কৃষি ও কৃষকই দেশের প্রাণ: কৃষক সন্তোষ মন্ডল

কৃষক সন্তোষ মন্ডল মানকিগঞ্জ জলোর সিংগাইর উপজলোর বলধারা ইউনিয়নের বাংগালা গ্রামে তার পৈত্রিক নিবাস।এ গ্রামইে তার র্বতমান বসবাস। ১৯৬৯ সালে এস,এস,সি ও ১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমকি পাশ করনে। তৎকালনি সময়ে পেতে পারতেন ভালো কোন চাকুর। কিন্তু চাকুরি করার মানসকিতা কখনই তৈরি হয়নি তার। ইচ্ছে ছিল নিজেই কিছু করবেন। তাই পরিবার পরিকল্পনায় ভালো সরকারি চাকুরি করার সুযোগ থাকা স্বত্বেও নিজেকে যুক্ত করনে কৃষি পেশায়। কৃষি পরবিাররে সন্তান হিসেবে বাবার কাছ থেকেই কৃষি বিষয়ক জ্ঞান আত্মস্থ করেছিলেন। বাবার কাছ থকেে অর্জন করা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজেকে একজন আর্দশ কৃষক হিসেবে মেলে ধরেছেন গ্রামের সকলের কাছে। কৃষি কাজ করে নিজেকে একজন সাবলম্বী মানুষ হিসেবে তৈরি করেছেন। খুবই কাছ থেকে দেখেছেন কৃষির একাল সেকাল দেখেছেন কৃষিকর আমূল পরিবর্তন। তিনি দেখেছেন প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর জনগোষ্ঠীর স্থানীয় কৃষি চর্চা। আবার স্থানীয় এই কৃষি চর্চা কিভাবে কোম্পানীনির্ভর কৃষিতে পরিণত হলো তা স্কৃবচোখে উপলব্ধি করছেন। তিনি মনে করেন কৃষি যখন কৃষকের নিয়ন্ত্রণে ছিল তখন কৃষকের লাভ হতো। কিন্তু বর্তমান কৃষি কাজ কোম্পানীনির্ভর হওয়া বীজ,সার, কীটনাশক,অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া কৃষি থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে। কৃষি কাজে সন্তোষ মন্ডল যেমন আনন্দ পান সেই সাথে কৃষককে উপযুক্ত সম্মান না থাকায় নানা ধরনের আক্ষেপ রয়েছে তার। কৃষক সন্তোষ মন্ডল আনন্দ বেদনার বৈচিত্র্যময় কৃষি জীবন নিয়ে খোলা মনে কথা বারসিক নিউজ.কমের সাথে। আলোচনার মুল কথাগুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরছেনে সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান।


বারসিকনিউজ .কম: কেমন আছেন? র্বতমানে আপনার পেশা কি?
সন্তোষ মন্ডল: ভালো আছি। কৃষি আমার প্রধান পেশা। কৃষি কাজ করছি।
বারসিকনিউজ .কম: : আপনি তো লেখাপড়া জানা মানুষ ভালো চাকুরি করতে পারতেন? কৃষি কাজে কেন আসলেন?
সন্তোষ মন্ডল : হ্যাঁ ভালো চাকুরি করতে পারতাম। কিন্তু চাকুরি করা পছন্দ করতাম না। ইচ্ছে ছিলো নিজে কিছু একটা করবো। তাই প্রথমে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করি কিছু টাকা সঞ্চয়ও হয়। তাছাড়া নিজেদেরেই কৃষি কাজ করার মত যথেষ্ট জমি ছিল। তাই চাকুরির পিছনে ছুটিনি। তাছাড়া চাকুরি করার চেয়ে কৃষি কাজে তখন আয় বেশি ছিল। আর কৃষি হলো স্বাধীন পেশা। তাই কৃষি কাজ করি।
বারসিকনিউজ .কম: আগে কৃষি কাজে কেমন লাভ হতো? কেন হতো?
সন্তোষ মন্ডল: আগে কৃষি কাজে লাভ বেশি হতো। চৈতালি ফসলসহ নানা ধরনরে ফসল চাষ করতো কৃষকরা। তখন কোন সার বিষের ব্যবহার ছিল না। নিজেরাই বীজ রাখতাম। কোন বীজ বাজার থেকে ক্রয় করতে হতো না । সকলেই গরু পালন করতো। সার হিসাবে সবাই গোবর ব্যবহার করতো। তখন উৎপাদন খরচ কম হতো। তাছাড়া আমাদের এলাকা নুরানীগঙ্গা নদী ও কালি গঙ্গা নদী ঘেরা। নদীর পানি জমিতে আসতো প্রচুর পলি পড়ায় মাটি ছিল উর্বর।

