জীবন জীবনের জন্য

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

মাজবদ্ধ হয়ে বাস করা বাংলাদেশের মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। সামাজিকভাবে অবস্থান কারে একে অপরকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। বিপদে পাশে দাঁড়ান। এই প্রথা এখন শুধু নিজ গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়; ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামান্তরে। মানুষ নিজের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য দিন রাত ব্যস্ত থাকেন। তার এই চাহিদা পূরণে সহযোগিতা করার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সমাজের অন্যান্য মানুষেরও কিছুটা দায়বদ্ধতা থাকে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই একজন এগিয়ে আসেন অন্যজনের সহায়তায়। সচেতন মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় মানবিক মূল্যবোধের। অস্থির পরিবেশ, বিশৃংখল জীবনযাপনের ভীড়ে মানবিকতা বিষয়টি যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করেই নেত্রকানার কোনাপাড়া গ্রামের জৈব কৃষাণী দলের সদস্য নাজমা আক্তার তাঁর মতো মানুষকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেন। সম্প্রতি ঘিডুয়ারী গ্রামের একজন কৃষাণী আছিয়া আক্তারকে নিজের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। রক্ত দিয়ে তিনি ওই রোগীর সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু সহযোগিতাই করেননি; বরং তাদের পরস্পরের মধ্যে একটি সৌহার্দ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একে অন্যের সুখ-দুঃখে তারা এগিয়ে আসেন।

nazma
নাজমা আক্তার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের ঘিডুয়ারী গ্রামের বাসিন্দা আছিয়া আক্তরকে রক্ত দিয়েছেন। আছিয়া আক্তার প্রায় আড়াই বছর ধরে তিনি কঠিন অসুখে আক্রান্ত হন। নেত্রকোনা শহরের গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলে তাঁর ‘ফিস্টুলা’ রোগ ধরা পড়ে। ডাক্তার তাঁকে অপারেশন করার কথা বলেন। অপারেশনে রক্তের প্রয়োজন হবে। কারণ অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে তখন তাঁর শরীর প্রায় রক্তশূন্য। আছিয়া আক্তারের রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। ডাক্তার বলেছেন চার ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। পরিবারটি নানা পরিচিত জনদের সাথে রক্তের জন্য যোগাযোগ শুরু করে। শুধুমাত্র তাঁর এক ছেলের রক্তের সাথে মিলেছে। নিজ গ্রামেও এই গ্রুপের রক্তদাতা কেউ নেই। বাকি তিন ব্যাগের রক্তের জন্য তাঁর আত্মীয়রা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করেন। এক পর্যায়ে তারা নাজমা আক্তারের সাথে পরিচিত হন। নাজমা আক্তারের রক্তের বি পজেটিভ জেনে আছিয়া আক্তারের স্বজনরা তাঁকে রক্ত দেওয়ার অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে সাড়া দেন নাজমা আক্তার।

কিভাবে নাজমা আক্তারের সাথে আছিয়া আক্তারের স্বজনরা পরিচিত হন জানতে চাইলে তারা জানান, আছিয়া আক্তারের ছেলে ঘিডুয়ারী কিশোর কিশোরী ক্লাব এর একজন সদস্য। তার জানা ছিল যে, এ যাবৎ পর্যন্ত যাদের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের তালিকা বারসিক রামেশ্বরপুর রিসোর্স সেন্টার এ সংরক্ষিত আছে। সে বারসিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে তার সমস্যার কথা জানায়। প্রথমে বারসিক নাজমা আক্তার ও তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। নাজমা রক্ত দিতে রাজি হয়। বারসিক তাদের কে কোনাপাড়া গ্রামের নাজমা আক্তারের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয় বলে তারা জানান। এভাবে গত আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ নেত্রকোণা হাসপাতালে আছিয়া আক্তারের অপারেশন করা হয়। নাজমা আক্তার সেখানে গিয়ে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে আসেন। বাকি তিন ব্যাগ রক্ত তাঁর ছেলে, ছেলের বন্ধু ও এক মেয়ে দিয়েছে। সফলভাবে অপারেশন হওয়ার পর আছিয়া আক্তার এখন মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তার পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত নাজমা আক্তারের শারীরিক অবস্থার খবর নিচ্ছেন। রক্ত দানের পর নাজমা আক্তারের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি সুস্থ আছেন। দুই পরিবারের মধ্যে এখন পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

Exif_JPEG_420

ছবি: আছিয়া আক্তার

উল্লেখ্য যে, গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা ধারণা ছিল যে, রক্ত দিলে শরীরের ক্ষতি হয়। নাজমা আক্তার সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি তার সংগঠনের সদস্যদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, রক্ত দিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। একজন সুস্থ মানুষ প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ত দিতে পারেন।
উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী গান “মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে। একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারেনাÑও বন্ধু”। অবশ্যই তা পারে। একজন সচেতন মানুষ অন্যজনের যে কোনো ধরণের বিপদে যদি এগিয়ে এসে তাকে সহযোগিতা করে তবে তা অন্যদের কাছে অবশ্যই দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
বর্তমান সময়ে হিংসা, লোভ, অহংকার মানুষের মনে দানা বেঁেধছে। স্বার্থপর মানুষেরা সব সময় অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টায় থাকে। কেউ কারো জন্য ভালো করতে এগিয়ে আসতে চায়না। কিন্তু নাজমা আক্তারের উদার মানসিকতা আমাদেরকে আশা জাগানিয়া স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। আমরা ভাবতে শুরু করেছি এখনো মনুষত্ব আছে, মানুষ দানব হয়ে যায়নি।

happy wheels 2