কেমন আছেন গোপালপুর গ্রামের ঋষি পরিবারগুলো?

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম গোপালপুর। এই গ্রামে প্রায় ১৫০টি ঋষি পরিবার আছে। যাদের প্রধান কাজ হলো বাঁশ দিয়ে নানান ধরনের উপকরণ তৈরি, জুতা সংস্কার, এলাকার মৃত/জবাই/বলিকৃত গবাদী পশুর চামড়া ছেলা ও  তা দিয়ে উপকরণ তৈরি, সাথে আছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজ-বাজনা করা ও পালকি বাহকের কাজ করা। এই কাজগুলো তারা তাদের পূর্ব পুরুষের আমল থেকে বংশপরম্পরায়ভাবে করে চলেছেন। এগুলো প্রাচীন ঐতিহ্যর বাহক। এ কাজগুলোর মধ্যে তাদের অন্যতম কাজ ছিলো প্রাচীন ঐতিহ্যিক পেশা বাঁশ-বেতের বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা। স্থায়িত্বশীল গ্রামীণ জীবনযাত্রায় কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, তাতী, কবিরাজ, বনজীবী, আদিবাসীদের মতো ঋষিদের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের তৈরি বিভিন্ন উপকরণের উপর নির্ভর করে অন্যান্য সম্প্রদায়ের পেশা এবং ছন্দময় করে গ্রামীণ জীবনযাত্রাকেও।

এ পেশাকে আগলে তারা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। খুব বেশি আরাম আয়েশে থাকতে না পারলেও কোন রকমে চলে যাচ্ছিলো তাদের জীবনযাত্রা। কিন্তু বর্তমান সময় করোনা মহামারীর করাল গ্রাসে তাদের জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও থমকে গেছে। তার সাথে বর্ষাকাল পড়ে যাওয়াতে তাদের সমস্যা আরো মারাত্মক আকারে ধারণ করছে।

বিগত সময়ে মাঠ পর্য়বেক্ষণে গোপালপুর গ্রামে ঋষি পরিবারের সাথে কথা হলে তারা তাদের জীবনযাত্রার বিপাকে পড়ার কথা বলেন। এ বিষযে গোপালপুর গ্রামের শুম্ভু দাস বলেন,  একসময় আমাদের কাছে ছিলো হস্ত শিল্পের কাজ সেরা পেশা। আমরা খুবই ভালোভাবে আমাদের সংসার চালাতে পারতাম। অন্য পেশার লোকের থেকে কোন অংশে কম ছিলাম না আয় রোজগারে। কিন্তু যেদিন থেকে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের পণ্য বাজারে উঠতে শুরু করেছে। এরপর থেকে আমাদের বাঁশের তৈরি এসব পণ্যগুলো কম বিক্রি হতে শুরু করেছে। কিন্তু কম হলেও আমাদের তেমন একটা অভাব ছিলো না। যে সমস্ত বাঁশের উপকরণ তৈরি করতাম তা যেমন গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করতাম।’ তিনি আরও বলেন, আবার পাইকারীভাবে বাজারে বিভিন্ন দোকানে দিযে আসতাম এবং বাজারে নিজেরাও বিক্রি করতাম। কিন্তু করোনাকালে যেন সব কিছু বন্ধ হতে চলেছে।’

শুম্ভু দাস বলেন, এই করোনাকালে দোকানপাট বন্ধ থাকায় এগুলো বিক্রি করতে পারিনি। বাঁশও সংগ্রহ করতে পারিনি। যার কারণে পণ্য তৈরি করতে পারিনি। আর যদিওবা গ্রামের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কিছু বাঁশ ক্রয় করলেও তা দিয়ে তৈরি উপকরণগুলো বিক্রি করতে পারছিনা। গ্রামে গ্রামে গেলেও সারদিনে একটা-দুইটা বিক্রি হয়। যেসব পাইকারী ব্যবসায়ীরা এগুলো নিতো তারাও বিক্রি করতে পারছেনা। যার জন্য তারাও এগুলো নিচ্ছেনা। আর যদিওবা কেউ নিতে চায় সেটা তারা কম মূল্যে পেতে চায়।’

এ বিষয়ে নিরাঞ্জন দাস বলেন, করোনা যেন আমাদের হাত পা বেঁধে দিয়েছে। আমরা কিছু যেন করতে পারছিনা। বাঁশ বেতের কাজ তো হচ্ছে না। আবার এখন কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হচ্ছে না। বিবাহ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোন বাজ-বাজনা লাগছে না। আমাদের ঋষিদের সব কিছু যেন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে সংসারের কথা ভেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ভ্যান ক্রয় করে ভ্যান চালাচ্ছেন, কেউ মুদি দোকান দিচ্ছেন, কেউ যোন মজুরি দিচ্ছেন, মিস্ত্রির কাজ করছেন, রাজ মিস্ত্রির জোগাড়ী হিসাবে কাজ করছেন।

প্রবীণ নারী গীতা রানী দাস বলেন, গ্রামে আমার একটি সুনাম ছিলো এই বাঁশ বেতের কাজের জন্য। আমি যেমন এটি আমার সংসারের আয়ের মাধ্যম মনে করতাম্! তেমনি গ্রামের অনেক মানুষকে এই কাজ শিখিয়েছি। কিন্তু করোনাকালে বাঁশবেতের কাজ করতে না পেরে আমার পরিবারসহ এখানকার এ্ দাস পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমি, আমার দু ছেলে, ছেলের বৌ, পুতিরা সবাই এ কাজ করতাম কিন্তু এখন আমরা সবাই বেকার। যার কারণে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ঘর বাড়িগুলো বর্ষায় ও ঝড়ে ভেঙে পড়লে তা এখনো সংস্কার করতে পারিনি। নিজেদের কোন আয় নেই খাবার জোগাড় করা যাচ্ছেনা সেখানে ঘর ঠিক করা যেন স্বপ্ন দেখার মতো। ঘর সংস্কারের জন্য সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ঘরের ছবি ও তথ্য নিয়ে গেলেও তার কোন পাত্তা নেই। এখন কম বেশি সব খুললেও তা কাটিয়ে উঠতে কতদিন লাগবে তা বলা যাচ্ছেনা।

প্রতিনিয়ত বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে তাদের সংসারের কথা ভেবে আয়ের জন্য বাইরে যেতে হয়। করোনা পরিস্থিতি এসব পেশার মানুষসহ বলতে গেলে সব শ্রমজীবী মানুষের আয়ের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে।

happy wheels 2

Comments