কাঠের চাকার ভবিষ্যত নিয়ে শংকা

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

আবিষ্কারের নেশায় আসক্ত মানুষেরা প্রাচীনকাল থেকে নতুন নতুন আবিষ্কারে নিয়োজিত করে রেখেছেন নিজেদের। সভ্যতার উৎকর্ষের জন্য উন্নয়নের জন্য তাদের অবদানের ফল ভোগ করছেন পরবর্তী প্রজন্ম। সভ্যতার অগ্রগতিতে চাকা আবিষ্কারের পর ধীর গতির জীবনে এসেছে পূর্বাপেক্ষা বেশি গতি। তবে প্রথমে কে, কোথায় চাকা আবিষ্কার করেছেন এর কোন দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও ধারণা করা হয় যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় প্রথম চাকা আবিস্কৃত হয়। প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে চাকার ব্যবহার। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় চাকার প্রচলন। খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার দুইশত অব্দের দিকে মিশরে যান্ত্রিক কাজে চাকার ব্যবহার শুরু হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করতে স্কটিশ আবিষ্কারক জন ডানলপ ১৮৮৮ সালে মোটর গাড়িতে ব্যবহারোপযোগী চাকা আবিষ্কার করেন। রেলগাড়ি, বিমান, ওয়াগন, মোটরগাড়ি, গরু মহিষের গাড়ি, সাইকেল, রিকসা, ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে চাকার ব্যবহার হচ্ছে।

chaka pic-1

গরু মহিষের গাড়ির চাকা শিল্পের খোঁজ খবর নিতে চাটমোহর পৌর সদর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরের গ্রামীণ জনপদ মূলগ্রাম ইউনিয়নের আটলংকা বাজারে গেলে জানা যায়, চাকা বা চক্র কারিগরদের ভাগ্যের চাকা কেমন ঘুরছে। পথেই দেখা ও পরিচয় হয়ে যায় জামাল নামক এক গাড়িয়াল এর সাথে। তিনি তার মহিষের গাড়ির জন্য এক জোড়া চাকা বানাতে দিতে চাটমোহরের গুনাইগাছা ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আটলংকায় যাচ্ছিলেন। চরপাড়ার মৃত মজির প্রাং এর ছেলে তিনি। জামাল গাড়িয়াল বলেন, “তিরিশ বছর ধরে মহিষের গাড়ি চালাচ্ছি। দিনকে দিন চাকার দাম বাড়ছে। আগে এ এলাকার অনেকেই চাকা বানালেও এখন সবাই ছেড়ে দিয়েছে। এক জোড়া চাকা দুই তিন বছর যায়। বাবলা কাঠ ছাড়া চাকা হয় না। পাশ^বর্তী ভাঙ্গুড়া উপজেলার জগাতলা, গুরুদাসপুর উপজেলার কাছিকাটা ও চাঁচকৈড় এলাকায় দুএকজন চাকা বানায়।” তিনি আরও বলেন, “কার্তিক মাসে আমন ধান পাকে। মাঠ থেকে ধান আনতে সীমিত আকারে হলেও এখনো গরু মহিষের গাড়ির ব্যবহার হয়। তাই এসময় চাকার কদর কিছুটা বাড়ে। সময় বাঁচাতে মানুষ এখন রাবারের চাকা যুক্ত যানবাহন পিকাপ, লসিমন, করিমনে ফসল আনছে মাঠ থেকে।” কথায় কথায় পৌছে যাই চাকা তৈরির কারিগরদের কারখানায়।

chaka pic-2

চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চকচুনাখালী গ্রামের মোজাফফর হোসেনের ছেলে মিজানুর রহমান (৪৫) চাকা তৈরির একজন কারিগর ও ব্যবসায়ী। চাটমোহরের মূলগ্রাম ইউনিয়নের আটলংকা বাজারে ঘড় ভাড়া নিয়ে চাকা তৈরির কারখানা করেছেন। নিজে কাজ করেন এখানে। এছাড়া মাসিক নয় হাজার টাকা বেতনে অপর একজন কারিগর রেখেছেন তিনি। দুজন মিলে এক সাথে চাকা তৈরি ও বিক্রি করেন। বত্রিশ বছর যাবত এ কাজ করে আসছেন তিনি। এর পূর্বে ধানুয়াঘাটা এলাকায় দুই বছর চাকা বানানোর কাজ করেছেন। পনেরো বছর যাবত আটলংকায় গরু মহিষের গাড়ির চাকার ব্যবসা করে আসছেন। মিজানুর বলেন, “গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাকা তৈরির প্রধান উপকরণ বাবলা গাছ কিনি। কখনো চাপাইনবাবগঞ্জের কাঠের মিলের ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে কিনে আনি। বর্তমান প্রতি সিএফটি বাবলা কাঠ ৬শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক জোড়া চাকা তৈরি করতে আট নয় সিএফটি কাঠ লাগে। এক জোড়া চাকা বানাতে একজন কারিগরের ৬ দিন সময় লাগে। একজনের প্রতিদিনের শ্রমের মূল্য ৩শ’ টাকা ধরলে একটি চাকার পেছনে শ্রমিক খরচ আসে এক হাজার ৮শ টাকা। প্রতি জোড়া চাকার দাম আট থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা। জোড়া প্রতি নিজের শ্রমের মূল্যের পাশাপাশি মাত্র সাত আটশ’ টাকা লাভ থাকে।”

