বৈচিত্র্যময় ফসল চাষে ভূমিকা রাখছেন চরের কৃষকগণ
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
মানিকগঞ্জ ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি জেলা। এই জেলার উত্তর সীমান্তে টাঙ্গাইল জেলা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সিরাজগঞ্জ এর চৌহালী উপজেলা, পশ্চিম দক্ষিণ, এবং দক্ষিণ সীমান্তে যথাক্রমে যমুনা এবং পদ্মা নদী পাবনা জেলা ও ফরিদপুর জেলা থেকে এ জেলাকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
হরিরামপুর উপজেলার পশ্চিমে শিবালয় উপজেলা উত্তরে মানিকগঞ্জ সদর ও ঘিওর উপজেলা পূর্বে ঢাকা জেলার দোহার ও নওয়াবগঞ্জ উপজেলা দক্ষিণে ফরিদপুর জেলা। পদ্মা নদী হরিরামপুর-ফরিদপুরকে দু’ভাগে ভাগ করে রেখেছে। চর, সমতল ও নদী বিধৌত নিচু অঞ্চল নিয়ে গঠিত হরিরামপুর উপজেলা। আনুমানিক ১৯৭০ খ্রি. তেকে ১৯৭৪ খ্রি. সময়কালে হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ ও সুতালড়ি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চর জেগে ওঠে। যার আনুমানিক আয়তন ৭,২০০ একর (প্রায়)। কিছু বিচ্ছিন্ন জনবসতি ব্যতিত সম্পূর্ণ চরই কৃষিজমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2023/12/80895363_470093913653023_4462428659281559552_n-1024x512.jpg)
উর্বর পলি দ্বারা গঠিত চর অঞ্চল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী ভূমি। এছাড়াও সমতল ভূমি পলি মাটির ফলে পুরো হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চল কৃষির এক অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এখানে একদিকে ফসলে নিবিড়তা যেমন বেশি শস্যের বৈচিত্র্য রয়েছে সমানভাবে।
মানিকগঞ্জ জেলার ন্যায় হরিরামপুর উপজেলা সম্পূর্ণ নদী বেষ্টিত উপজেলা। উপজেলা সদরের মূলভূমি থেকে নৌকায় পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে দূর্গম এই চরে যেতে হয়। এখানে প্রতিবছর বন্যার কারণে চরববাসীর ফসলি জমি তলিয়ে যায়। প্রতিবছর বন্যার প্লাবনের পানির সাথে বয়ে আসা পলি-কাদা-বালির কারণে চরাঞ্চলের কৃষি জমির মাটির বুনট, গঠন, সংযুতি ও গুনগতমান পরিবর্তন হয়। এক বছরের উর্বর জমি পরবর্তী বছরের বন্যার প্লাবনে বালিময় হয়ে যায়। তাই কৃষিজমির মাটি ও আনুষাঙ্গিক পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনায় নিয়ে বদলে যাওয়া মাটির ধরন অনুযায়ী চরের কৃষকরা ফসল নির্বাচন করে চাষাবাদ করেন। প্রতিনিয়তই এখানকার কৃষকদের অভিযোজন কৌশল অবলম্বন করে জীবন-জীবিকার তাগিদে কৃষি কাজ পরিচালনা করতে হয়।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2023/12/81092839_566118233967465_2946563872493928448_n-1024x512.jpg)
হরিরামপুর চরাঞ্চলের মানুষের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা বন্যা, খরা, নদী ভাঙন, অতিবৃষ্টি শিলা বৃষ্টি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় চরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি জীবনযাপন করেন। চরের বসবাসের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা, স্থানীয় চর্চা, জ্ঞান-দক্ষতা দিয়েই তাদের অভিযোজন কৌশল কাজের লাগিয়ে চরের বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের মাধ্যমে চরের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। তাদের কৃষি কাজের সমস্যা সমাধানের জন্য চরের গ্রামে গ্রামে স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলেন কৃষক সংগঠন। কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে তারা মৌসুম অনুযায়ী এলাকার কৃষকদের কি ধরনের সমস্যা এবং সমাধানের উদ্যোগ কি হতে পারে সে বিষয়গুলো আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তারা সমাধানের চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে তারা গড়ে তুলেছেন বীজ বাড়ি। সেখান থেকে তারা তাদের স্থানীয় জাতের এলাকার বীজগুলো সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন্ প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে সেখান বীজের যোগান দিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করে থাকেন।
