বিশ্ব খাদ্য দিবসে খাদ্য নিরাপত্তায় নগর কৃষির গুরুত্ব
রাজশাহী থেকে অমিত সরকার
শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সাধন ও ক্ষয়পূরণের জন্য মানুষ যা খায় তাই তার খাদ্য। পুষ্টি উপাদান অনুযায়ী খাদ্যেরও শ্রেণী বিভাগ আছে। তবে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে হলে দু’টি বিষয়ের উপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমতঃ পুষ্টিকর খাবারের পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকরণ, দ্বিতীয়তঃ সব জনগোষ্ঠির জন্য খাবার প্রাপ্তির সামর্থ্য নিশ্চিতকরণ।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় জীবনটাকে আরও একটু উন্নততর বা আয়েশি করার জন্য বিশ্বব্যাপী চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন অভিঘাত এখন সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। যার পরিণতিতে এ গ্রহটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক চিন্তাবিদ, গবেষক যে আশঙ্কা করছেন তা মানবজাতির সামগ্রিক কর্মফলেরই পরিণতি। পৃথিবী ব্যাপি উন্নয়ন পরিকল্পনা এমনই হওয়া উচিত যার মাধ্যমে বর্তমান অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও নিশ্চিত হয় আবার প্রকৃতি, পরিবেশ এবং ইকোসিস্টেমের ওপর যেন কোন ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে বর্তমান উন্নয়ন চালিয়ে যাওয়া।
নগরায়ন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলীর একটি। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মৌলিক, মানবিক এবং যুগোপযোগী চাহিদা পূরণের নিমিত্তে গ্রামাঞ্চল ধ্বংস করে নিত্য নতুন শহর গড়ে তোলা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্রই। আমাদের দেশও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। নগরায়নের সুফল পাবার আশায় লাখে লাখে বনভূমি ধ্বংস করে স্থাপন করা হচ্ছে মার্কেট, অফিস-আদালত সহ নানামুখী প্রতিষ্ঠান ভবন।
খোদ জাতিসংঘের ভাষ্য মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শহরে বাস করবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির শহুরে জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে। নগরায়নের এই আধিক্যের ভিড়ে আমরা হারাচ্ছি আমাদের পর্যাপ্ত কৃষিজ জমি, উর্বর ভূমি এবং বিশাল পরিমাণে বৃক্ষ সম্পদ।
তাই ভবিষ্যতের সুন্দর জীবন ও জীবিকার ধারা অব্যহত রাখতে এবং বিশাল জনসংখ্যার শহরমুখী হওয়ার দরুণ সৃষ্ট কৃষি জমি এবং উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ করতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এক্ষেত্রে একটি সুন্দর সহজ সমাধান হিসেবে আমরা তুলে ধরতে পারি নগর কৃষির অপার সম্ভাবনার কথা।
রাজশাহী নগরের বহরমপুর,দাসপুকুর, শ্রীরামপুর, কাসিয়াডাঙ্গা,নামোভদ্রা এবং রুপালি বস্তিসহ বিভিন্ন বস্তিতে এখন ক্যারেট, টব পদ্ধতিতে এবং গর্ত করে মাটি শোধন করে সবজি চাষ করছেন অনেকে। ভূমিহীন মানুষ শহরে তাঁদের ঘরের পাশে পুঁইশাক, শাক, লাউ, সীম, মরিচ, বেগুনসহ নানা জাতের সবজির চাষ করছেন। এ বিষয়ে দাসপুকুর বস্তীর মধুমালা বলেন, ‘আমাদের অনেক উপকার হচ্ছে, সবজি চাষ করে আমরা নিজে খেতে পাচ্ছি এবং এই সবজির গাছ চালাতে তুলে দেবার কারণে ঠান্ডা এবং গরম দুটো থেকেই কিছুটা হলেও রেহাই পাই।” তিনি আরো বলেন, ‘এর ফলে আমাদের শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। বাচ্চাদের রোগবালাই কম হচ্ছে। আবার নিজেরা বিষমুক্ত শাকসবজি খেতে পাচ্ছি।’
একই বস্তির জহুরা বেগম বলেন, ‘আমার বাড়িতে সীম গাছ মরিচ গাছ ও বেগুন গাছ আছে আমার সারাবছর মরিচ কেনা লাগেনা। আমার সীম গাছে অনেক সীম ধরে যা আমার পরিবারের হয়েও বেঁচে যায়। যার বাড়িতে সীম নেই লাউ বা অন্য সবজি আছে যেটা আমার নেই তাকে হয়তো একটু সীম দিয়ে ওই সবজিটা নিয়ে আসি এতে করে আমার বাজার থেকে খুব একটা সবজি কিনে খেতে হয়না।”
ভদ্রা এলাকার রুপালি বস্তীর মমতাজ বেগম(৫২+) স্বামী প্যারালাইজড রুগী একটি মাত্র ছেলে রিক্সা চালিয়ে ছেলে বৌসহ চারজনার পরিবারের খরচ চালান। ঔষধ চিকিৎসা ও খাবার খরচ শুধু একজনের রিকশা থেকে আসা আয় দিয়ে চালানো কঠিন হয়ে পরে। মমতাজ বেগম তার ছোট জায়গার মধ্যেই ক্যারেট, টব ও গর্ত করে মরিচ,বেগুন,লাউ,ওল,মিষ্টি কুমড়ার গাছ রোপণ করেন। যা থেকে তার পরিবারের সবজির চাহিদা মেটানোর পরও বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করছেন। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে রাজশাহী শহরের বস্তিগুলোতে।
নগর কৃষি সরাসরি পরিবেশের সাথে জড়িত হওয়ায় এটি মাটির উর্বরতা রক্ষা, পানির গুণগতমান নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বৃষ্টির পানির সংগ্রহ, পানি পুনর্ব্যবহার, জৈব সার তৈরি ও ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতাকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। কেননা যখনই কোনো মানুষ নিজের বাড়ির উঠোনে কিংবা ছাদে কৃষিকাজ করতে চাইবে, তখনই সবচেয়ে সহজ এবং বারবার উপকৃত হওয়া যায় এমন কার্যকর পদ্ধতিগুলোই জানতে আগ্রহী হবে এবং সেসবই ব্যবহার করবে।
নগরের বাড়িগুলোতে হয়তো মাঠফসল (ধান, গম, ভূট্টা ইত্যাদি) চাষ করা সম্ভব হবেনা, তবে প্রায় সব ধরনের শাকসবজি এবং বিভিন্ন ফলমূল চাষ করে আমরা আবাদী জমিতে এসব চাষের চাপ কমিয়ে আনতে পারি। নগরকৃষি প্রতিটি দেশেরই মোট কৃষি জমির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, অল্প জমি ব্যবহার করেই একটি দেশের কোটি কোটি মানুষকে কীভাবে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো সম্ভব, তা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান যেমন হয়ে যায়, তেমনভাবেই ভবিষ্যতের জন্যও খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে উঠে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দিতে উৎপাদনের বৈচিত্র্যতা আনয়ন ও খাদ্য ব্যবস্থার সুষম বণ্টনের দিকে নজর দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অনিশ্চিত সময়ে খাদ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনাকে অটুট রেখে মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বিশ্ব খাদ্য দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক বিশ্বব্যাপী সংহতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে সমগ্র জনগোষ্ঠিকে খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা, পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলা এবং খাদ্য উৎপাদনে নিয়োজিত মানুষের যথাযোগ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণেও কাজ করা এবং সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
ff