শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, নিরাপদ খাদ্যও উৎপাদন করতে হবে
রাজশাহী থেকে অমিত সরকার
বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে খাবারের চাহিদা বিপরীতে কমছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। সবুজ বিপ্লবের নামে হাইব্রিড বীজ সার কীটনাশক ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির উপর নির্ভর করে বাড়ানো হয় কৃষি উৎপাদন। খাদ্য নিরাপত্তার নামে এই বিপ্লব কেড়ে নিয়েছে নিরাপদ খাদ্যর সংস্থান। তাহলে কোন দিকে যাবে আগামীর কৃষি, কি করলে পাওয়া যাবে নিরাপদ খাদ্য?
গত কয়েক দশকে খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে আধুনিক সার কীটনাশক নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষমতা দেখালেও হারিয়েছে জমির উর্বরতাশক্তি ও মাটির গুণগত মান। বেড়েছে মানবদেহের রোগ বিপর্যস্ত হয়েছে প্রকৃতি। উৎপাদন বাড়ানোর এই অস্ত্র মরণাঅস্ত্র হিসেবে আঘাত করেছে মাটি, প্রাণ, প্রকৃতি ও মানবদেহের বিরুদ্ধে। এমন বাস্তবতায় এখনই সময় নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত যাতে সুরক্ষিত হয় প্রাণ, প্রকৃতি ও মানবস্বাস্থ্য। কৃষিনির্ভর দেশে সার কীটনাশক দিয়ে সাময়িক উৎপাদন বৃদ্ধি করে মাটির উর্বরতাশক্তি ও প্রাণ ও প্রকৃতি শেষ হয়ে গেলে কৃষি ব্যবস্থা ও খাদ্য উৎপাদন পরবে চরম সংকটে।
দেশের ছিন্নমূল, ভূমিহীন ও বেকার মানুষ জীবিকার সন্ধানে প্রতিনিয়তই গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটছে। নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও গ্রাম ছাড়ছে অসংখ্য মানুষ। খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষগুলো কাজের আশায় শহরে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে আশ্রয় নিচ্ছে বস্তিতে। স্বাধীনতার আগে ও পরে রাজশাহী সিটি করপোরেশন শহরাঞ্চলে ছোট-বড় অসংখ্য বস্তি গড়ে উঠেছে। মূলত বস্তির এই মানুষগুলো নগরীতে রিকসা, ভ্যান, অটো চালিয়ে ভাংড়ি কুড়িয়ে, বিভিন্ন দোকানে কাজ ও ভাসমান দোকান দিয়ে বাসাবাড়িতে কাজসহ ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বস্তিগুলোতে ঘুরে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যেমে জানা ও বুঝা যায় তাদের আবাসন, মাদক, বাল্যবিয়ে, জলাবদ্ধতা, শিক্ষা, আয়, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, বিনোদন ব্যবস্থা, সুপেয় খাবার পানির সংকট, অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা, দক্ষতা ও মতামত প্রদানের সক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে বসবাস করেন এই বস্তিগুলোর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। স্বল্প জায়গায় অধিক মানুষের বসবাস ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তার উপর স্বল্প আয়ের এই মানুষগুলোর বাজার নির্ভরতা ও অনিরাপদ খাদ্য প্রতিনিয়ত নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠেছে। অনিরাপদ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেমন মানবদেহের জন্য হুমকি তেমনি অনিরাপদ খাবারও যে কোন প্রাণের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।
রাজশাহী নগরের বুধপাড়া, বহরমপুর,দাসপুকুর, শ্রীরামপুর, কাসিয়াডাঙ্গা, নামোভদ্রা, জামালপুর এবং রূপালি বস্তিসহ বিভিন্ন বস্তিতে এখন ক্যারেট, টব পদ্ধতিতে এবং গর্ত করে মাটি শোধন করে সবজি চাষ করছেন অনেকে। ভূমিহীন মানুষ শহরে তাঁদের ঘরের পাশে স্বল্প জায়গায় পুঁইশাক, লাউ, সীম, মরিচ, আলু, বেগুনসহ নানা জাতের সবজির চাষ করছেন। শুরুটা হয়েছিলো ২০২০ সালে যখন মহামারি করোনাকালিন খাদ্য সংকট দূর করতে প্রতি ইঞ্চি মাটির ব্যবহারের প্রতি জোর দেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে লক্ষ্যে রাজশাহীর বস্তিগুলোতে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারিসক এ কাজে কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। দেশীয় জাতের সবজি বীজ, ক্যারেট এবং প্রয়োজনীয় জৈবসার দিয়ে সহায়তা করে প্রতিষ্ঠানটি। দিনে দিনে এই কাজের সম্প্রসারণ ঘটেছে। বর্তমান নগরীর নামোভদ্রা বস্তি, বহরমপুর, জামালপুর,বুধপাড়া শ্রীরামপুরসহ বিভিন্ন বস্তিতে প্রায় হাজারের বেশি পরিবার এই পদ্ধতিতে সবজির চাষ করছেন। তাঁদের দেখাদেখি এখন নগরীর প্রায় প্রতিটি বস্তিতে মানুষ নিজের ঝুপড়ি বা টিনের চালাতে সবজি চাষ করছেন।