বারসিকনিউজ .কম: :এই যে আপনি বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের কথা বললেন ? তখন কি কি ফসল চাষ হতো?
সন্তোষমন্ডল:তিল,পাট,কাউন,গম,পায়রা,যব,খেসারমুসুর,কালমিটর,ছোলা,ডাবড়,মটোর,মুগ,সরিষা,মাসকালাই,আউশ,আমন,হজিলদিঘা,মধুশাইল,ডেপু,কটক তারা,কালামানকি, আমশাইল,চিনিগুড়া, ভাওয়াল্য, হরহরা, নজোবরন, শামু ভাংগা, দিঘা, হলদে পাতা, মুক্তাশ্বর, দুধ ভাওয়াল্যা, বরণ, পুরপুির, মরচিফিুল, কালা মানকি, পরাংগি কৈজুরী বাওইঝাক, বাশফুল। নানা ধরনের সবজি।

বারসিকনিউজ .কম : এখন কি এলাকায় এধরনের ফসল চাষ হয়? না হলে কেন হয় না বলতে পারেন?
সন্তোষ মন্ডল : হয় তবে সব ফসল হয় না। তাছাড়া নদী নালা,খাল বিল শুকিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক পানিনির্ভর ফসল চাষ হয় না।যেমন ধানের জাতগুলো হারিয়ে গেছে। তাছাড়া আগে জনসংখ্যা কম ছিলো। খাদ্য চাহিদা কম কম ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য চাহিদা বাড়তে থাকে, কৃষি কাজে র্বতমানে খরচ বেড়ে গেছে কারণএখন কৃষি আর কৃষকের কাছে নাই। সবই বাজার থেকে কিনতে হয়। যেমন: সার, ঔষধ, বীজ, হাল চাষ সবই কিনতে হয়।
বারসিকনিউজ .কম: আপনি কি কি ফসল উৎপাদন করেন ?
সন্তোষ মন্ডল : আমি বেশি সবজি চাষ করি। আমার চাষকৃত সবজির মধ্যে গোলআলু, ঝিংগা, চিচিংগা, বেগুন, ঢাটা,পুইশাক, ঢেরস, চালকুমড়া,ধুন্দুল, পাটশাক, বিলাতি ধনে কালজিরা, পিয়াজ রসুন, মুলা, মিষ্টি আলু, লাউ, সীম,বরবটি কপি ইত্যাদি।
বারসিকনিউজ .কম : আপনি কৃষির লাভ কিভাবে দেখেন?
সন্তোষ মন্ডল : শোনেন কৃষি আমার প্রধান পেশা। এই কৃষি কাজ দিয়েই সন্তান মানুষ করছি, জমি কিনছে, ঘর দিয়েছি।তাদের লেখাপড়া শিখিয়েছি। আমার সংসারে কোন অভাব নাই। এটাই তো কৃষি কাজে আমার লাভ। তাছাড়া শুধু কৃষি কাজ করলেই লাভ হয় না; কৃষককে লাভ করতে হলে নানা কৌশল নিতে হয়।
বারসকিনউিজ.কম: আপনি কৃষি কাজে কৌশলের কথা বললনে? আপনি আসলে কি ধরনরে কৌশল গ্রহণ করেছেন?
সন্তোষ মন্ডল: হ্যাঁ আমি কিছু কৌশল করে কৃষি কাজ করি। যেমন আমি রাসায়নকি সার, কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক নিজে তৈরি করে ব্যবহার করি। নিজে বীজ সংরক্ষণ করি, বাজার থেকে কোন বীজ ক্রয় করি না। শ্রমিকের কাজ নিজেই করি। উৎপাদন খরচ কম হয় লাভ বেশি হয়।
বারসিকনিউজ .কম: জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করার পরার্মশ কোথায পেলেন? কিভাবে তৈরি করেন?
সন্তোষ মন্ডল : আগে থেকে আমি জমিতে শুধু অল্প পরমিাণে গোবর ব্যবহার করতাম। বাংগালা নবকৃষক কৃষাণী সংগঠন নামে আমাদের একটি কৃষক সংগঠন আছে। নিয়মিত কৃষি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি তারপর বারসিক আমাদেরকে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক,তৈরি করার কৌশল শিখিয়ে দেয়। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি হাউজে গোবর,কলা গাছ,খরকুটো দিয়ে কেচো সার তৈরি করি এবং তাছাড়া বিষকাটালি ভাটি গাছের পাতা, পাটের দানা মেহেগনির ফল দিয়ে পোকা মাড়ার ঔষধ তৈরি করি তাতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন হয়।
বারসিকনিউজ .কম: এই যে আপনি বৈচিত্র্যময় ফসল চাষরে কথা বললনে? তখন কি কি ফসল চাষ হতো?
সন্তোষ মন্ডল : তিল,পাট, কাউন, গম,পায়রা, যব,খেসারী, মুসুরি কালমিটর, ছোলা, ডাবড়,মটোর, মুগ,সরষিা, মাসকালাই, আউশ, আমন, হজিলদঘিা, মধুশাইল,ডেপু, কটক তারা,কালামানকি, আমশাইল,চিনিগুড়া, ভাওয়াল্য, হরহরা, নজোবরন, শামু ভাংগা, দঘিা, হলদে পাতা, মুক্তাশ্বর, দুধ ভাওয়াল্যা, বরণ, পুরপুির, মরচিফিুল, কালা মানকি, পরাংগ, কৈজুরী বাওইঝাক, বাঁশফুলসহ নানা ধরনের সবজী।

