প্রাণবৈচিত্র্য ও উৎপাদনশীলতা
এবিএম তৌহিদুল আলম, কৃষিবিদ ::
সৌরজগতের গ্রহ একমাত্র এই পৃথিবীতেই রয়েছে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অপরূপ প্রকৃতি। এই পৃথিবীর সাগর-মহাসাগর, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, বন-বনানী, ধুসর মরুভূূমি ও বিস্তীর্ণ সমতল সর্বত্রই প্রাণের প্রবাহ বিরাজমান যা পৃথিবীর নানা অঞ্চলের প্রান্তিক পেশাজীবী মানুষের বংশানুক্রমিক চিরায়ত ব্যবস্থাপনা ও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যই যোগায় তাবৎ উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্য, জ্বালানি ও ঔষধের মতো অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রীর রসদ। তাই আজও এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর ৫ কোটি প্রান্তিক কৃষকের কৃষিখামারই এ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম কারিগর।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী পৃথিবীতে ৩০ লক্ষ থেকে ১০ কোটি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। বিচিত্র এই উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুুজীব বেঁচে থাকা ও বংশ বিস্তারের জন্য নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ও স্থানিক প্রতিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় একটি সুসংহত বাস্তুতন্ত্র (ইকোসিস্টেম) তৈরি করে যেখানে প্রতিটি প্রাণী-উদ্ভিদ ও অণুজীব তাদের প্রজাতি, জিনগতবৈচিত্র্যও প্রতিবেশের প্রতিটি উপাদানই এক একটি অংশ (কম্পোনেন্ট) যা একে অপরের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। একটি সুসংহত বাস্তুতন্ত্রে¿ চক্রাকারে উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের খাদ্যশৃঙ্খল, বিচরণ, প্রজনন ও প্রাত্যহিক জীবনক্রিয়া ফসলের উপকারী ও অপকারী পোকা-মাকড় ও রোগ-জীবাণুদের প্রভাবিত করে। তাই বাস্ততন্ত্রের প্রতিটি জীবই প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য জরুরি।
বাংলাদেশে আবাদী জমির ৭৭ ভাগ জুড়ে আছে ধান। ধানের বাস্তুতন্ত্রে আছে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির বিপুল-বিশাল প্রাণবৈচিত্র্য যার মধ্যে কৌলিতাত্ত্বিকভাবে ধানেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাত, ল্যান্ডরেস, ধানক্ষেত, ক্ষেতের মাটিতে বিদ্যমান অণুজীব, উপকারী-অপকারী পোকামাকড়, সংলগ্ন অন্য ফসলের ক্ষেত, ধানের রোগবালাই ও পোকামাকড়ের প্রাদূর্ভাব সৃষ্টিকারী পোকা-মাকড়। ধানের বাস্তুতন্ত্রের ওইসব পরজীবী পোকামাকড় ধানের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড়কে আক্রমণ করে ক্ষতিকর পোকার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য অক্ষুন্ন থাকলে রোগবালাই ও পোকা-মাকড় অর্থনৈতিক ক্ষতির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না। প্রাকৃতিকভাবেই ধানের বাস্তুতন্ত্রে রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবের মধ্যে পারষ্পরিক বৈরিতা থাকে বলে কোনো এক প্রজাতির অণুজীব একাধারে বৃদ্ধি পায় না। অন্যদিকে ধানের বিপুল-বিশাল প্রজাতি, কালটিবার ও জাতের কারণে ধান যথেষ্ট পরিমাণে পোকামাকড় ও রোগ-বালাই প্রতিরোধী। প্রাণবৈচিত্র্য নিজস্ব প্রতিবেশ এবং ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি চমৎকার খাদ্য শৃঙ্খল বজায় রেখে জীব জগতে একটি চমৎকার খাদ্য শৃঙ্খল তৈরি করে পারস্পরিক বৃদ্ধি ও অস্তিত্ব টিকিয়ে উৎপাদনের মূলভিত্তি হিসাবে কাজ করে। তাই পরিবেশসম্মত কৃষিচর্চাই প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের অন্যতম উপায়। প্রান্তিক কৃষকের পরম্পরাগত বহুবিধ ফসলের চাষ, শস্য পর্যায়, সাথীফসল, আন্তঃফসল, কৃষিভিত্তিক বনায়ন ও বহুমাত্রিক চাষাবাদ কৌশল প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক। এই কারণে ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামসহ ধান উৎপাদনকারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রাণবৈচিত্র্য অক্ষুন্ন রাখতে কৃষকদের উৎসাহিত করছে।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্য ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণে প্রতিবছর পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে ২৭,০০০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আর বিলুপ্তির মুখে রয়েছে ৬,০০০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও ২,০০০ প্রাণিপ্রজাতি। কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি’র তথ্য অনুযায়ী আনুমানিক ১০,০০০ বছর আগে কৃষির সূচনায় প্রায় ৭,০০০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও কয়েক হাজার প্রজাতির প্রাণী আমাদের খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের যোগান দিত। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৭৫ শতাংশ খাদ্য যোগান দেয় মাত্র ১২টি উদ্ভিদ ও ৫টি প্রাণিপ্রজাতি। আমাদের উদ্ভিদজাত খাদ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই সরবরাহ করে ধান, গম আর ভূট্টা মাত্র এই তিনটি ফসল। ঋঅঙ এর হিসাব অনুযায়ী গত শতাব্দীতেই প্রায় ৭৫ শতাংশ উদ্ভিদের জিনগত বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রাণী-প্রজাতি। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) ও কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি’র Biodiversity, Development and Poverty Alleviation: Recognizing the Role of Biodiversity for Human Well-being শীর্ষক ২০১১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে গত ৫০ বছরে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের ৬০ শতাংশ নষ্ট হয়েছে আর গত ১০ বছরে শুধু কৃষিজমির প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া গত শতকে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ প্যারাবন, ৪০ শতাংশ বন ও ৫০ শতাংশ জলাশয় হারিয়ে গেছে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭০ শতাংশ মানুষ সরাসরি প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবেদন অনুসারে পৃথিবীর প্রায় ১১০ কোটি প্রান্তিক পেশাজীবী মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে তাদের খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ, বাড়িঘর ও যানবাহন চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করেন। বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ সমুদ্র ও উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর জীবন-জীবিকা নির্ভর করেন যেখানে প্রায় ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
প্রজাতি বিলুপ্তির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে জাতিসংঘ ২০১০ সালকে ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য বর্ষ’ এবং ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কে ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দশক’ ঘোষণা করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। বিগত কয়েক দশকে বিশ্বায়ন ও পৃথিবীজুড়ে কৃষিউৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর। নির্বিচারে কৃষি-রাসায়নিকের প্রয়োগ, অতিমাত্রায় আন্তঃপরিচর্যা, বারংবার একই ফসল ও জাতের চাষ প্রভৃতি কারণে বাস্ততন্ত্র ক্রমশ বিনষ্ট হয়ে কৃষিসহায়ক অণুজীব, কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো স্থাপনে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন হয়ে কৃষিজমির উর্বরতা তথা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে চাষাবাদের খরচ বাড়িয়ে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ব্যবধান বাড়াচ্ছে।
একথা সত্য যে, মানবজাতিশূন্য পৃথিবী প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর না হলেও প্রাণবৈচিত্র্যশূন্য পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব একবারেই অসম্ভব। মানুষ নিজেও যেমন প্রাণবৈচিত্র্যের অংশ তেমনি আবার একাধারে আধিপত্য ও কর্তৃক বজায়কারী একচেটিয়া উপকারভোগীও বটে। কিন্তু মানুষের অপরিবেশবান্ধব আচরণে জীবজগতের বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয়ে প্রাণবৈচিত্র্যের ধ্বংস বা বিলুপ্তি পৃথিবীর উৎপাদন, অর্থনীতি ও সার্বিক জীবন-ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্যশস্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে কৃষিতে প্রযুক্তির প্রয়োগ আবশ্যিক। একইভাবে আগামী দিনে উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান ও যোগান অব্যাহত রেখে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রেখে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণও সমান জরুরি। কীভাবে এ দু’টির সমন্বয় সাধন করা যায় সেটাই এই মুহূর্তের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণবৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং নবায়নে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব পর্যায়ে যথোপযুক্ত কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ না করলে হয়তো অচিরেই দূষিত ও বিষাক্ত এই পৃথিবীর মানুষদের কবি গুরুর ভাষায় সমস্বরে চিৎকার করে বলতে হবে, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর’।
ব্যবহৃত ছবিটি ‘প্রকৃতি থেকে শেখা: উষ্ণ মন্ডলীয় দেশে পরিবেশসম্মত কৃষির নির্দেশিকা’: সিপপেই মুরাকামী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত।