ড্রাইভার থেকে আদর্শ কৃষক সৈলেশ দালবৎ

নেত্রকোণা থেকে শংকর ম্রং

দীর্ঘ ৩৮ বছর দক্ষতার সাথে ড্রাইভারের চাকরী করে অবসর গ্রহণের পরও বসে নেই সৈলেশ দালবৎ (৬২)। নিজের ৪.৮০ একর জমিতে গড়ে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় ফসলের বাগান। তাকে দেখে এলাকার সমবয়সি লোকেরাও বাগান করায় আগ্রহী হচ্ছে। বাগান করার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলছেন চার কন্যা সন্তানকে।
সৈলেশ দালবৎ এর বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার ৯নং অরনখোলা ইউনিয়নের বিএএফ ফায়ারিং রেঞ্জ সংলগ্ন ও টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক সংলগ্ন টেলকী গ্রামে। জাতিতে সৈলেন দালবৎ গারো নৃ-গোষ্ঠী ভূক্ত। যদিও বিয়ের পূর্বে তিনি অন্য গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। গারো আদিবাসী সমাজ মাতৃতান্ত্রিক, তাই বিয়ের পর তিনি শ্বশুরবাড়ী টেলকী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। স্ত্রী ও চার মেয়েসহ মোট ছয় জনের সংসার। স্ত্রী জসিন্তা নকরেক মিশনারী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে তিনি কারিতাস বাংলাদেশ নামে একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থায় গাড়ী চালকের চাকরি নেন। ড্রাইভারের চাকরী ও স্ত্রীর শিক্ষকতা থেকে যে সামান্য আয় হতো তা দিয়ে তিনি তার চার মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। একজন দক্ষ ড্রাইভার হিসেবে তিনি কারিতাসে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। দীর্ঘ ৩৮ বছর দক্ষতা ও সুনামের সাথে কারিতাসে ড্রাইভারের চাকরী করে ২০১২ সালে চাকরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

soylesh-dalbot-1

চাকরী থেকে অবসর নিলেও সৈলেন দালবৎ কাজ থেকে কখনো অবসর নেননি। অবসর গ্রহণের পর কারিতাস সংস্থা থেকে প্রাপ্ত জমানো টাকা (প্রভিডেন্ট ফান্ড) দিয়ে তিনি কিছু জমি ক্রয় করে এবং নিজের জমি সহ ৪.৮০ একর জমিতে গড়ে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় ফল ও শস্যের বাগান। যেসব ফসলে সার ও কীটনাশক কম লাগে; তিনি সেসব ফসল তার জমিতে চাষ করেন। তার চাষকৃত ফসলের মধ্যে লেবু, আম, সবরি কলা, পেঁপে উল্লেখযোগ্য। তিন জাতের (কলম্বো লেবু, কাগজি লেবু, পাতি লেবু) মোট ৫৫০০টি লেবু, ১৫০টি লিচু, ৫০টি আম (আ¤্রপলি), ২০টি তেজপাতা, ১টি দারচিনি, ৫টি সজনে, ১০০টি সবরি কলা, ৮০টি পেঁপের চারা রোপন করেছেন। এছাড়াও পঞ্চমূখী কচু, চিন কচু ও শিমূল আলু (কাসাবা) স্বল্প মেয়াদী সাথী ফসল হিসেবে চাষ করেছেন।

