সাম্প্রতিক পোস্ট

একটি সমন্বিত উদ্যোগ, তৈরি হলো পায়ে চলার মেঠো পথ

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা

সময়ের পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, মানুষের দায়িত্বশীলতার অভাব, পারিবারিক চাহিদা বৃদ্ধি ইত্য্যাদি কারণে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য একক পরিবারের। গ্রামীণ পরিবারগুলো সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবনের প্রয়োজনে যৌথ পরিবার থেকে বিভক্ত হয়ে অন্যত্র বাড়িঘর তৈরি করে এককভাবে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস আরম্ভ করে একটুখানি শান্তিতে সংসার করার আশায়। কিন্তু একক পরিবার গড়ে তোলার পর শান্তির পরিবর্ততে অনেক অশান্তি সৃষ্টি হয়। যেমন-একক পরিবারে সন্তানদের দেখাশুনা ও সেবা-যত্নের জন্য লোক না থাকা, সন্তানদের নিরাপত্তাহীনতা, অন্যের সুবিধা-অসুবিধা না দেখে শুধু নিজের স্বার্থ দেখা ইত্যাদি অন্যতম।

Exif_JPEG_420

এমনই কিছু দরিদ্র পরিবারের বসবাস আমতলা ইউনিয়নের গাছগড়িয়া গ্রামে। আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর পূর্বে গাছগড়িয়া গ্রামে মগড়া নদীর পার ঘেঁষে ৪-৫টি পরিবারের বসতি গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে গ্রামের মোট পরিবার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় শতাধিক। এক সময় গ্রামের অধিকাংশ পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত, যদিও তারা কেউ জন্মসূত্রে জেলে ছিলনা। মগড়া নদীর পাড়ে বাড়ি হওয়ায় এবং তখনকার সময়ে নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়ায় গ্রামের লোকেরা নদী থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনা মৌসুমে বছরের প্রায় ৬ মাস নদী শুকনো থাকে, নদীতে পানি না থাকায় কোন মাছও থাকেনা। কিন্তু মাছ ধরার পেশা গ্রামের লোকজন ছাড়তে পারেনি। নদীতে মাছ না থাকলে কি হবে, বর্তমানে গ্রামের অনেক পরিবার নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে গ্রামের বিভিন্ন ফিশারী বা পুকরে মাছ ধরে, কিছু কিছু পরিবার অন্যের জমিতে দিন মজুরের কাজ করে, কেউবা আবার অন্যের জমি লিজ নিয়ে সবজি ও অন্যান্য ফসল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের এক-দু’টি পরিবার ছাড়া অধিকাংশ পরিবারের বাড়ি ভিটেটুকু ছাড়া বাড়তি কোন জমি না থাকায় এবং গ্রামে চলাচালের রাস্তা না থাকায় অন্যের জমির আইল দিয়ে তাদেরকে মূল রাস্তায় উঠে কোথাও যাতায়াত করতে হয়। জমির আইল দিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে প্রায়শই এসব পরিবারের সদস্যদেরকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষভাবে বর্ষা মৌসুমে জমির আইল দিয়ে হাটতে গিয়ে কাদায় নারী ও শিশুদের পিছলে পড়া, কাঁদাযুক্ত আইল মানুষের হাটাচলায় ভেঙ্গে গেলে জমির মালিকদের গালমন্দ শুনতে হয়। তারপরও সেইসব পরিবারগুলোকে নিরুপায় হয়ে সব সহ্য করে জমির আইল দিয়েই চলাচল করতে হয়।

Exif_JPEG_420

গাছগড়িয়া গ্রামের মো. মোন্নাস মিয়ার পরিবার সেসকল পরিবারগুলোর একটি। মোন্নাস মিয়া একজন অত্যন্ত পরিশ্রমী, সৎ, নীতিবান ও আদর্শবান লোক। অন্যের পুকুরে মাছ ধরে বিক্রি করে কমিশনের টাকায় এবং অন্যের সামান্য জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে যে আয় হয় তার উপরই নির্ভর করে তার ৭ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ। মোন্নাছ মিয়ার বড় মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে। কিন্তু ভালো ঘরে বিয়ে দিতে হলে ভাঙ্গা ঘর মেরামত করতে হবে। বিয়ের আগে ঘর তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেও ভ্যান গাড়ি/ঠেলাগাড়ি ঢোকার কোন রাস্তা না থাকায় ঘর তৈরির ইট ও সিমেন্ট কিছুই বাড়ির উঠোনে নিতে পারছেন না। এমন অবস্থায় তিনি অন্য কোথাও গিয়ে বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু শুধু নিজের পরিবারের সুবিধা ভেবে এবং শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে গ্রামের অন্য পরিবারগুলোকে ফেলে অন্যত্র চলে যেতে তার মন সায় দিচ্ছিলনা। রাস্তা না থাকায় এ পরিবারগুলো কোন মালামাল বা তাদের উৎপাদিত পণ্য রিক্সা, ঠেলাগাড়ি বা ভ্যানে করে বাজারে পরিবহন করতে পারতনা। বর্ষা মৌসুমে তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যেত। মোন্নাছ মিয়া গ্রামের পরিবারগুলোর এই সমস্যা সমাধানে একটি রাস্তা তৈরি সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি তার ইচ্ছার কথা নদীর পাড়ে বসবাসকারী পরিবারগুলোর সাথে আলোচনা করলে তারা সকলে মোন্নাছ মিয়ার সাথে একাত্মতা জানায়।

