ভেজালে বিকোচ্ছে বিখ্যাত ‘হাজারী গুড়’ এর সুনাম
মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম
ইতিহাস বলে বাঙালিরা একদিকে যেমন অতিথিপরায়ণ; অন্যদিকে ভোজনবিলাস। ভোজন বিলাসী রসনা খাবারের তালিকা হাজোরো। এটি আবার ঋতু বা মৌসুম ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তেমনই শীতকালের অন্যতম খাবার হলো খেঁজুরের রস এবং এই রস থেকে তৈরি গুড় এবং গুড় থেকে তৈরি হরেক রকমের পিঠা। খেঁজুরের রস হতে তৈরি গুড়ের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন রকমের স্বাদ ও গন্ধ। খেঁজুর গাছ কাটার ক্ষেত্রে গাছিদের মধ্যে রয়েছে দক্ষতা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। তেমনি রস থেকে গুড় বানানোর মধ্যেও নিগুড় রহস্য। যার ফলে রস থেকে গুড়ের স্বাদের ভিন্নতা তৈরি হয়। যেমন ঝোলাগুড়, চিটা গুড়, পাটালি গুড় প্রভৃতি। আবার এলাকাভেদে খেঁজুর এর রস এবং গুড় এর স্বাদের ভিন্নতা রয়েছে। তবে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকা গুড়ের জন্য বিখ্যাত। এই এলাকায় নানা ধরনের গুড় পাওয়া যায়। তবে এখানকার ‘হাজরী গুড়’ আলাদাভাবে আলোচনা দাবি রাখে।
‘ঝিটকার হাজারী ও পাটালী গুড়’ বাংলার শেষ সুবেদার নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা’র আমল থেকেই অন্যতম লোকায়ত খাদ্য হিসেবে সুনাম বহন করে আসছে। তখনকার সময় এই হাজারী গুড়ের সুনাম ছিল ভুবনজোড়া। জনশ্রুতি আছে, এক সময় ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারের সদস্যরা ‘হাজারী গুড়’ ব্যতীত অন্য গুড় দিয়ে ফিরনি পায়েস বা ক্ষীর রান্না করলে সেটি মুখেই দিতেন না। ‘হাজারী গুড়‘ ছিল নবাবদের খাদ্য তালিকার অন্যতম পছন্দের উপাদান। শীতকালে নবাব পরিবারের গৃহীণিরা এই গুড়ের জন্য অপেক্ষা করতেন। আরও জানা যায়, এই হাজারী গুড় তৎকালীন দিল্লীর বাদশা ও ইংল্যান্ডের রাণীকে উপহার পাঠানো হতো। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকগণ ‘হাজারী গুড়’ উপহার হিসেবে ইংল্যন্ডের রাণীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।
বিখ্যাত এই হাজারী গুড় সম্পর্কে Final report on survey and settlement operations in the district of Dacca নামক নথিতে (১৯০১-১৯১১ খ্রি:) এসকোলী সাহেবের যে মন্তব্য ছিল তা নিম্নরূপ-
“The Cultivation of date palm is practically confined to the western thanas of the district two third of the recorded trees being found in the small thana of Harirumpur. Where 1.5 trees are found in every area. Jhitka in thana Harirumpur is the Centre of the date sugar (Gur) industry in the district “Hazari Gur” being deservedly famous for its purely and flavors.” (তথ্যসূত্র: মানিকগঞ্জের লোক ঐতিহ্য- মো: মোশাররফ হোসেন)
মি. এসকেলী সাহেবের মন্তব্য হতে ধারণা করা যায়, ঝিটকার খেঁজুর গাছ ও হাজারী গুড় আমাদের দেশের এক বিশাল কৃষিভিত্তিক লোকায়ত সম্পদ ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে এই গুড়ের সুনাম এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এখনো এই গুড়ের কদর দেশ বিদেশে রয়েছে। তবে আগের সেই স্বাদ ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে কলের আবর্তে।
আজকে আমরা ভুবন বিখ্যাত মধুময় এই গুড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলছি; কিন্তু বাস্তবে নতুন প্রজন্মের মাঝে গল্প ছাড়া তেমন কিছু দেখানোর নেই। হারিয়ে যাচ্ছে খেঁজুর গাছ, গাছ কাটার গাছি, গুড় তৈরির প্রাকৃতিক উৎস। এগুলোর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। যেমন- জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে খেঁজুর গাছ নতুন করে বেড়ে উঠছে না এবং পুরাতন গাছগুলো হঠাৎ করে মারা যাচ্ছে। পাশপাশি, ইটের ভাটার উত্তম জ্বালানি হিসেবে খেঁজুর গাছ প্রচলিত বলে সারাদেশে আশংকাজনক হারে খেঁজুর গাছের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। যে সকল স্বল্প সংখ্যক খেঁজুর গাছ আছে সেগুলোও রক্ষণাবেক্ষণ ও গাছ কাটার কারিগর নেই এবং নতুন করে কেউ খেঁজুর গাছ কাটা শিখছে না।
এর কারণ জানার জন্য কয়েক জন বিখ্যাত গাছির মধ্যে ঝিটকার আরশাদ আলী বলেন, “খেঁজুর গাছ কাটা অনেক পরিশ্রমের কাজ। আগে আমি একাই ১৬০-১৭০টি গাছ কাটতাম। সেগুলোতে হাড়ি বাঁধতাম, রস করে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতাম ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে। অনেক লাভ হতো। সংসার ভালোই চলতো।” তিনি আরও বলেন, “এখন ৩০০-৩৫০ কেজি দরে গুড় বিক্রি করেও লাভ হয় না। কারণ খেঁজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করার জন্য অন্যতম গুরুত্ব উপাদান হলো জ্বালানি।” তিনি বলেন, “গুড় তৈরি করার জন্য প্রচুর জ্বালানি খরচ হয়। আর সব জ্বালানি দিয়ে খেঁজুরের গুড় হয় না। গুড় তৈরির জন্য সবচেয়ে ভালো জ্বালানি হলো ধান ক্ষেতের নাড়া, খেসারি, মসুড়ি, সরিষার ডাটা। আর এগুলো বর্তমানে তেমন চাষাবাদ করা হয় না। প্রকৃত কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন এবং যারা জমি ভাড়া নেন তাঁরাও লাভজনক ফসল চাষ করে। যে কারণে আমি খেজুর গাছ কাটা বাদ দিয়েছি।” তিনি জানান, গাছগুলো থেকে আগের মতো রস আসে না। বাজারে ভেজাল গুড়ে সয়লাব আসল নকল বোঝা মুশকিল। বাড়িতে ছেলে-মেয়েরা আর পছন্দ করে না যে তিনি গাছে উঠে গাছ কাটেন। কিন্তু তাঁর এখনো নেশা। শীতকাল এলেই যেন খেঁজুর গাছে উঠতে চান। গাছ তাঁর সাথে কথা বলে এবং তিনি সে কথা শোনেন বলে জানান।
ঝিটকার বিখ্যাত হাজারী পরিবারের সপ্তম পুরুষ মো. শামীম হাজারী বলেন, “আজ থেকে প্রায় তিনশত বছর আগে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার ঝিটকা গ্রামের ‘মহাম্মদ আলী’ নামে এক গুড় চাষী তাঁর ফরমুলার মাধ্যমে খেঁজুরের রস থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে ভিন্ন স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের পাটালী গুড় উদ্ভাবন করেন। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে ঐ পাটালী গুড় ‘হাজারী গুড়’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।” তিনি আরও বলেন, “এই বিশেষ ধরনের গুড় আবিষ্কারের ফলে গুড়ের জন্য পরিবারের সুনাম মানিকগঞ্জ থেকে রাজদরবার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে ‘হাজারী গুড়’ তৈরির অর্ডার বা ফরমায়েশ আসতো ঝিটকার হাজারী বাড়িতে।”
হাজারী পরিবারের অধ:স্তন সাত পুরুষ এর হলেন- যথাক্রমে:
হাজারী পরিবারের বর্তমান সদস্যদের অধিকাংশই পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। অনেকেই এলাকা ত্যাগ করেছেন এবং বিভিন্ন জন বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হয়েছেন। শামীম হাজারী বর্তমানে ঢাকায় ব্যবসা করছেন। তাঁর পরিবার এখন এই গুড় তৈরি করেন না। তাঁর মাধ্যমে জানা যায় বর্তমানে কাশেম আলী হাজারীর ছেলে মো. শহীদ হাজারী এই গুড় তৈরি ও বিপননের কাজ করছেন।
এই গুড়ের প্রসারতা বৃদ্ধির ফলে ঝিটকার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে আসে পরিবর্তন। এটি তখন শিল্পে রূপ ধারণ করে। সেই আমলে গুড়ের বিশেষত্ব সুরক্ষার জন্য মহুকুমার প্রশাসক অনুমোদিত গুড়ের গায়ে মার্কা বা সীল মারা হতো। উল্লেখ্য যে, হাজারী গুড় তৈরির ফরমুলটি কেবল হাজরী পরিবারই জানতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো কালের আবর্তে এই গুড়ের স্বত্ব ও পেটেন্ট চুরি হয়ে যায়। অনেকেই আসল হাজারী পরিবারের সদস্য বলে দাবি করে। এভাবে হাজারী গুড় তার ঐতিহ্য হারাতে বসে এবং বাজারে ভেজাল গুড়ের সমারোহ বাড়তে থাকে।