ড্রাইভার থেকে সফল কৃষক হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সৈলেশ দালবৎ জানান, চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পূর্বেই তিনি পরিকল্পনা করেন বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করার। কারণ চাকরী থেকে প্রতিমাসে একটি অংকের টাকা পাওয়ার নিশ্চয়টা আছে, কিন্তু অবসর গ্রহণের পর এই টাকা আর প্রতিমাসে পাওয়া যাবেনা। কিন্তু চার মেয়ের পড়ালেখার জন্য প্রতি মাসে নগদ টাকা চাই। নগদ টাকার জন্য যাতে চার মেয়েদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত না হয় সেজন্যই তিনি পরিকল্পনামত এই বৈচিত্র্যময় ফসলের বাগান গড়ে তুলেছেন। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণে একটি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যান্য ফসল দিয়ে সে ক্ষতি পুষিয়েও লাভ করা যাবে। এছাড়াও আন্তঃফসল ও সাথী ফসল চাষ করলে একটি অপরটির সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ফলে রোগ-বালাই বা পোকা-মাকড় প্রাকৃতিক ভাবেই দূর হয়ে যায়। বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের জন্য আলাদা জমি এবং জমি চাষের জন্য আলাদা কোন পূঁজির প্রয়োজন হয়না। শুধুমাত্র বীজের জন্য সামান্য খরচ হয়। আবার একই জমিতে একই মৌসুমে এসব ফসল একসাথে চাষ করা যায়। হলুদ, আদা ও কচু বীজ রোপনের পর পরই শিমূল আলুর ষ্টেম্প ঐ জমিতে রোপন করে শুকনা পাতা দিয়ে মালচিং করে দেয়া হয়। ফলে আগাছা কম হয় এবং পাতা পঁচে জৈব সার হয়। জমিতে একবার নিড়ানি দিলেই হয়। সজনে, লেবু, তেজপাতা, আম, শিমূল আলু, কচু, আদা, কলা ইত্যাদি ফসল ধারাবাহিক ভাবে হওয়ায় প্রতি মাসেই কোন না কোন ফসল বিক্রি করা যায় এবং অর্থ কষ্ট হয়না। বৈচিত্র্যময় ফসলের বাগান করতে তার স্ত্রী জসিন্তা নকরেক তাকে সব সময় সহায়তা করেন।

soylesh-dalbot-2

নিজরে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও তিনি অর্থ উপার্জন করছেন। ইতোমধ্যে তিনি বেশ কিছু টাকাও আয় করেছেন এই বাগান থেকে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে। পরিবারে এসছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। গত মৌসুমে (২০১৫ সালে) হলুদ বিক্রি করে ৪৮,০০০ টাকা, চলতি মৌসুমে লেবু বিক্রি করে ৭০,০০ টাকা, আম বিক্রি করে ১৪০০০ টাকা এবং পেঁপে বিক্রি করে ৩০০০ টাকা উপার্জন করেছন। আগমীতে এই উপার্জন আরো বেশি হবে বলে তিনি আশা করছেন।