Exif_JPEG_420

কিন্তু নদীর পাড়ের সকল পরিবারগুলো এক মত হলেও বাঁধ সাধে যে দিক দিয়ে রাস্তা যাবে সেই দিকের রাস্তার পাশের পরিবার ও জমির মালিক। তারা কিছুতেই বাড়ির উঠোন দিয়ে রাস্তার জন্য জমি ছাড়তে এবং তাদের জমির মাটি দিতে রাজি হয়না। কোনভাবেই মোন্নাছ মিয়া রাস্তা না থাকায় তাদের দূর্ভোগের কথা ঐ পরিবারগুলোকে এবং জমির মালিকদের বুঝাতে পারেনা। কিন্তু মোন্নাছ মিয়া তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন রাস্তাটি ঘুড়িয়ে নেয়ার। যেদিক দিয়ে রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সে জমিটি আবার অন্য এজন মালিকের। মোন্নাছ মিয়া গ্রামের অন্যান্য পরিবারের লোকদের সাথে নিয়ে ঐ জমির মালিক মো. খায়রুল মিয়ার বাড়ি গিয়ে তাদের সমস্যার কথা জানান এবং তার জমির কিনার দিয়ে রাস্তা তৈরির জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। গ্রাামের সকলের অনুরোধে এবং সকলের সমস্যার কথা বিবেচনা করে জমির মালিক মো. খাইরুল মিয়া তার ১০ কাঠা জমির কিনার ঘেঁষে তিন ফুট প্রস্তের রাস্তা তৈরির অনুমতি দেন।

Exif_JPEG_420

জমির মালিকের অনুমতি পাওয়ার পর প্রায়োজন হয় মাটি কাটা জন্য শ্রমিকের। প্রায় অর্ধ কিলোমিটার মাটি কেটে রাস্তা তৈরি খুব সহজ কাজ নয়, শ্রমিকের মজুরি বাবদ অনেক টাকার প্রয়োজন। অন্যদিকে শ্রমিকেরও বেজায় সংকট। শ্রমিক না পাওয়ায় গ্রামের ভূক্তভোগি সকল পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের নারী-পুরুষ, যুব, কিশোর-কিশোরী, প্রবীণ সকলে স্বেচ্ছাশ্রমে পালা করে রাস্তার জন্য মাটি কাটবে। মোন্নাছ মিয়া ও গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর এই উদ্যোগের খবর বারসিক’র কর্মীর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা (ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার) জানতে পারে। গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীর এই সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়নে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি (মেম্বার) ৮০ দিনের কর্মসূচি “কাজের বিনিময়ে খাদ্য” প্রকল্পের অধীনে একদিন রাস্তার জন্য মাটি কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে শুরু হয় রাস্তা তৈরির কাজ। গ্রামের সকল নারী, পুরুষ ও যুবকরাও হাতে কোদাল ও মাটি কাটার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কাটার কাজে শরিক হয়। একাধারে ৩দিন কাজ করে তৈরি হয় ৩ ফুট প্রস্ত ও একফুট উঁচু একটি সুন্দর পায়ে চলার মেঠো পথ। যে পথের স্বপ্ন পঁচিশ বছর ধরে লালন করেছে গাছগড়িয়া গ্রামের ভুক্তভোগি পরিবারগুলো।

20190108_111923
একটি মহান উদ্যোগ, সামান্য ত্যাগ, কিছু শ্রম একত্র হলে সহজেই অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। সকলের জন্য মঙ্গলজনক এমন যেকোন উদ্যোগ বাস্তবায়নে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, বয়স ও পেশা নির্বিশেষে সকল জনগোষ্ঠি ও অনেক প্রতিষ্ঠানই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সফল বাস্তায়ন হয় উদ্যোগটির। স্বপ্নের রাজকুমার এসে আমাদের সকল সমস্যা সমাধান করে দেবে সেই দুঃস্বপ্ন না দেখে নিজেদের ছোট ছোট সমস্যাগুলো সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ নিজেদেরই নিতে হবে। গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠী, উদ্যোগী ব্যক্তি ও স্থানীয় সরকারের সমন্বিত উদ্যোগের উল্লেখযোগ্য সফল উদাহরণ গাছগড়িয়া গ্রামের ৩ ফুট/১ ফুটের সাইজের প্রায় অর্ধ কিলোমিটারের এই মেঠো পথটি।

আমাদের প্রত্যাশা প্রতিটি গ্রামে মোন্নাছ মিয়ার মত সৎ, পরিশ্রমী ও উদ্যোগী ব্যক্তি এবং খায়রুল মিয়ার মত দাতা তৈরি হবে, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা যখন প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসবে তখনই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অনেক সমস্যা সহজেই সমাধান হবে এবং সাধারণ মানুষ সাবলীলভাবে ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। পরস্পরের মধ্যে গড়ে উঠবে পারস্পারিক সহযোগিতার মানসিকতা, সৃষ্টি হবে পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতা, পরস্পর পরস্পরের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করবে। আর তখনই দেশে গড়ে উঠবে বহুত্ববাদী সমাজ ব্যবস্থার।

happy wheels 2

Comments