জেলে জনগোষ্ঠীর অনুপ্রেরণার নাম বিমল চন্দ্র
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা জেলা সদরকে মায়ের মতো এক সময় আগলে রাখতো মগড়া নদী। একসময় নেত্রকোনার মানুষের যাতায়াত এবং এক স্থান থেকে অন্যত্র মালামাল পরিবহন হতো নৌ পথে। নেত্রকোনা জেলা সদরের ভিতর মগড়া নদীতে ছোট বড় অনেক নৌকা ও লঞ্চ ভিড় করতো বলে গড়ে ঊঠে ছিল লঞ্চ ঘাট। যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ফলে সেই লঞ্চ ঘাট এখন শুধুই স্মৃতি। লঞ্চ ঘাটের উপর দিয়ে তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তা, যার বর্তমান নাম মালনী রোড। লঞ্চ ঘাটের আশপাশে গড়ে উঠেছে বড় বড় চাউলের গোডাউন, পাটের গোডাউন, পানের আড়ত, সিঁদলের (শুটকী মাছের) আড়ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটটি সচল ছিল। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে লঞ্চ ঘাটের সিঁদল তৈরির এক আড়তে কাজ করতেন আমতলা ইউনিয়নের পঞ্চননপুর গ্রামে জেলে বিমলচন্দ্র সরকার।
সময়ের সাথে সাথে নেত্রকোনা সব কিছু বদলেছে দ্রুততার সাথে, বদলেছে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা। তখনকার খর¯্রােতা মগড়া নদী এখন মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে, যেখানে লঞ্চতো দুরে থাক ছোট কোন ডিঙ্গী নৌকাও চোখে পড়ে না। শুটকী তৈরির আড়তের কার্যক্রমও নেই।
বিমল চন্দ্রের জীবন কিন্তু তাই বলে থেমে থাকেনি। সবকিছুর পরিবর্তনের সাথে সাথে বিমল চন্দ্রের জীবনেরও ব্যাপক পরির্তন হয়েছে। তিনি চট্রগ্রাম থেকে শুটকী মাছ নিয়ে এসে তা দিয়ে সিঁদল তৈরি করে বিক্রির ব্যবসা আরম্ভ করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রতি মাসে কয়েক লক্ষ টাকার শুটকী মাছ কিনে নিয়ে আসেন। কার্তিক মাস থেকে শুটকী মাছ আসা আরম্ভ হয় এবং বৈশাখ মাসে গিয়ে শেষ হয়। যে সময়টিই সিঁদল তৈরীর উপযোগি সময়। বিমল চন্দ্র বাড়ির এক পাশে সিঁদল সংরক্ষণের জন্য একটি গোডাউন তৈরি করেছেন। গোডাউনে তিনি প্রতি বছর কয়েকশত মাটির তৈরি মটকিতে শুটকী ভরেন সিঁদল তৈরির জন্য। সাধারণত সিঁদল তৈরি করা হয় মাটির বড় মটকায়। সিঁদল তৈরির কারখানায় মৌসুম অনুযায়ী ৩ থেকে ৪ জন লোক কাজ করে মাটির মটকায় সিঁদল তৈরির জন্য শুটকী ভরায়। মাটির মটকায় শুটকী ভরা সম্পর্কে বিমল চন্দ্র বলেন, “অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ মটকা তৈরি, আমার এখানে যারা মটকা ভরার কাজটি করে তাদের মধ্যে একজন নেত্রকোনার, বাকি দুইজন মোহনগঞ্জ ও মদন উপজেলার।’
এ বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ হওয়ায় তারা মৌসুম অনুযায়ী নেত্রকোনা প্রতিটি আড়তে চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেন। প্রতি মটকা ভরার জন্য প্রতিজনকে দিতে হয় ১২০ টাকা। সন্ধ্যার পর থেকে শুকনা মাছ ৪ থেকে ৫ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে চাটাই/পাটিতে করে বাতাসে শুকাতে হয় মাঝ রাত পর্যন্ত। রাত ৩টা পর্যন্ত পানি শুকানোর পর মাঝ রাতে ভালো করে হাত পা ধুয়ে অত্যন্ত যত্নের সাথে মটকা ভরার কাজ শুরু হয়। প্রতিটি শুকনা মাছ মটকার ভিতর ভাজে ভাজে এমনভাবে রাখা হয়, যাতে মটকায় বাতাস ঢোকার কোন ফাকা জায়গা না থাকে। মটকায় মাাছ ভরার সময় মটকার ভিতরের মাছগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরার কাজটি খুবই কষ্টের, হাতে কাটা লেগে হাতের চামড়া পাতলা হয়ে যায়। মটকার মুখ অবধি ভরার পর শুটকী মাছের গুড়ো দিয়ে মটকার পুরো মুখটার উপর কাদা মাটির প্রলেপ দিয়ে লেপে দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা এ কাজটি করে তারা প্রতি রাতে ৫-৬টি মটকা ভরতে পারে। এভাবে এক থেকে দেড়মাস পর মটকার মুখ খুলে যে মাছ বের করা হয় সেটিই বাজারে সিঁদল হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের ধনী-দরিদ্র সকলের নিকট সিঁদলের ভর্তা বা তরকারী অত্যন্ত প্রিয় একটি খাবার, বর্তমানে বাজারে ৪০০-৬০০ টাকা কেজি দরে সিঁদল বিক্রি হচ্ছে।
