পরিবর্তনশীল কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষি উৎসব : একটি চলমান প্রক্রিয়া
মো. এরশাদ আলী, লেখক ও গবেষক
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মূলত হচ্ছে কৃষিনির্ভর। বিভিন্ন ধরনের মেলা ও উৎসব বাংলাদেশের দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনব্যবস্থায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন উৎসবগুলোর মধ্যে কৃষির অস্তিত্ব অনেকখানি বিস্তৃত। অতীতে কৃষিব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন প্রথা, চর্চা ও উৎসব, যা বিভিন্ন সময়ে পালন করা হতো এবং এখনও কিছু কিছু উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। তবে নানা কারণে বিশেষ করে আধুনিক কৃষি আবির্ভাবের পর থেকে কৃষিকেন্দ্রিক এসব উৎসব ও পার্বণ পালনে ভাটা পড়েছে। বিভিন্ন কৃষি উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামের সব কৃষকরা মিলিত হত। বছরব্যাপী পালিত হওয়া কৃষি উৎসব, পূজা, পার্বণ কৃষক-কৃষক সর্ম্পককের রিদ্ধতাকে আরো বেশি মজবুত ও শক্তিশালী করতো। এছাড়া এই সম্পর্কের মাধ্যমে কৃষক-কৃষক কৃষি বিষয়ক জ্ঞান বিতরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। ঐতিহ্যবাহী কৃষি ব্যবস্থাতে যে সব কৃষি উপাদান ব্যবহৃত হতো সেই সব কৃষি উপাদান বা উপকরণগুলো একজন কৃষকের কাছে পাওয়া যেত না বিধায় কৃষকরা একে অপরের উপর বেশ খানিকটা নির্ভরশীল ছিল। কৃষক-কৃষক শক্তিশালী সর্ম্পকের কারণে কোন কৃষক যখন বিপাকে পরত তখন অন্য কৃষক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত।
কৃষিজীবী মানুষের জীবনধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অধিক শ্রম সেই সাথে বিনোদন হলো অধিক উৎপাদনের হাতিয়ার। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিভিত্তিক লোক সমাজজুড়ে লৌকিক শাস্ত্রভেদকে মান্য করার প্রবণতা কম বেশি বিদ্যমান ছিল। হালকর্ষণ থেকে শুরু করে গোলায় ধান তোলা পর্যন্ত ধারাবাহিক লোকজ অনুষ্ঠান পালন করা হত। এই সব বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলো শ্লথ জীবনে গতির সঞ্চার করে বলে জীবনের সাথে ব্যাপকভাবে মিলেমিশে ছিল। (উদ্দিন, মোহাম্মদ সুবাস, ২০০৭: ১৯)। সময়ের পালাবদলে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদের মানুষের জীবনধারা। কৃষি ও কৃষকের সেই দিন আর নেই। কৃষক এখন মোটা কাপড় আর মোটা ভাতের বন্দোবস্ত করতে হিমসিম খাচ্ছে, বাঁচাটাই এখন দায়। (উদ্দিন,মোহাম্মদ সুবাস:২০০৭:৩৪)। কৃষি জমিগুলো তার উৎপাদনের জায়গাতে ঠিক থাকলেও কার্যত কৃষকের পারিবারিক খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কৃষক ও কৃষি প্রতিনিয়ত নিজ অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে। কৃষি বাণিজ্যিকরণের প্রভাব থেকে কৃষকরা মুক্ত নয়। কৃষি বাণিজ্যকরণের হাতছানি তথা অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে কৃষক দিন দিন আগ্রাসী সব ধানজাতগুলোর দিকে ঝুঁকছে। এক দিকে খাদ্য সংকট অন্যদিকে কৃষির অনিশ্চয়তার দোদুল্যমানতায় কৃষক তার শেকড় থেকে ছিটকে পড়ছে।
আমাদের দেশের বিভিন্ন শস্য ফসলসহ প্রাণবৈচিত্র্যের অধিকাংশ আজ বিপন্ন। বিপন্ন হচ্ছে নদী-হাওর-বিল-জলাভূমি-পাহাড়-জংগল এসব প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের অধিকার। অধিক ফসল ফলানোর নামে সহজ সরল কৃষকেরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আজ হারিয়ে যাচ্ছে শস্য ফসল, উর্বরা সোনা ফলানো জমির ওপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ। প্রতিনিয়ত কৃষক তার কৃষি জমি নিজস্ব স্বত্ত্বায় টিকিয়ে রাখা ও হারিয়ে যাবার সংগ্রামে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। নিজস্ব ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও কৃষক এই সংগ্রামের মাঝে কৃষি উৎসবগুলোর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। সময়ে বর্ষা না হওয়া ফসল চক্রের পরিবর্তন ঘটছে। যার ফলে বৈশাখ মাসে হাল বৈশাখের যে রেওয়াজ প্রচলিত ছিল কৃষক তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে পালন করতে স্বামর্থ্য হচ্ছে না। এমন কি কৃষক বেশিরভাগ সময়ই বৈশাখ মাসে চাষাবাদই শুরু করতে পারছে না।