বারসিকনিউজ .কম: এই যে আপনি বললেন বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করেন। এই সবজিগুলো বিক্রি করেন কোথায়? চাহিদা ও লাভ কেমন হয়?
সন্তোষ মন্ডল : আমার বাড়ির পাশে বড়কালিয়াকৈর বাজারে নিরাপদ খাদ্য বিক্রির জন্য আলাদা স্থান নেওয়া আছে। সেখানে বিক্রি করি। আমার সবজির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আমার কাছ থেকে যে একবার সবজি কিনে সে আবার বাড়িতেও আসে। অনেক সময় বাজার পর্যন্ত লাগে না পথ থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। অন্য মানুষের চেয়ে পাচ দশ টাকা বেশিতে বিক্রি করি। বেশ লাভ হয়।

বারসিকনিউজ .কম: বর্তমান ও অতীত কালের কৃষির তুলনা করবেন কিভাবে?
সন্তোষ মন্ডল : আগের কৃষি ছিলো প্রকৃতি নির্ভর গরু দিয়ে হাল চাষ হতো। বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে সেচের কাজ হয়ে যেত। দেশী জাতের কদর ছিল। সকলের বাড়িতেই বীজ রাখার ব্যবস্থা ছিল। কৃষি ছিল কৃষকের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বর্ত মান কৃষি সর্ম্পূণ কোম্পানীনির্ভ র হয়ে পড়েছে। কৃষির কোন কিছু্ই আর কৃষকের নিয়ন্ত্রণে নেই। সার, বীজ, কীটনাশক, জমি শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
বারসকিনউিজ.কম : কৃষক হিসাবে আপনার কোন অর্পূণতা আছে যা আপনাকে পিড়া দেয় ?
সন্তোষ মন্ডল :বাংলাদেশ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি ও কৃষক না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। যে কৃষক সারাদিন পরশ্রিম করে ফসল ফলায় সেই কৃষকই থাকে ঝুঁকির মধ্যে।কৃষকের নেই কোন পেনশন, বীমা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। কৃষি ও কৃষকই এদেশের প্রাণ কিন্তু খাদ্য যোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি মেলেনি কৃষকের। এটি সকল কৃষকের জন্য কোন সুখের খবর নয়। আমি চাই সকল কৃষকই তাদের মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাক।তারা যেনো গর্ব করে বলতে পারে আমি কৃষক।
বারসিকনিউজ .কম: আপনার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা কি?
সন্তোষ মন্ডল : কৃষক ঐক্য তৈরি করে কৃষকের অধিকার নিয়ে কাজ করা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে মানুষকে উৎসাহিত করা।
বারসিকনিউজ .কম: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার জন্য শুভকামনা।
সন্তোষ মন্ডল :আপনাকেও ধন্যবাদ।

happy wheels 2

Comments