানুষদের জন্য সরকার এর বিভিন্ন সেবা-পরিসেবার তথ্য সম্পর্কে জানানো এবং কিভাবে ও কোথায় গেলে সেই সেবাগুলো পাওয়া যায় তা জানাতে কাজ করতে হবে;
- বস্তিবাসী নিম্ন আয় এর মানুষেরা কিভাবে কম টাকায় চাল ডাল সহ যাবতীয় মাসিক বাজার করতে পারে সে বিষয়ে প্রশাসনের সাথে আলোচনা করা দরকার;
- বস্তিবাসী নিম্ন আয় এর মানুষদের জন্য সরকার এর সুযোগ সুবিধা যেন শুধুমাত্র তারাই পায় সে জন্য বস্তিবাসী মানুষদের জন্য আলাদা কার্ড করা দরকার;
- বস্তিবাসী নিম্ন আয় এর মানুষেরা যেন তাদের সন্তানদের বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠায় সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা;
- বাল্যবিবাহ এবং যৌতুক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে;
- বস্তিবাসী নিম্ন আয় এর মানুষদের সরকারি জায়গায় স্থায়ী বাসস্থান এর জন্য সরকার এর সংশ্লিষ্ট্য মহলের সাথে মতবিনিময় করা;
- পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে বস্তিবাসীদের নিজেদের সচেতনতা বাড়াতে হবে;
- ছেলেমেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হতে হবে;
- জরুরী ভিত্তিতে পাওনিয়ার বস্তিতে বাথরুম, পানি, ময়লা ফেলার জায়গা ও পানি নিস্কাশনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে;
- বস্তিবাসীদের নিজেদের উদ্যোগে বস্তি এলাকায় পয়ঃনিস্কাশন, বর্জ্যব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ পানি ও জলের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে তা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে;
- বস্তিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে বস্তিবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে;
- নিজেদের নাগরিক অধিকার ও সুযোগ সুবিধা বিষয়ে বস্তিবাসীদের আরো সচেতন হতে হবে;
- মানবাধিকারের জায়গা থেকে শুধু বস্তিবাসী নয়, রাস্তবাসী, ঝুপড়িবাসীসহ নগরে বসবাসকারী সকল নাগরিকের নাগরিক অধিকার নিয়েই কথা বলতে হবে;
- বস্তিবাসীরা নিজেরা কি চায় তা ঠিক করে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে;
- নগরের নিম্ন আয়ের মানুষদের অবদানকে বিবেচনা করে তাদের আবাসনসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বিবেচনা করে নগর পরিকল্পনা করতে হবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে নগরের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য আবাসন গড়ে তুলতে হবে;
- সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে বস্তিবাসীদের সম্পৃক্ত করতে হবে;
- বস্তিবাসীদের জন্য বর্তমানে সরকারের যেসব সুযোগ সুবিধা রয়েছে সে বিষয়ে জানার পাশাপাশি সেসব সেবা পরিসেবায় বস্তিবাসীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে;
- এছাড়া বস্তিবাসীদের নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে তারা এককভাবে বস্তির কোন কোন সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে, দলগতভাবে কোন কোন সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে, ও কোন কোন সমস্যাগুলো যৌথ বা সম্মিলিতভাবে সমাধান করতে পারে, এগুলো বিবেচনা করে নিজেদেরই প্রথমে উদ্যোগ নিতে হবে।