‘আমাদের কথা তো আর কেউ শোনে না’!
সাতক্ষীরার, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসাবে বহুল পরিচিতি। এই এলাকায় প্রতিবছর ছোট বড় নানান ধরনের দুর্যোগ যেন লেগেই আছে। দুর্যোগ যেন কোন মতে পিছু ছাড়ছে না এই এলাকায়। আর প্রতিনিয়ত এ ধরনের দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করতে করতে উপকূল অঞ্চলের মানুষরা তাদের টিকে থাকার শক্তি আর সাহস দিনকে দিনকে হারিয়ে ফেলছে। এখানে বারংবার দুর্যোগ হচ্ছে। কোন একটা দুর্যোগ শেষ হতে না হতেই নতুন করে দুর্যোগ এসে হাজির হচ্ছে। কোন একটি দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে নতুন করে কিছু শুরু করার আগেই সব আশা ভরসা যেন সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখানে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তেমনি মানব সৃষ্ট নানান দুর্যোগ। সাথে অপরিকল্পিত বেড়ি বাঁধ যার কোন নিশ্চয়তা নেই। এখানকার বেড়ি বাঁধগুলোর অবস্থা নাজুক। এখানে যেমন তেমন কোন ঝড়-বৃষ্টি বা নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে মুহুর্তের মধ্যে বেঁড়ি বাধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে করে যেন উপকূলীয় মানুষের মধ্যে টিকে থাকার এক আহাজারি কান্না যেন সবসময় রয়েগেছে। আর এ আহাজারির কোন শেষ বা কোন সমাধান আছে বলে কারো জানা নেই।
বিগত কয়েক বছরের ন্যায় সম্প্রতি আবারো উপকূলীয় সাতকক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন নদী ভাঙনের সম্মুখিন। গত ১৪ জুলাই ২০২২ বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দুর্গাবাটি গ্রামের বেঁড়ি বাধের রাস্তাটি ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। বেশ কয়েক বছর ধরে এই জায়গাটি বারবার নদী ভাঙনের সম্মুখিন হচ্ছে এবং শত শত বিঘা জমি নদীর মধ্যে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান এ নদী ভাঙনের ফলে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম লবণ পানিতে প্লাবিত হয়। সেখানে বসত ঘর থেকে শুরু করে সুপেয় পানির ছোট বড় পুকুরসহ সব ধরনের পুকুর, চিংড়ি ঘের, সবজির ক্ষেত, খাল, বিল, উঠান, রাস্তাঘাট,গোবাদী পশুর ঘর সবত্রই নদীর লবণ পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে করে অনেক ধরনের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। সবচেয়ে বেশি সম্পদের ক্ষতি হয়েছিলো মৎস্য সম্পদের। কারণ উপকূলীয় বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের প্রধান অর্থকারী ফসল হলো মাছ চাষ। আর এবছর এ মাছ চাষের মৌসুম সবে মাত্র শুরু হয়েছে। প্রতিটি চিংড়ি ঘেরে পুরোদমে মাছ ওঠা শুরু কেবলই। আর তার মধ্যে নদী ভাঙনের কবলে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।
নদী ভাঙনের ফলে লোকালয়ে পানি প্রবেশ পরবর্তী সময়ে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বিশেষ করে দূর্গাবাটি, পোড়াকাঠলা, বিলআটি, আড়পাঙ্গাশিয়া ও ভামিয়া গ্রামে মাঠ পর্যবেক্ষণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনার মাধ্যমে তাদের ক্ষয়ক্ষতি এবং আশংকা সম্পর্কে জানতে চাওয়া চেষ্টা করা হয়। সেখানে তারা নানান ধরনের সমস্যা ও আশংকার কথা তুলে ধরেন।
