জৈব সার মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখে

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান

একটি সময় ছিল জমিতে কোন ধরনের রাসায়নিক, সার কিটনাশক এর ব্যবহার ছাড়াই অধিক ফসল উৎপাদন হতো। প্রকৃতিনির্ভর কৃষি কাজে পুকুর, ডোবা, নদী,নালায় বর্ষার পানি ব্যবহার করে সেচ দেওয়া হতো, সময় মত বর্ষা হওয়ায় জমিতে পলি পড়তো, মাটি থাকতো উর্বর, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকতো, কৃষকরা ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্যময় মৌসুমি ফসল চাষ করে লাভবান হতো। কিন্তু শিল্পান্নোত দেশগুলোর অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ও দেশীয় শিল্প উন্নয়নের নামে কৃষি জমিতে গড়ে উঠা, মিল কারখানা, ইটের ভাটা,অপিরকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণের নামে বৃক্ষ নিধনের ফলে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সময় মত বর্ষা না হওয়ায় কৃষি জমিতে পানি প্রবেশ করতে পারে না, মাটিতে পলি পড়ে না মাটি থাকে অনুর্বর। তাছাড়া আমাদের দেশে এক সময় জৈবসারই ব্যবহার হতো।

কালক্রমে রাসায়নিক সারের প্রচলনের পর জৈবসারের ব্যবহার অনেকটা কমে গেছে। অধিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য কৃষি জমিতে ব্যবহার করতে হচ্ছে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কিটনাশক। মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতাশক্তি। নষ্ট হচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য। কিন্তু মাটিই ফসল উৎপাদনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা পূরণ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্জনের প্রয়াস মাটিকে কেন্দ্র করেই। মাটিই হচ্ছে কৃষিজ উৎপাদনের একমাত্র মাধ্যম। এক কথায় কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে মাটিই হচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির কারণ। সুতরাং মাটির সুস্বাস্থ্য রক্ষায় এর যথাযথ ব্যবহার ও গুনাগুণ সংরক্ষণের প্রতি আমাদের যত্নবান হওয়া উচিত।

তাই আগামি ও ভবিষৎ কৃষি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতি,পরিবেশ ও কোটি প্রাণের অস্তিত্ব বজায় রেখে স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চায় কৃষক দের উৎসাহিত করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক। বারসিক বিশ্বাস করে যে কৃষি মাটি,পানি,বায়ু পরিবেশের ক্ষতি করে না এমন কৃষি চর্চা সম্প্রসারণ হলে কৃষি হবে নিরাপদ,টিকে থাকবে কোটি প্রাণ। তাই মাটি স্বাস্থ্য ঠিক রেখে কৃষি কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এমন কৃষি চর্চায় কৃষকদের উৎসাহিত ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরাপদ, স্থায়িত্বশীল ও পরিবেশসম্মত কৃষি চর্চা বৃদ্ধিতে সম্প্রতি সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের বাংগালা নব কৃষক কৃষাণি সংগঠনের কৃষক কৃষাণিদের নিয়ে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিচর্যা বিষয়ে এক প্রশিক্ষণ আয়োজন করে বারসিক। মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রেখে কিভাবে পরিবেশসম্মত কৃষি কাজ করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করেন বারসিক কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান।

তিনি জানান, খনিজ পদার্থ-৪৫%,বায়ু-২৫%, পানি-২৫% ও জৈব পদার্থ-৫% নিয়ে মাটি গঠিত হয়। একটি আদর্শ মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব সার থাকা আবশ্যক হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মাটিতে শতকরা ১.৫ ভাগ এবং কোন কোন মাটিতে শতকরা ১ ভাগের চেয়েও কম পরিমাণে জৈব পদার্থ রয়েছে, যা বাংলাদেশের অধিক জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা মেটাতে এক বিরাট হুমকি। জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার কিটনাশক ব্যহারের ফলে মাটির অনুজীব মারা যায়, মাটি চাষের উপযোগি করতে ও মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নতুন অনুজীব তৈরি করতে হবে। ১০ কেজি গোবর,৫লিটার গোচোনা,৫০০ গ্রাম চিটাগুড়,৫০০ গ্রাম বেসন,১ চামাচ টক দই,যে মাটিতে ২০ বছর কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়নি এমন এক মুষ্ঠি মাটি দিয়ে ১০০ লিটার পানির সাথে ভাল করে মিশ্রণ করে নিতে হবে। প্রতিদিন খুলে নেড়ে দিতে হবে এভাবে থাকলে ৭ দিন পর অনুজীব তৈরি হবে।

তিনি জানান, ১০ লিটার পানির সাথে ১ লিটার দ্রবণ মিশিয়ে মাটিতে স্প্রে করলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। জমিতে ইচ্ছামত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতাশক্তি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। জমির অম্লতা এমনভাবে বেড়েছে যে, জমিতে ফসলই উৎপাদন একরকম কঠিন হয়ে পড়েছে। জমির সেই হারানো শক্তি ফিরিয়ে আনতে সবুজ সার তৈরি ব্যবহার করতে হবে।জমিতে ধৈঞ্চা চাষ করে ১৫ দিন রেখে মাটির সাথে মিশিয়ে চাষ দিলে মাটির উর্বরতা বাড়বে।তাছাড়া জৈব সার ব্যবহার এর কোন বিকল্প নেই। জৈব সারে উদ্ভিদের সকল ধরনের খাদ্য উপাদান বিদ্যমান থাকে।আবাদী জমির প্রাণ ফিরিয়ে আনতে এ সার উৎপাদন ও প্রয়োগে কৃষকদের পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষকে সচেষ্ট হতে হবে। এ সার মাটিকে যেমন সতেজ রাখতে পারে তেমনি ফিরিয়ে দিতে পারে আগের প্রাণ।মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।জৈব সার মাটির স্বাস্থ্য ভাল রাখে।

happy wheels 2

Comments