চরাঞ্চলে চাষ উপযোগী ফসলের কৃষি বীজ নিজেদের সংগ্রহে রাখা ও সহজপ্রাপ্তির জন্য ‘লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’ পাটগ্রামচরে হাজেরা বেগমের বাড়ি, উত্তরপাটগ্রমাচরে রাবেয়ার বাড়ি, সেলিমপুর কুলুসম বেগমের বাড়ি, স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র বা কৃষক বীজ ব্যাংক তৈরি করেন। এই কৃষক বীজ ব্যাংকে আউশধান, বাদাম, পায়রা, তিল কাউন ধনিয়া সজ সরিষাসহ বর্তমানে ৫০ ধরনের ফসলের বীজ রয়েছে। পাটগ্রামচর, হালুয়াঘাটা, খরিয়াচর, নটাখোলা, বালিয়াচর বসন্তপুর, গঙ্গাধরদিসহ আশে-পাশের ৮-১০টি গ্রামের মানুষ কৃষকবীজ ব্যাংক থেকে বীজ সংগ্রহ ও বীজ বিনিময় তাদের বীজের চাহিদা মেটান। লেছড়াগঞ্জ চরউন্নয়ন কৃষক সংগঠন’র সভাপতি হাজের বেগম জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের বীজ ছাড়াও কৃষি পরামর্শ, প্রয়োজনীয় নানা তথ্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। চরের কৃষকরা চলতি বছরে কৃষকবীজ ব্যাংক থেকে বীজ নিয়ে বসতবাড়িতে লাউ, মিষ্টিকুমুড়া, চালকুমড়া, ঝিংগা, ধুন্দল, মরিচ, আদা, হলুদ, মুলা চাষাবাদ করে পরিবারে খাবারের চাহিদা মেটানোর পর বাজারে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। তিনি আরও জানান, হালুয়াঘাটাচর গ্রামের কৃষক সাত্তার আলী শীত মৌসুমে তার ৩৩ শতক জায়গায় লাউ চাষ করে ৫৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন।
ইতিমধ্যে চরাঞ্চলে আউশ ধান (পরাঙ্গি), কালামানিক, ধান তিল-কাউন,সরিষা, বাদাম, মাসকালাই, খেসারি কালাই, মুসুর, গম, পায়রা বিভিন্ন ধরনের রবি মেসৈুমে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের মাধ্যমে কৃষক সংগঠনের কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে তারা ভূমিকা রাখছেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2023/12/83360720_2529837217250120_3850477110447570944_o.jpg)
বারসিক এলাকার বীজের সংকট দূরীকরণ, বাজার নির্ভরশীলতা কমানো এবং স্থানীয় জাতের বীজ বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আসছে। তাঁদের নিজস্ব চর্চা বা উদ্যোগগুলোকে গতিশীল করতে সহায়তা করছে। অন্যদিকে বীজ সংরক্ষণের লোকায়ত চর্চা এবং স্থানীয় মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজের লাগিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় বারসিক চরাঞ্চলের মানুষকে নানানভাবে উৎসাহিত করে আসছে। কৃষক সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে সে কারণে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করে। এছাড়া প্রয়োজনীয় কিছু উপকরণ দিয়ে সহযোগিতাও করে থাকে। অন্যদিকে অভিজ্ঞা বিনিময়ের সফরের আয়োজন, বীজ মেলার আয়োজন, বিলবোর্ড প্রদান, অভিজ্ঞ কৃষক দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে আলোচনা সভার মাধ্যমে এ সংগঠন চরাঞ্চলের মানুষকে সহায়তা করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, চর এলাকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমনকি স্থানীয় জাতের অনেক ফসলের বীজের এলাকার মানুষের কাছে থাকে না। বীজ সঙ্কটে পড়তে হয়। এজন্য গ্রামের অনেক মানুষ বাজারমূখী হচ্ছেন এবং বিভিন্ন কোম্পানির বীজ হাট-বাজার থেকে কেনেন। ফলে একদিকে যেমন তাদের স্থানীয় জাতের বীজ বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। অন্যদিকে আর্থিক খরচের পাশাপাশি বীজ কেন্দ্রিক তাদের যে নিজস্ব দক্ষতা, চর্চা ও অভিজ্ঞতা ছিলো সেই চর্চাগুলো হারিয়ে যেতে পারে ।