সেখানে দুর্গাবাটি, পোড়াকাঠালা গ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা জানান, ‘আমরা উপকূলীয় এলাকার মানুষ। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করে আমাদের টিকে থাকতে হয। কিন্তু এভাবে টিকে থাকা যেন আমাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আমাদের যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা তো সেই বাপ দাদাদের চৌদ্দ পুরুষ থেকে এখানে বসবাস করছি। আগেও ঝড় বৃষ্টি, ঘুর্ণিঝড় হতো কিন্তু মনে হয় এতো না। প্রতিবছর আমরা আমাদের সহায় সম্পদ হারাতেই আছি। নিজেদের ঘর বাড়ি, চিংড়ি ঘের ও বসতভিটা সংস্কার করতে না করতেই যদি আবার আঘাত হানে তাহলে কিভাবে টিকে থাকবো আমরা।’ তারা আরও বলেন, ‘এখানে যেহেতু লবণাক্ততার ভাগ বেশি এখানে কৃষি ফসলের চেয়ে মৎস্য চাষ বেশি হয়। যা আমরা নদীর লবণ পানি দিয়ে চাষ করি। আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস হলো এই চিংড়ি চাষ। কিন্তু প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদী ভাঙনের কারণে আমাদের মাছ চাষও বিপন্ন হচ্ছে। এতে করে তো টিকে থাকার সব কৌশল ও অবলম্বন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে আমাদের।’
ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্টীরা আরো বলেন, ‘এবার যেহেতু খুবই দ্রুত বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে তারপরও ক্ষতির মাত্রাও কম নয়। কারণ যে সব গ্রামে লবণ পানির জোয়ার ভাটা প্রবাহিত হয়েছে সেখানে পুনরায় আবার কিছু করতে গেলে খুব বেগ পেতে হবে। বছরের পর বছর যদি এভাবে ঘুরে ঘুরে নানান ধরনের দুর্যোগ আসতে থাকে তাহলে তো বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে আমাদের। এভাবে তো আর টিকে থাকা যায় না।’
তারা হতভম্ব হয়ে বলেন, ‘আমাদের কথা তো আর কেউ শোনে না। আমাদেরর ওয়াপদা রাস্তাগুলোর অবস্থা খুবি নাজুক। যেমন তেমন কোন দৃর্যোগ হলে রাস্তা ভেঙে এলাকায় পানি ঢুকছে। প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময়ে রাস্তা গুলো সংস্কারসহ টেকসই রাস্তা মেরামতের কথা বললেও সেটা শুধু কথার কথা রয়ে যায়। ভেঙে গেলে সবাই দেখতে আসে অনেকে ত্রাণ নিয়ে আসে। কিন্তু আমরা তো ত্রাণ চাই না, চাই প্রাণ আর তা হলো টেকসই বেঁড়ি বাঁধ। সেদিকেই যেন কারো খেয়াল নেই। বছরের পর বছর আমরা লবণ পানিতে ডুবতে আছে। আর কবে যে এ থেকে রেহাই পাবো তা নিয়ে আমরা খুবি উদ্বিগ্ন।’
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চলে প্রতিবছর নানান ধরনের দুর্যোগ আঘাত হানছে। আর এতে করে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হতে হচ্ছে এ এলাকার মানুষকে। এভাবে যদি সবসময় চলতে থাকে তাহলে হয়তোবা এ এলাকার মানুষকে এলাকা ছেড়ে অনত্র আশ্রয় নিতে হবে। কারণ প্রতিবছর শত শত বিঘা জমি নদীর মধ্যে চলে যাচ্ছে। এবং প্রচুর সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। সাথে নানান ধরনের রোগ ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। তাই উপকূলীয় এলাকার জন্য জনউন্নয়ন ও জনপরিকল্পনার মাধ্যমে বাঁধগুলোকে আরো মজবুত করা খুবই জরুরি। তাহলে হয়তোবা প্রতিবছরের নানান দুর্যোগের কবল থেকে উপকূলীয় এলাকা কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। রক্ষা পাবে উপকূলীয় এলাকার মানুষের আশা ভরসা!