chaka pic-3

তিনি জানান, চাটমোহর এলাকায় চাকা তৈরির তেমন কারিগর নেই। আগের দিনের চেয়ে এখন চাকার চাহিদা ও কমে এসেছে অনেক। মাঠ থেকে ফসল কাটার আগে চাকার চাহিদা বাড়ে। সাধারণত চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ এবং কার্তিক থেকে পৌষ এ ছয় মাস চাকার কাজ চলে। বাকি সময় দেশের বাড়ি এলাকায় কৃষি শ্রম বিক্রি করেন বলে তিনি জানান। মিজানুর রহমান বলেন, “অনেক দিন এ এলাকায় কাজ করছি। এলাকায় একটা পরিচিতি আছে আমার। আমার কাছে দূর দূরান্ত থেকে লোক আসে চাকা বানানোর জন্য। কোরবানীর ঈদের পর বাড়ি থেকে এসেছি। এক ছেলে এক মেয়ে আমার। বড় মেয়ে তানিয়া এইটে পড়ে। ছোট ছেলে সিহাব ফোরে পড়ে। বাবার ১৩ শতক বসত বাড়ি ছিল। তিন ভাই আমরা। একেক ভাই ৪ শতকের একটু বেশি করে পেয়েছি। পরিবার নিয়ে সেখানেই বসবাস করি। মাকে তিন ভাই মিলে ভাত কাপুর দেই। সংসার পরিচালনা ও ছেলে মেয়ের পড়ালেখার জন্য দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছি। সব মিলিয়ে কোন রকমে ডাল ভাত জুটছে। কোন রকমে ঘুড়ছে ভাগ্যের চাকা ”।

“বাড়ি গেছে পদ্মার পেটে। সাথে তিন বিঘা জমি ও। এখন নিজস্ব কোন বসত বাড়ি ও নেই। আমাদের সাথে চাঁচার বাড়ি জমি ও রাক্ষসী পদ্মার পেটে গেছে কয়েক বছর আগে। চাঁচার অন্যত্র একটি জমি ছিল। সেখানে বাড়ি করেছে। আমি নিরুপায়। বাড়ি করার মতো কোন জমাজমি ও নেই। বাধ্য হয়ে চাঁচার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। আমার পরিবার এখন সেখানেই বসবাস করে। গত আঠাশ বছর যাবত চাকা তৈরি ও নিজের জমিতে কৃষি কাজ করতাম। এখন মিজানুর ভাইয়ের কারখানায় বছরের ছয় মাস চাকা তৈরীর কাজ করি। প্রতিদিনের পারিশ্রমিক ৩শ’ টাকা। একটি অটো ভ্যান আছে বাকী ৬ মাস ভ্যান চালাই”। চাকা তৈরির একজন দক্ষ কারিগর নাটোরের লালপুর থানার পালিদাহ গ্রামের আব্দুল মান্নান সরকার; যিনি প্রতিনিয়ত মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘোড়ানোর কাজে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি তার জীবনের চাকা কিভাবে ঘুড়ছে তা এভাবেই বর্ণনা করেন।

chaka pic-5

তিনি এর সাথে যোগ করে বলেন, “দুই মেয়ে এক ছেলে আমার। বড় মেয়ে মায়া খাতুনকে বিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় মেয়ে সুমাইয়া (১২) আরম বাড়িয়া হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট ছেলে আকাশ স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। এখানে রান্না বান্নার ব্যবস্থা আছে। আমার পেট এখান থেকে চলে যায়। আমি ছাড়াও বাড়িতে তিন জন খানেআলা। ছেলে মেয়েদের পড়া লেখা বাড়ির চাল ডাল মাছ তার তরকারি কেনা বাবদ প্রতিদিন প্রায় তিনশ’ টাকা খরচ। যা উপার্জন করি সব খরচ হয়ে যায়”।

প্রবীনেরা জানান, দুই তিন দশক আগেও চাটমোহরের বিভিন্ন এলাকায় চাকা তৈরি হতো। রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন হওয়ায় এবং সময় বাঁচাতে মানুষ এখন যন্ত্রচালিত চাকাযুক্ত বাহন ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। তবে চলনবিলের উপকন্ঠে অবস্থিত এ এলাকার অনেক কৃষক বিলের মধ্যকার ফসল এখনও মাথায় করে ও গরু মহিষের গাড়িতে করে বাড়ি আনেন। চাকা যুক্ত প্রাচীন বাহন গরু মহিষের গাড়ি ব্যবহার থেকে মানুষ বেড়িয়ে আগ্রহী হচ্ছে চাকা যুক্ত যান্ত্রিক যানবাহনে। ফলে চাকার অবদান বা চাকার ব্যবহার কমছে এমনটি বলা যায় না। তবে গরু মহিষের গাড়ির চাকার কারিগর ও উপাদান সংকটের কারণে এ শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে শংকা রয়েই যাচ্ছে।

happy wheels 2

Comments