কেউ দেখে শিখে কেউ ঠেকে শিখে

মো. শহিদুল ইসলাম ও সিলভানুস লামিন

গ্রামটির নাম বড়শিপাড়া। কৌতুহল উদ্দীপক একটি নাম। ভাবি, নিশ্চয়ই এই গ্রামে যারা আগে বসবাস করতেন তারা বড়শি দিয়ে মাছ ধরতেন এবং জীবিকা নির্বাহ করতেন। আশপাশে চেয়ে দেখি কোন নদী আছে কি না! তবে খাড়ি ও বিচ্ছিন্ন কিছু স্থানে পুকুর ছাড়া আর কোন কিছুই চোখে পড়েনি আমাদের! তাহলে গ্রামের নাম বড়শিপাড়া কেন হলো? যাই হোক, স্থানীয়দের সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারি এই গ্রামের আদি বাসিন্দা ছিলেন আদিবাসীরা! কিন্তু কালের পরিক্রমায় দেশ বিভাগের সময় এখানে ভারতের মালদহ থেকে বাঙালিরা এসে বসবাস শুরু করেন। এভাবে গ্রামটিতে ধীরে ধীরে আদিবাসীদের সংখ্যা কমতে থাকে। বর্তমানে গ্রামটি একটি বাঙালি প্রধান পাড়া হিসেবে পরিচিত। তবে আদিবাসীদের রেখে যাওয়া নামটি এখনও রয়েগেছে। আদিবাসীদের ভাষায় নিশ্চয়ই ‘বড়শি’ শব্দটির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ রয়েছে। জানতে খুব ইচ্ছে করে। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানতে পারি, আদিবাসীরা এখনও পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি এলাকাটি থেকে। কেননা গ্রামটির আশপাশের পাড়াগুলোতে এখনও আদিবাসী সাঁওতাল, মুন্ডাদের ‘বাস’ রয়েছে। কোন একসময় তাদের কাছ থেকেই ‘বড়শি’ শব্দটির অর্থ জানার চেষ্টা করবো ভাবছি!

বড়শিপাড়ার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। গ্রামটির পাশেই লম্বা সবুজ খাড়ি, উচু-নীচু জমি, ছোট বড় পুকুর রয়েছে। গেড়ুয়া রঙের মাটির রাস্তা পাড়ি দিয়েই গ্রামটিতে যেতে হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের সব বৈশিষ্ট্যই এই গ্রামটিতে ধরা পড়েছে। এই গ্রামটিতেসহ একসময় পানি সমস্যা প্রকট আকারে ছিলো বরেন্দ্র অঞ্চলে। তবে বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের পর এলাকায় পানি প্রাপ্তি বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে। পানির অপচয় হচ্ছে অহরহ। অন্যদিকে সহজে পানি পাওয়ায় বড়শিপাড়ার বাসিন্দারা পুকুর ও খাড়িসহ অন্যান্য ভূ-পৃষ্ঠের পানি আর ব্যবহারই করেন না! উপরোন্তু ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে তাদের পানি সমস্যা সমাধান হলেও এ পানির সুষ্ঠু ব্যবহারসহ নানা কারিগরি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মোঃ বকুল মিয়া বলেন,  “আমরা সুখেও আছি দুঃখেও আছি। তবে মাঝে মাঝে দুঃখ কাটানোর শক্তি থাকে না। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের সমস্যা হয়ে যায়। এই যেমন কয়েক দিন আগে তিন দিন বিদ্যুৎ ছিলো না, মটর দিয়ে পানি তোলা যায়নি, আমারা সকলে পাশের গ্রামের টিউবয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করে খেয়েছি, ব্যবহার করেছি।” একই সুরে কথা বলেন মো. গোলাম আরিফ। তিনি বলেন, “আমাদের গ্রামে কোন টিউবয়েল আর নেই। আগে ছিলো, কিন্তু বিএমডি ২০০৪ সাল থেকে ট্যাপ দেওয়ায় সেগুলো আর ব্যবহার করা হয় না বা কোন গুরুত্ব না দেয়ায় সেগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেছে। আশপাশের পকুরগুলো থেকে আগে পানি দিয়ে অনেক ধরনের ব্যবহার করা হতো, কিন্তু সে পুকুরগুলোও বর্তমান যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।”
14456802_10205357523977962_1592367708_o
মো. বকুল মিয়ার বারান্দায় সংঘটিত আলাপচারিতায় অংশগ্রহণকারী একে একে তাদের নানান সমস্যা ও অভিজ্ঞতার কথা জানান। তবে আলাপচারিতায় পানি প্রসঙ্গটিই ঘুরেফিরে আসে। সহজে পানি পাওয়ায় ফসল ফলাতে সহজ হয়েছে স্বীকার করেছেন সবাই তবে ভূ-গর্ভস্থের পানি উত্তোলনের কারণে পানি স্তর আরও নীচে নেমে গেছে বলে জানান বেশ ক’জন। এছাড়া উত্তোলিত পানি পানেও নানান সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন নাজেরা বেগম। তিনি বলেন, “গরমের সময় ভূগর্ভের পানি থাকে ঠান্ডা, আবার ঠান্ডার সময় গরম, আল্লাহতালার এই নিয়ামত আমারা পাই না। বিএমডিএর ট্যাংকে পানি উত্তোলন করা হয় একবারেই। এই কারণে গরমের সময় অনেক গরম হয়ে যায় পানি। আবার ঠান্ডার সময় অনেক ঠান্ডা হয়ে যায়।” পানিতে আয়রণের উপস্থিতির কথাও তিনি তুলে ধরেছেন অনেকে। তাদের ভাষ্যমতে, “পানি স্বচ্ছ হলেও ভীষণ আঠালো আর আয়রন বেশি। পানির এমন অবস্থায় শরীরে সাবান আর মাথায় শ্যাম্পু ব্যবহার করতেই হয় নিয়মিত। এতে করে আমাদের খরচও বেড়ে গেছে।” তারা জানান, পানিবাহিত রোগও বেড়ে গেছে। জন্ডিস, কিডনী রোগ, মাথার চুল পড়া এসব রোগ আগে কদাচিৎ দেখা দিলেও এখন এগুলো নিয়মিত দেখা যায়। অন্যদিকে আসমা বেগম (৪৫) বলেন-“স্থায়ী পানির যোগান দিতে কিছু সহায়তাকারী সংস্থা টিউবয়েল দিলেও তা নিজেদের ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় অকেজো পড়ে থাকে বা নষ্ট হয়ে যায়। কয়েকদিন পানি উঠলেও তা কিছুদিন পরে নষ্ট হয়ে যায়।”

