নবান্ন ও বাঙলার কৃষাণী
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
বাঙালিয়ানার শিল্প সংস্কৃতির অনুষঙ্গের সবটুকুই যেন পেখম মেলে হেমন্তে। বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি এ দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনের সাথে মিশে আছে ঘনিষ্ঠভাবে। তাইতে বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতি বুকে ধারণ ও লালন করে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই।
অগ্রহায়ণ মাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে-মাঠে ধান কাটার ধুম পড়ে গেছে। এই ধান ওঠার পর আসবে শীত। তখন কৃষাণীর ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব শুরু হবে। এটি যেন বাঙালির হাজার বছরের এক ইতিহাস। শত শত বছর ধরে বাঙালিদের মধ্যে নবান্নের পর পিঠা-পুলির ধুম পড়ে যায়। খেঁজুরের গুড়ের পিঠা- এক অনন্য জিনিস।
কৃষাণ-কৃষাণীদের এ সময় অবসরের ফুসরত থাকে না। কিন্তু তারপরও তাদের মুখে থাকে হাসি। এ হাসি এক পরিতৃপ্তির হাসি। চিরাচরিত এই উৎসব আমাদেরর সংস্কৃতির অংশ।
ফসল ফলানোর জন্য কৃষক যেমন ফসলের ক্ষেতে বিরামহীন কাজ করে ক্ষেতে ফসল ফলান আর উৎপন্ন ধান ঘরের গোলায় উঠানোর জন্য কৃষকের যে ব্যবস্থা তার সফল অংশীদার আমাদের দেশের প্রতিটি নারী। প্রতিটি কাজে নারী প্রেরণা হিসেবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। সারাবছরের ফসল ঘরে তোলার আনুষঙ্গিক যে কাজগুলো নারী তার নিজের বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে করেন। যার ফলে সময় মতোই ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হয়। কৃষক জমি থেকে ধান কাটার পর মাড়াই থেকে শুরু ধান ঝাড়া উড়ানো, শুকনো ও পিঠাপুলি তৈরির জন্য প্রস্তুত করা নারীর কোমল হাতের স্পর্শেই হয়ে থাকে। এসব পিঠার মধ্যে বাংলার আবহমান কাল থেকে প্রচলিত ভাপা পিঠা, পাকন পিঠা, মুখসালা, পাটিসাপটা, ক্ষীর, পায়েস ইত্যাদি। তৈরি করা হয় নারকেলের নাড়–ু আর নতুন চাল দিয়ে ভাজা হয় মুড়ি ও খৈই। প্রতিটি কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার পরই পূর্ণতা পায় নবান্ন উৎসবে।
একসময় ঢেঁকিতে ধান ভানা হতো আর সেই চাল দিয়ে খাওয়ার কাজ চলত। আমাদের দেশে এখনো ঢেঁকির প্রচলন আছে। এ কাজ মূলত নারীদের। এ কাজে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে সহযোগিতা করতেন। খুব বেশি দিনের কথা নয়, ঢেঁকিতে ধান ভানার গান ভেসে বেড়াত বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। তারপরও নতুন চালের ভাত মুখে দেয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। নবান্ন উৎসব কেবল গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শহরেও ভিন্ন মাত্রায় আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসবের।
বেসরকারী কৃষি উন্নয়ন ও গবেষনা সংস্থা বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারি বিমল রায় বলেন, “সৃষ্টির আদি পেশা কৃষির সূচনা হয়েছিল নারীর হাত দিয়ে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষাণী মায়েদের অবদান অপরিসীম। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও তাদের ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে এ কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবে এবং দেশে কৃষির উৎপাদন আরো বাড়বে।”