যার জন্য আজ সিঁদল নিয়ে আলোচনা সেই বিমল চন্দ্র স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর পিতামাতাকে হারিয়ে একমাত্র ভাইকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে একটু বোঝার বয়স থেকেই নেত্রকোনার একটি বড় মাছের আড়তে সিঁদল তৈরির কাজ শুরু করেন। কার্তিক-বৈশাখ মাস পর্যন্ত মাছ ধরা এবং বিক্রির উপযুক্ত সময়। এ সময় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলায় শুকনা মাছ কেনা বেচা হয়। বাংলাদের বিভিন্ন এলাকার সিঁদল ব্যবসায়িরা শুটকী মাছ সংগ্রহের জন্য নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ বাজারে জড়ো হয়। মহনগঞ্জের শুটকীর মোকামে বিভিন্ন নদী ও হাওরের মাছ নদী পথে মাছ ব্যবসায়ীরা বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। বিমল চন্দ্র তার মনিবের সাথে মাছ কেনা ও সিঁদল তৈরির কাজে সহায়তা করতেন। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে মাছের আড়তে মাছ ধোয়া ও মাটির বড় মটকা ভরার কাজ শুরু করতেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন,“আমি ভোর বেলায় যেতাম এবং গভীর রাতে বাড়ি ফিরতাম। সারা দিনে এক বেলা খেতাম, সিঁদলে মটকা ভরতে ভরতে হাত দিয়ে রক্ত পড়ত। মাস শেষে যা পেতাম তা দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চলত।”
বিমল চন্দ্রের পাঁচ ছেলে-মেয়ে (মেয়ে-৩ ও ছেলে-২ জন)। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে অন্যের আড়তের কাজ তিনি ছেড়ে দিয়ে নিজেই সিঁদলের ব্যবসা আরম্ভ করেন। বড় মেয়ের বয়স তখন ১০ বছর এবং অন্য ছেলে-মেয়েরা ছোট। তিনি অনুধাবন করেন যে, অন্যের আড়তে সিঁদল তৈরির কাজ করে আঁধা পেটা খেয়ে বেঁচে থাকা যাবে, কিন্তু নিজের জীবনের কোন উন্নতি হবে না। তিনি এ কষ্টের জীবন থেকে নিজেকে এবং সন্তানদের মুক্ত করার স্বপ্ন দেখতেন। দারিদ্রতা দূর করতে হলে সন্তানদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে হবে। তাই স্বপ্ন পুরণের আশায় তিনি নিজেই সিঁদল তৈরি করে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।
নিজের কোন পুঁজি না থাকায় স্থানীয় এনজিও থেকে ২০০০ হাজার টাকা ঋণ কয়েকটি মাটির মটকা ও কিছু শুকনা মাছ কিনে প্রথমবারের মত সিঁদল তৈরি করে বাজারে বসে খুচরায় বিক্রি আরম্ভ করেন। পরের বছর মোহনগঞ্জ হাওর এলাকার পরিচিত মাছ ব্যবসায়ীদের থেকে বাকিতে মাছ সংগ্রহ করে স্ত্রী ও বড় মেয়ের সহায়তা নিয়ে বাড়িতেই সিঁদল তৈরি করেন। অভাবের তারনায় বড় মেয়ে পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ার পর আর পড়তে পারেনি তাই সে বাবার কাজে সহায়তা করতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে বাবার সিঁদলের ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে।
এ ব্যবসা থেকে তিনি যা আয় করেন সে টাকায় অন্য চার সন্তানদের লেখাপড়া করাতে থাকেন। অভাবের জন্য এক সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হলেও বাকি চার সন্তানদের আর কষ্ট করতে হয়নি। কঠোর পরিশ্রম বিমল চন্দ্রকে নেত্রকোনার একজন বড় সিঁদল ব্যবসায়ী হিসেবে সকলের নিকট যেমন পরিচিতি এন দিয়েছে,তেমনি সন্তানদের সু-শিক্ষা তাকে পৌছে দিয়েছে সমাজের একটি সম্মানজনক স্থানে। তার বড় সন্তান চট্রগ্রাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাষ্টার্স শেষ করে বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তৃতীয় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাস পড়ছে। ৪র্থ ছেলে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করে মেডিকেলে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। বাংলাদেশে ক্রমশ বিলুপ্তপ্রায় পেশাগুলো এখনো ধরে রেখে যেসব সংগ্রামী মানুষগুলো নিজেদের স্বপ্ন পূরণে সফল হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন বিমল চন্দ্র। যার জীবন সংগ্রাম অন্যদের অনুপ্রেরণা যোগাবে।