পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে স্বপন রায়ের শতবাড়ি

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার হাটিপাড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম মরনতলী। এ গ্রামের এক আদর্শ কৃষক স্বপন কুমার রায়। গ্রামের মেইন সড়কের পাশেই তাঁর বাড়ি। প্রায় দেড় একর জমি নিয়ে স্বপন কুমার রায়ের বাড়ি। সবুজ পাছপালায় ঘেরা সুদৃশ্য এ বাড়িটি দেখলে যে কোনো মানুষেরই চোখ জুড়িয়ে যায়। ওই এলাকায় এটি ‘শতবাড়ি’ নামে পরিচিত। করোনাকালিন সময়ে স্বপন কুমার রায়ের শতবাড়িটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বসত বাড়িতে তার উৎপদিত নিরাপদ শাকসবজি নিজে যেমন খেয়েছেন তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝে বিনিময় করে গ্রামীণ মানুষের করোনা মোকাবেলা অবদান রেখেছে। তাছাড়া বর্ষার সময় নীজ বাড়িতে বীজ ব্যাংক থেকে কৃষক কৃষক বীজ বিনিময় করে বীজ সংকট নিরসন করেছেন। তাই এই শতবাড়িটি গ্রামের মধ্যে একটি আদর্শ বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।


এ বাড়িতে আছে ৫টি দুধের গাভী, ২০০ হাঁস-মুরগির একটি খামার। এক বিঘার পুকুরে আছে নানা রকম মাছ। আর বসতবাড়ির অঙিনায় চাষ হয় বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি। এ বাড়িতে আরো আছে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, সফেদা, বেল, নারকেল, কলা, পেঁপে, লেবু, পেয়ারা, কুল ইত্যাদি। এসব ফলের সমন্বয়ে একটি চমৎকার ফলের বাগান। এইচএসসি পাস স্বপন কুমার রায়, স্ত্রী অঞ্জনা রায় এবং এক ’ছেলে এই নিয়ে স্বপন রায়ের সংসার। তার বাড়িতে সারাবছরই পাওয়া যায় গরুর দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম, মাছ এবং শাকসবজি ও ফলমুল। স্বপন রায় ও পরিবারের সবাই বাড়ির পুকুরের মাছ, গরুর দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস খায়।


বসতবাড়ির বাগানে উৎপাদিত শাকসবজি ও মৌসুমী ফলমূলই তার নিরাপদ খাদ্যের উৎস। এতে পরিবারের সাবারই প্রতিদিনের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়। তাই স্বপন রায়, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সবাই সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী। স্বপন রায় জানান, নিজ গ্রাম ছাড়াও পাশের গ্রামের মানুষ তার বাড়ির দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম ও হাঁস-মুরগি, পুকুরের মাছ এবং বসতবাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল ক্রয় করে থাকে। তাছাড়া স্থানীয় বাজারেও তিনি বসতবাড়ির কৃষি পণ্য বিক্রয় করেন। এ থেকে যে আয় হয় তাতেই স্বপন রায়ের জীবিকা নির্বাহ হয়।


স্বপন রায় জানান, সুস্থ থাকতে হলে প্রোটিনসৃমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। প্রোটিনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। মানব দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি সাধনের জন্য প্রোটিন একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে শিশু ও বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজন খুব বেশি। একই কারণে গর্ভবতী মহিলার গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ও গঠন ঠিকমতো হওয়ার জন্য এবং প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ তৈরির জন্য তাদের প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিনের দরকার খুবই বেশি। আবার পুষ্টির দিক থেকে শাকসবজি ও ফলমূলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির গরুর দুধ, হাঁস-মুগির ডিম এবং পুকুরে মাছ উৎপাদন ও খাওয়ার মাধ্যমে স্বপন রায়ের পরিবারের সবার প্রাণীজ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়। তাই তিনি গ্রামীণ মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে মানুষের মধ্যে এসব বিনিময় করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিনিময় করে আমি খুব আনন্দ পাই। তাছাড়া আমার বাড়ির আশেপাশে রয়েছে নানা ধরনের আপন জ¦ালা উদ্ভিদ। তা থেকে নিরাপদ খাদ্য নিজে সংগ্রহ করি এবং পাড়া প্রতিবেশীরা ও তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরুণ করেন।’


স্বপন রায় জানান, এসব শাকসবজি ও ফল বাগানে পানি সেচের জন্য তার বাড়িতে পুকুর ছাড়াও আছে ইঞ্জিন চালিত নলকূপ ও একটি টিউবওয়েল। তার এই টিউওয়েলের পানি আর্সেনিকমুক্ত বলে তিনি জানান। বাগানে পানি সেচ ছাড়াও তিনি খাওয়া গৃহস্থালীর সব কাজে টিউবওয়েলের আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি ব্যবহার করেন । স্বপন কুমার রায় বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহার করে। এতে অনেক রোগব্যাধি থেকে তারা নিরাপদ থাকি।’ স্বপন রায় ও তার স্ত্রী অঞ্জনা রায় জানান, তারা গৃহস্থালীর প্রতিদিনের আবর্জনা যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না ফেলে বসতবাড়ির সামান্য একটু দূরে গো-শালার কাছে এবং বাড়ির পেছন দিকে ছায়াযুক্ত স্থানে গর্ত করে সেখানে ফেলে আদর্শ পদ্ধতিতে পচিয়ে জৈব সার তৈরি করে তা ফলমূল ও শাকসবজি বাগানে ব্যবহার করেন। এর ফলে তার বসতবাড়ির পরিবেশও পরিস্কার পচিচ্ছন্ন ও বেশ মনোরম।


স্বপন রায় আরও জানান, গ্রামের দেশ বাংলাদেশ। এদেশের সকল গ্রামেই বসতবাড়ি রয়েছে। বসতবাড়ির জমি সাধারণত উঁচু ও স্থায়ী হওয়ায় তা কৃষি খামারে রূপান্তরের জন্য একটি উপযোগী স্থান। তাই নারী, পুরুষ, ছেলেমেয়ে সবার প্রচেষ্টায় দেশের প্রত্যেক বসতবাড়িকে পরিকল্পিতভাবে আদর্শ একটি সুন্দর ‘পুষ্টি বাড়ি’ তৈরি করে খুব সহজেই প্রতিদিনের পুষ্টি চাহিদা পূরণের সাথে সাথে আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করা যায়। যা দেশের পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক অবদান রাখতে সহায়ক হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যেমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন এবং মা ও শিশুসহ সবার দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে জাতির অপুষ্টি সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। এভাবেই আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও অপুষ্টিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো।

happy wheels 2

Comments