ঘিওরে মুক্তিযোদ্ধা লোকমানের ফটো গ্যালারিতে মানুষের ভীড়
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ থেকে
মানিকগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরের এক অবহেলিত নিভৃত পল্লী গ্রাম আশাপুর। গ্রামের ভাঙাচোড়া মেঠো পথ ধরেই যেতে হয় মুক্তিযোদ্ধা লোকমানের বাড়িতে। কালিগঙ্গার পাড় ঘেঁষা সেই বাড়িটিই এখন মানিকগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের ছবির যাদুঘর। যুদ্ধকালীন সময় যারা শহীদ হয়েছেন এবং যারা এখনো জীবিত আছেন তাদের বেশির ভাগ ছবিই লোকমান হোসেনের এই ফটো গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে। বাড়ির ছোট একটি ঘরে লোকমান হোসেনের বসবাস। ঘরের ভেতরের টিন সেটের বেড়ার চারিদিকে চোখ বুলালেই শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আর ছবি। গুণে শেষ করার মতো নয়। আর এই ছবি ঘরের ভেতর ধারণ করেই লোকমান হোসেনের দিন রাত কেটে যাচ্ছে। তার এই ছবির গ্যালারি দেখতে জেলার দুর দুরান্ত এলাকার স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ছুটে যান। বিজয়ের মাসে প্রায় দিন মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেনকে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় নিজ বাড়িতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধাদের ফটো গ্যালারিতে। এক মেয়ে, এক ছেলে, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের ঘরের ৬ নাতি-নাতনী নিয়েই লোকমান হোসেনের পরিবার।
৬শ’র ওপরে মুক্তিযোদ্ধারের ছবি দিয়ে শোবার ঘরেই প্রতিষ্ঠা করেছেন “মুক্তিযোদ্ধা ফটো গ্যালারি”। নিজে যুদ্ধ করেছেন আর সহযোদ্ধাদের স্মৃতি ধরে রাখতেই মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রামের হত দরিদ্র সাহসী মুক্তিযোদ্ধা টাইগার লোকমান হোসেনের অসাধারণ এই উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধের সম্মানী ভাতার অর্ধেকেরও বেশি টাকা তিনি ফটো গ্যালারির কাজে খরচ করে থাকেন।
বারসিক নিউজের এ প্রতিনিধিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন বললেন মুক্তিযোদ্ধারের ছবি সংগ্রহের গল্প। তিনি বলেন, “আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তাদের অনেকে মারা গেছেন,আমরা যারা বেঁচে আছি তারাও যেনো কবে চলে যাই। তাই ২০০৯ সালে উদ্যোগ নিই মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহের কাজে। সেময় কিছু ছবি যখন হাতে পেলাম তখন সেই ছবিগুলো আমার শোবার ঘরের তালাই বাঁশের বেড়ায় সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলাম। এরপর চিন্তা করালাম মুক্তিযোদ্ধারের স্মৃতি সংরক্ষণ কিভাবে করা যায়।” তিনি আরও বলেন, “এভাবে নেমে পড়লাম মানিকগঞ্জে জীবিত ও মৃত মুক্তিযোদ্ধারের ছবি সংগ্রহের কাজে। উদ্দেশ্য একটাই মুক্তিযোদ্ধাদের ফটো গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করবো। পরিচিত সব মুক্তিযোাদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধারের পরিবারের সদস্যদের কাছে বার্তা পৌছে দিলাম। অনেকে আগ বাড়িয়ে ছবি দিলেও আবার অনেকে এই দিচ্ছি করে মাসের পর মাস এমনকি বছর ঘুরিয়েছেন। বিশেষ করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহ করতে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে।” তিনি বলেন, “কিন্তু পিছু ছাড়িনি। বিশ-ত্রিশ মাইল পায়ে হেটেও ছবি সংগ্রহ করতে হয়েছে। ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের অর্থ খরচ করতে হয়েছে। পাসপোর্ট সাইজের ছবি এনে নিজের টাকায় টেন-টুয়েলভ সাইজ বানিয়ে তাতে লেমুনেটিং করেছি। একেকটি ছবির পেছনে দু’শ’ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বর্তমানে ৬শ’ ছবির প্রায় অর্ধেকই আমার নিজের টাকার করা।”