আমাদের আলাপচারিতায় ‘পানি প্রসঙ্গ’ থেকে বিরতি নিয়ে আমরা এলাকার পরিবেশ-প্রকৃতির দিকে ধাবিত হই। বড়শিপাড়ায় নানান ধরনের গাছপালা দেখা যায়। তবে নিম গাছই সংখ্যাধিক্য। নিমসহ অন্যান্য গাছের প্রাচুর্যতায় গ্রামের আশপাশে, কৃষিমাঠে, আকাশে নানান ধরনের পাখির বিচরণ চোখে পড়ে। এত পাখ-পাখালির বিচরণ সত্যিই গ্রামটিকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। পানির প্রাপ্যতায় চারদিক সবুজ আভা তো রয়েছেই। এই সবুজ আস্তরনের পাশাপাশি পাখির কিচিরমিচির ডাক অনন্য করে তুলেছে গ্রামটিকে। পাখির এত স্বাধীন বিচরণ খুব কমই দেখেছি সম্প্রতি। তাই জানার আগ্রহ ছিলো কীভাবে এতগুলো পাখির সমাগম হলো এই গ্রামটিতে। উত্তর আসলো,“এখানে কেউ পাখি শিকার করে না।” পাখি শিকারে কেউ কোনদিনও বাধা না দিলেও গ্রামবাসীরা মনে করেন পরিবেশ ও প্রকৃতির কল্যাণের জন্য এসব পাখির থাকা দরকার। গ্রামটিকে আরও সবুজায়ন করার পরিকল্পনা করেছেন এলাকার যুবকরা। আলোর পথে তরুণ সংঘ নামে একটি যুব সংগঠন রয়েছে এই গ্রামে। পৃথিবীতে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গ্রামের অনাবাদী জমি, পতিত জমিতে গাছ রোপণ করার।  সম্প্রতি তারা এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়নও করেছে। এই প্রসঙ্গে হাসান হাবিব বলেন, ‘আমারা এখন নিজ থেকেই নিজেদের প্রয়োজনে নিজের মতো করে কিছু উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছি, আমারা গ্রামটিতে সবাই মিলে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করছি, পানির স্থায়ী সমাধানের জন্য আমাদের মতো করে টিউবয়েল বোরিং করার জন্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করছি।’ তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন ঠেকে শিখেছি।”

আমাদের আলাপচারিতায় ‘উন্নয়ন’ প্রসঙ্গটিও ধরা দিলো। এই এলাকায় নানান উন্নয়ন সংগঠন কাজ করেছে। কখনও কখনও এসব উন্নয়ন কর্মকান্ড সাময়িক উপকার করলেও দীর্ঘ পরিসরে এলাকাবাসীর জন্য ‘দুর্যোগ’ হিসেবে দেখা দেয়। এই প্রসঙ্গে  সাবেক চেয়ারম্যান মো. তৈয়বুর রহমান বলেন, “নানামুখী উন্নয়ন কাজ হয়ে থাকে আমাদের এখানে, কিন্তু কোনটা আমাদের জন্যে প্রযোজ্য সে সম্পর্কে আমাদের মতামত কখনও গ্রহণ করা হয় না। আমরাও কিছু না বুঝে সাময়িক লাভের আশায় সেটা লুফে নিই। কিন্তু পরে দেখা যায় সেটি আর কাজে লাগে না। এর ফলে একদিকে অর্থ নষ্ট হয়, অন্যদিকে যে লোকগুলোর জন্যে এই কাজ করা হয় তাদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়।” তার ভাষ্যমতে, যে এলাকায় উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয় সেই এলাকার মানুষের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। কারণ এলাকার মানুষই ভালো জানে তাদের সমস্যা কি এবং কীভাবে এসব সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।

বড়শিপাড়া মানুষের সাথে আলাপচারিতা এই বার্তাই আমাদেরকে দিয়েছে যে, যাদের জন্য উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো পরিচালনা করা হয়েছে সেই উন্নয়ন কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহণ যেমন জরুরি ঠিক তেমনি সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় তাদের মতামত ও পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

happy wheels 2