বাগান থেকে তিনি শুধু টাকা উপার্জন করছেন তা, কিন্তু নয়। তিনি একই সাথে বাগানের গাছগুলোর বৈচিত্র্য এবং গাছগুলোর দীর্ঘস্থায়িত্বতার দিকে নজর দেন। পাশাপাশি, নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো বিবেচনা করেন তার বাগান পরিচর্যা এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। যেমন: বেশ কিছু পেঁপে গাছ পুরুষ হয়েছে। পুরুষ পেঁপে গাছ বলে তিনি গাছগুলো কেটে ফেলেননি। কারণ পেঁপে ফুল গারো আদিবাসীদের খুব প্রিয় একটি সবজি। পেঁপে ফুল গারোরা খারি রান্না করে খেতে খুব ভালবাসে। তিনি নিজেও নিয়মিত পেঁপে ফুলের খারি খান। পাশাপাশি, ১৯০টি লিচু গাছে (চায়না-৩) এবছর ফুল আসলেও গাছের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ফুলগুলো ছিড়ে ফেলেছেন। তবে আগামী মৌসুমে লিচুর ভাল ফলন পাবেন বলে সৈলেশ দালবৎ বেশ আশাবাদী। পাঁচটি সজনে গাছ থেকে সজনে নিজে খাওয়ার পরও বাজারে বিক্রি করতে পারেন। তিনি নিয়মিত সজনে শাক খেয়ে থাকেন। প্রতি বছর তেজপাতা বিক্রি করে ২-৩ হাজার টাকা আয় করেন। এছাড়াও সৈলেন দালবৎ আন্তঃফসল হিসেবে হলুদ, পঞ্চমূখী কচু ও আদা’র সাথে শতাধিক ফিলিপিনি শিমূল আলু (কাসাবা) চাষ করেছেন। এ বিষয়ে সৈলেশ দালবৎ বলেন,“শিমূল আলু (কাসাবা) চাষ খুবই লাভ জনক। অন্যান্য ফসল চাষের জন্য জমি তৈরি করার পর কোদাল দিয়ে গর্ত কইরা শিমূল আলুর ডাটা (ষ্টেম্প-আট ইঞ্চি টুকরো করে) দুইটা কইরা টুকরা প্রতি গর্তে তেরাইচ্চা (আরাআরি) কইরা গর্তে রাইখামাটি মাটি দিয়া ডাইক্কা দিলেই কয়দিন পর চারা হয়। গর্ত করা ও লাগানি ছাড়া এজন্য আর কোন খরচ হয়না। কোন সার বা বিষ দিতে হয়না। গাছ ৪/৫ ফুট লম্বা হইলে গাছের নিচের দিকের পাতাগুলা ছিড়া গোড়ায় ঢাইকা দিলে পাতাগুলা পইঁচা সার হয় এবং আলুর ফলনও বেশি হয়। শিমূল আলু চাষে সার দিলে সিদ্ধ হয়না এবং বাজারেও দাম কম হয়। শিমূল আলু বাজারে নিয়া যাইতে হয়না। পাইকাররা নিজেরা জমি থেকে আলু তুইলা মাইপা দাম দিয়া নিয়া যায়। আমি গত বছর বাড়ি থেকেই ৬০০ টাকা মন ধরে শিমূল আলু বিক্রি করছি। বাজারেও এর চাহিদা অনেক। শিমূল আলু আমরা সিদ্ধ কইরা নাস্তা খাই। এছাড়াও তরকারী, আটা তৈরী করে এবং চু (এক ধরণের পানিয়) তৈরি করে খাওয়া যায়।” সৈলেন দালবৎ আরও বলেন, তার কোন উৎপাদিত ফসলই বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে হয়না, বাড়ী থেকেই সব বিক্রি করা হয়। তিনি জমির চারপাশে দেশি সবরি কলা রোপন করেছেন।

soylesh-dalbot-3

বিভিন্ন প্রজাতির লেবু, আম, কলা লিচু ইত্যাদি ফলের চারা কোথা থেকে সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে সৈলেশ দালবৎ বলেন, পার্শ্ববর্তী গ্রাম রাজবাড়ী (এক কি.মি. দূরে) থেকে আম, লিচু ও লেবু চারা এবং গ্রাম থেকেই সবরি কলার চারা সংগ্রহ করেন। ফোন করে দিলেই নার্সারী মালিকরা চারা বাড়ীতে পৌছে দেন। রাজবাড়ী গ্রামে লিচু, আম ও লেবুর বড় বড়বাগান আছে। বাগানের মালিকরাই চারা তৈরী করে বিক্রি করে। তারাই চারা রোপনের পদ্ধতি শিখিয়ে যায়।

সৈলেশ দালবৎ শুধু একজন দক্ষ ড্রাইভার ও সফল কৃষকই নয়, সে একজন আদর্শ পিতাও। চাকরীর থেকে প্রতি মাসে উপার্জিত সমস্ত টাকা ব্যায় করেছেন চার মেয়ের লেখাপড়ার জন্য। বড় মেয়ে এইচএসসি পাশ করেছে, দ্বিতীয় মেয়ে মাষ্টার্স পাশ করে নাভানা গ্রুপে চাকরী করছে, তৃতীয় মেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাষ্টার্স করে ব্যুারো বাংলাদেশ নামের জাতীয় পর্যায়ের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছে। সবচেয়ে ছোট মেয়েটি ঢাকা সিটি কলেজে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স পড়ছে।
সৈলেশ দালবৎ আরও জানান, তিনি জমিতে কম রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকেন। তার মতে, সবাই যদি পরিমান মত জমিতে সার ব্যবহার করেন এবং বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করেন তাহলে সারা বছর কৃষকের হাতে টাকা থাকবে এবং কৃষকরা প্রাকৃতিক কারণে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা। মানুষ পাবে বৈচিত্র্যময় খাবার এবং প্রাণবৈচিত্র্য আরও সমৃদ্ধ হবে। কৃষকরাও হবে স্বাবলম্বী।

happy wheels 2