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মতিহার থানার ৩০ নং ওয়ার্ডের বুধপাড়া রেল কলোনী বস্তিতে মাজেদা বেগম (৬০+) এর বসবাস। স্বামী ডায়রিয়াতে মারা গেছেন বছর খানেক আগেই। এক ছেলে ২ মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালান তিনি। বারসিক’র বীজ বিনিময়ে ও পরামর্শে বাড়ির আঙ্গিনায় স্বল্প জায়গায় সবজি চাষের উদ্যোগ নেন। মাজেদা বেগম বেগুন, মরিচ, সবুজ শাক, লালশাক, বরবটি অল্প অল্প করে লাগিয়ে সার বিষ মুক্ত সবজি চাষ শুরু করেন। সফলতাও পান নিজের চাষকৃত সবজি তার পরিবারের সবজি ও তরকারীর চাহিদা পূরণ করে। ফলে তার নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির পাশাপাশি পারিবারিক ব্যয় কমে। মাজেদা বেগম এর মত একই বস্তির অনেকেই নিরাপদ সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেন। বারসিক রাজশাহীর সহায়তায় মাজেদা বেগমের নেতৃত্বে এই বস্তিতে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে গঠন হয় বুধপাড়া ভূমিহীন নারী উন্নয়ন সংগঠন। সংগঠনে আলোচনার মাধ্যেমে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বস্তিতে ১১টি পরিবার স্বল্প জায়গায় অধিক সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে দোচালা বাহান তৈরি করে সবজি চাষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যার ধারাবাহিকতায় বারসিক থেকে উপকরণ সহায়তা পেয়ে এই বস্তির ১১টি পরিবার দোচালা বাহান তৈরি করে স্বল্প জায়গায় অধিক জাতের নিরাপদ সবজি উৎপাদন শুরু করেন।
সংগঠনের সভাপ্রতি মাজেদা বেগম বলেন, ‘আজ থেকে ৩৫/৩৬ বছর আগে এই রেল লাইনের ধার ঘেসে জঙ্গল কেটে আমরা বসবাস শুরু করি। আস্তে আস্তে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষের বসবাস শুরু হয় এই পাড়ায়। রিকসা, অটো, বাসাবাড়িতে কাজসহ নানা ধরনের কাজ করে কোন রকমে সংসার চলে। হঠাৎ বড় ধরনের সমস্যা সমাধানে টাকার যোগান দিতে করতে হয় ঋণ। করোনার সময় কাজ কাম ছিলো না। আমরাতো দিন আনি দিন খাই। সেই সময় সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার হতো। তখন আমরা ঘরের আঙ্গিনায় অল্প অল্প করে নিজেদের খাবারের জন্য সবজি চাষ শুরু করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বারসিক থেকে পাওয়া পরামর্শ ও সহায়তায় আমরা এখন সার বিষ ছাড়াই অল্প জায়গায় অনেক সবজি চাষ করছি। বেগুন, মরিচ, সবুজ শাক, লালশাক, বরবটি এখন নিজের চাষ করা জায়গা থেকেই তুলে খেতে পারছি, আর কেনা লাগছে না। এতে আমাদের সংসার খরচ কমেছে। পাশাপাশি সার বিষ বাদে তৈরি এই সবজিগুলো খেতেও অনেক স্বাদ লাগে, যা বাজার থেকে কেনা সবজি থেকে পাওয়া যায়না।’
মাজদো বেগম বলেন, ‘আমরা একটি সংগঠন তৈরি করেছি। আমার মত এই পাড়ায় রিয়া, নাসিমা, রুবিনা, মরিয়ম, বুলবুলি, নিলা, সমেজান, কাজলী, লতিফা, আলেয়া সবাই অল্প জায়গায় বাহান করে বেশি সবজি উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। বারসিক আমাদের ২০২৩ সালের শীত মৌসুমের আগে বাহান করার জন্য বাঁশ ও সুতা সহায়তা করেছেন। আমরা সেগুলো দিয়ে বাহান করে সবজি চাষ শুরু করেছি। আমাদের এখন শাকসবজির জন্য বাজারে যেতে হয়না। একে অপরের সাথে বিনিময় করে আমাদের সকল ধরনের সবজির চাহিদা পূরণ করি। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত সবজি বিক্রি করে বাড়তি আয়ও হয়। লাউ, সীম, কুমড়া, লালশাক এর বীজ আর কিনতে হয়না। নিজেরাই বীজ করে রাখি আবার পরের সীজনে লাগানোর জন্য।’
মাজেদা জানান, আমাদের এই উদ্যোগ শুধু টাকা খরচ কমায়নি আমাদের একত্রিতও করেছে। বিষমুক্ত নিরাপদ খাবার পাচ্ছি আবার একে অপরের সাথে যখন সবজি বিনিময় হচ্ছে তখন সম্পর্কও গভীর হয়েছে। ফলে আমাদের পাড়ায় আগের মতন ছোট খাটো বিষয় নিয়ে গোন্ডগোল আর হয়না। একজনের বিপদে এখন সবাই পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।’ রাজশাহী বুধপাড়া বস্তির মাজেদা বেগমদের মতন নিরাপদ খাবার উৎপাদন উদ্যোগ যেমন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করছে পাশাপাশি মাটি ও প্রাণ, প্রকৃতি সুরক্ষিত করছে।
গ্রাম বাংলায় একটি কথা প্রচলন আছে, ‘মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ছেলে মেয়েকে মুখে তুলে দিয়ে তাদের মানুষ করতে পারলে তারা ভালো বুদ্ধি সমৃদ্ধ হবে। এই খাবারগুলোকে ভালো মন্দ খাবার বলে আমাদের সমাজে পরিচিত। কিন্তু বিষয়টি কি তেমন আছে আর? রাসায়নিক, কীটনাষক, ফিডসহ প্রাণ, প্রকৃতি ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে উৎপাদিত এসব খাবার এখন নিরব বিষ হয়ে উঠেছে। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে শুধু তিন বেলা খাবার এর যোগান ব্যবস্থা করা নয়; খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে নিরাপদ খাবার নিশ্চিত বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।