বাজারে অনেক গুড়ের মধ্যেই সিল মারা থাকে। ‘হাজারী’ শব্দটি লেখা থাকে। আসল ‘হাজারী গুড়’ চেনা সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ঝিটকার কালই গ্রামের নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, “হাজারী গুড়ের আগের সেই স্বাদ, গন্ধ, জৌলুস এখন আর নেই। হাজারী বংশের মন্তাজ উদ্দিন গাছি পর্যন্ত এই গুড়ের গুণগত মান ভালো ছিল।”
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এর গুড় ও ফল ব্যবসায়ী মো. আবুল মিয়া বলেন, “এই গুড় উৎপাদন সম্পর্কে ভালো মন্দ বলতে পারব না। তবে এখনো হাজারী গুড়ের প্রচুর চাহিদা আছে। আমরা দিতে পারি না। ক্রেতারা আসল-নকল চিনে না। ব্যবসায়ীরা অনেকেই হাজারী সীল মেরে চলিয়ে দেয়। ফলে আমাদের দূর্নাাম হয়। ক্রেতাদের ভালো জিনিস দিতে চাইলেও দিতে পারি না।” মানিকগঞ্জ বাজারের গুড় ব্যবসায়ীদেরও বক্তব্য প্রায় একই। তবে মাওলানা লোকমান হোসেন বলেন, “এখনো সঠিক ‘হাজারী গুড়’ ৬০০-৭০০ টাকা বিক্রি হয়। কিন্তু অন্যান্য সাধারণ গুড় মাত্র ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হয়। সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে হলেও খাটি ‘হাজারী গুড়’র স্বাদ থেকে কেউই বঞ্চিত হতে চায় না।”
শুধু ‘হাজারী গুড়’ নয়। বর্তমানে মানিকগঞ্জের বাজোরে বিক্রি হওয়া সকল ধরনের গুড়ে খেঁজুরের রসের সাথে চিনি মিশ্রিত করে গুড় বিক্রি করে। শুধু তাই নয়; গুড়ের মধ্যে যে কি পরিমাণ ভেজাল তা সাধারণ ক্রেতাদের বোধগম্য নয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গুড় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “ধানের খড় ভিজিয়ে সেই পানি, তার সাথে আখের গুড় তৈরির গাদ, চিনির গাদ, তেলের গাদ, ফিটকিরি, হাইড্রোস তো আছেই। এই উপকরণগুলোর সাথে সামান্য খেঁজুরের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় গুড়।” বর্তমানে অবিকল খেঁজুরের রসের ফ্লেভারসমৃদ্ধ ক্যমিকেল পাওয়া যায়। সেটি দিয়েও গুড় তৈরি হচ্ছে। এভাবে নানা কায়দায় ভেজাল দেয়া হচ্ছে। মোট কথা টাকা হলেও এখন আর আসল রস, ঝোলা ও গুড় পাওয়া যাচ্ছে না। সামর্থ্য থাকলেও ভালো জিনিস বাচ্চাদের খাওয়ানো যাচ্ছে না।
এ তো হলো ভেজালের গল্প। এর বাইরে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক সমস্যা। যেমন-কয়েক বছর আগেও আমাদের বাড়ির চারপাশে প্রচুর খেঁজুর গাছ দেখা যেতো। বর্তমানে সেটি দেখা যাচ্ছে না। নতুন করে কেউ খেঁজুর গাছ রোপণ করছেন না। ফলশ্রুতিতে খেঁজুর গাছ বিলুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছে। মানুষ কষ্টের কাজ করতে চায় না। তাই খেঁজুর গাছ কাটার গাছিও হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাজারে গিয়ে আমরা খাঁটি গুড় পাবার জন্য কতই না ব্যর্থ চেষ্টা করি।
বৃক্ষ থাকবে না অথচ তার ফল খাওয়ার ইচ্ছা থাকবে এমনটাতো কখনোই কাম্য হওয়া উচিত নয়। খেঁজুর গাছ না থাকলে খেঁজুরের রস কোথায় পাব? এই সমস্যার সমাধান নতুন প্রজন্মকেই নিতে হবে। নতুন করে খেঁজুর গাছ রোপণ করতে হবে। তাকে পরিচর্যা করতে হবে। গাছ কাটার গাছিদেরকে উৎসাহিত করতে হবে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। তাদের এই কারিগরি বিদ্যাকে সম্মান দিতে হবে। তাদেরকে বিভিন্নভাবে সম্মানিত করতে হবে। প্রকৃতির অফুরন্ত ভান্ডার রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে আমাদেরকেই। তবেই আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সুস্বাদু ‘হাজারী গুড়’ সহ সকল প্রকার খেঁজুরের গুড়, রস, ঝোলা ও পাটালি গুড়ের আসল ঘ্রাণ ফিরে পাব।