লোকমান হোসেন বলেন, “মানিকগঞ্জের প্রায় বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার ছবি আমার মুক্তিযোদ্ধা ফটো গ্যালারিতে রয়েছে। এখনো যেসব মুক্তিযোদ্ধার ছবি সংগ্রহ করতে পারিনি তাদের ছবি সংগ্রহের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
তিনি বলেন, “জীবনে স্বচ্ছলতা কাকে বলে জানিনা। তারপরও আমার জীবদ্দশায় আমি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি অম্লান করে রেখে যেতে চাই আমার মুক্তিযোদ্ধা ফটো গ্যালারিতে। কোন একসময় এই গ্যালারিতে আমি ছবি হয়ে থাকবো। বর্তমানে আমার নিজের শোবার ঘরের ছোট্ট একটি কক্ষে স্থাপিত ছবির এই গ্যালারি স্থানান্তর করে নিতে চাই আমার নিজের একখন্ড জমির ওপর। সেজন্য চাই সরকারি সহযোগিতা। সরকারিভাবে যদি আমাকে একটি ঘর তৈরি করে দেয় হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধারের স্মৃতি জন্ম-জন্মান্তর থেকে যাবে আমার ফটো গ্যালারিতে।”
মুক্তিযোদ্ধাদের ফটো গ্যালারির গল্প শেষে তিনি স্মৃতিচারণ করলেন, সেই ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর তাঁর জীবনে স্মরণীয় যুদ্ধের ঘটনার। মানিকগঞ্জ জেলার সবচেয়ে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত। মানিকগঞ্জের ঐতিহাসিক সিংগাইর উপজেলার গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক টাইগার লোকমান হোসেন বলেন, “ছোট ছোট অনেক যুদ্ধ করেছি কিন্তু মনের ক্ষুধা মিটছিল না। রক্ত টগবগিয়ে উঠতো। ৭টি বড় বড় নৌকা ভর্তি পাকসেনা নদী পথে সিংগাইরের দিকে আসছে। হাপাতে হাপাতে এ খবর দেয় আমাদের এক সোর্স কিসমত মুন্সি। তোবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে আমরা কেউ একবারের জন্য সরে যাওয়ার কথা ভাবিনি। শত্রুর সংখ্যা এবং অস্ত্র শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য অগ্রবর্তী দল পাঠাই দ্রুততার সাথে। খবরও পাই যথা সময়ে।” তিনি বলেন, “মর্টান মেশিনগান সজ্জিত কয়েকশ পাক সেনারা আমাদের ক্যাম্পর দিকে আসছে। এ খবরে কৌশল পাল্টে গেরিলা কায়দায় হামলার প্রস্তুতি নিই। ধলেশ্বরী নদী থেকে গোলাইডাঙ্গা খাল হয়ে পাকসেনারা পৌছে যায় আমাদের গোলাইডাঙ্গা স্কুলের ক্যাম্পে। তারা আমাদের ক্যাম্পে আসার আগেই আমরা সেখান থেকে বের হয়ে যাই। এসময় গোলাইডাঙ্গা নূর আলী খালের কুম এলাকায়, সেখানে খালের দুই পাড়ে অস্ত্রসহ বসে আছি আমিসহ নবাবগঞ্জের মনছুরের মতো সাহসী যোদ্ধারা।” তিনি বলেন, “শত্রু সেনাদের নৌকা আসামাত্র গর্জে উঠে আমাদের আগ্নেয়াস্ত্রসহ গোলা বারুদ। আমাদের অস্ত্রের বিষ্ফোরণে শত্রুদের ৬টি নৌকা কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ডুবে যায়। এসময় একটি নৌকার শত্রুরা প্রাণে বেচেঁ গেলেও ৬টি নৌকার ৮৩ পাকসেনা মারা যায়।”
মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এই লড়াইয়ে এক সাথে এতোগুলো পাকসেনার মৃত্যুর ঘটনা মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে খুব বেশি নেই।