কৃষি উৎসবগুলো কৃষকের নিজস্ব সংস্কৃতির একটি অংশ। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, সংস্কৃতি হলো নতুন সংস্কার। চারিদিকে পুরাতনকে ঝেরে ফেলে দিয়ে নতুনকে স্বাগত জানানোর যেন ধুম পড়ে গেছে। বাজার সংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির সংস্কৃতি, এভাবে আমরা যে নামেই চিহ্নিত করি না কেন এর প্রভাব এসে পড়ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষি সংস্কৃতির উপর। আবার সংস্কৃতিগত এই পরিবর্তনের ফলে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে ব্যবধান ও ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে, যার ফলে উত্তরাধিকার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এখানে উত্তরাধিকারের সমস্যা বলতে বোঝানো হয়েছে যে, কৃষি কেন্দ্রিক যে সব জ্ঞান বা কৃষিকে কেন্দ্র করে যে সব প্রচলিত রীতি নীতি ও উৎসব ছিল সেই সব জ্ঞানগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হত। কৃষি জ্ঞান কেন্দ্রিক এই উত্তরাধিকার ব্যবস্থাপনা বহুজাতিক কোম্পানির প্রচলিত কৃষি সংস্কৃতির প্রভাবে পরিবর্তনের চলমান প্রক্রিয়ায় অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত কৃষি উৎসব ও পার্বণ
বাংলাদেশে বলতে গেলে সারাবছর ধরেই নানা উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণ পালন ও উদ্যাপন করা হয়। সাধারণ মানুষ প্রচলিত এই উৎসব ও পার্বণগুলোর মধ্যে জীবনের বিভিন্ন রঙ, উৎসাহ, আনন্দ, বিনোদন খুঁজে পায়। পালিত এসব উৎসবের মধ্যে কোনটা ধর্মকে কেন্দ্র করে, কোনটা রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এবং কোনটা আবার কৃষিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব উৎসবের রীতিনীতিতে যেমন এসেছে নানা পরিবর্তন তেমনি আধুনিক সমাজ কাঠামোর কারণে কিছু উৎসব ও পার্বণ হারিয়েও যাচ্ছে। আবার কিছু প্রাচীন উৎসব ও পার্বণ বর্তমানে কিছুটা পরিবর্তিতরূপে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও প্রচলিত আছে; অধিকভাবে প্রচলিত না হলেও বয়ষ্ক নারী-পুরুষের মুখে মুখে এইসব উৎসব ও পার্বণ পরিচালনার নানান রীতি-নীতি এখনও শোনা যায়। নিম্নে কিছু কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব ও পার্বণ এবং এগুলো চর্চার প্রচলিত রীতি-নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
আগলওয়া/ আগকাটা
ধানকে এই দিনে ঘরে নেওয়া হয়। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে মূলত আগলওয়া অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু পরিবারে রীতি অনুযায়ী পূর্ব দিকে মুখ করে নির্দিষ্ট ধান ক্ষেতের যেকোন স্থান থেকে এক মুঠো পরিমাণ ধান আগার দিক থেকে কেটে আনতে হয়। পরিবারের যে কোন পুরুষ ব্যক্তিই আগকাটার কাজ করতে পারেন। তবে সাধারণত পরিবারের বয়োঃজ্যৈষ্ঠ পুরুষ ব্যক্তিই এই পর্ব পরিচালনা করে থাকেন। বেশিরভাগ সময়ই অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনে ক্ষেতের সব ধান কাটার উপযোগী হয় না। তাই ক্ষেতের সব ধান পাকার আগেই অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে এক মুঠো পরিমাণ ধানের আগ বা মাথা কেটে আনা হয়। যেহেতু ক্ষেতের সব ধান কাটার আগেই কিছু ধান কাটা হয় এবং ধান গাছের শুধু আগ বা মাথাটুকু কাটা হয় তাই এই পর্বকে আগলওয়া অনুষ্ঠান বলা হয়। ধান ক্ষেতের আগ (মাথা) সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট কিছু দিনক্ষণ মেনে চলা হয়। পঞ্জিকাতে দেওয়া দিনক্ষণ অনুযায়ী আগলওয়া অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে থাকে। শুক্রবার এবং পূর্ণিমা তিথিকে আগ ধান কাটার জন্য উপযুক্ত ক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। এছাড়াও ধান ক্ষেতের আগ (মাথা) সংগ্রহের ক্ষেত্রে বুধ এবং বৃহস্পতিবারও মঙ্গলজনক হিসেবে ভাবা হয়। অন্যদিকে আবশ্যিকভাবে কৃষকরা মঙ্গলবার ও রবিবার ধান ক্ষেতের আগ কাটা থেকে বিরত থাকে। মঠবাড়িয়া উপজেলার কবুতরখালী গ্রামের বিজয় মাস্টার (৭০) এ প্রসঙ্গে বলেন, “বাপ-দাদাদের মুখে শুনেছি এবং নিজেও চাষ করে দেখেছি রবিবার এবং মঙ্গলবার ধান চাষসহ সকল ধরনের ফসল চাষাবাদ ও সংগ্রহ সুবিধাজনক নয়”। তিনি আরো বলেন, “রবিবার হচ্ছে নিঃস্ফলা বার। এই দিনে কোন ফসলের চাষাবাদ শুরু করলে সেই ফসলের উৎপাদন কম হবে। অন্যদিকে মঙ্গলবারকে সাতটি কুযাত্রার বার হিসেবে গণ্য করা হয়, ফলে এই দিনে ফসল চাষাবাদ করলে ওই ফসলের ক্ষতি হওয়াটাই স্বাভাবিক”।
হিন্দু-মুসলিম সব কৃষক পরিবারই আগলওয়ার অনুষ্ঠান করে থাকে। সামর্থ্য অনুযায়ী আগলওয়ার দিনে কৃষক পরিবারগুলো তাদের আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে থাকে। সামাজিক রীতি অনুযায়ী জমি থেকে ধানের আগ (মাথা) কাটার জন্য বাড়ির বয়স্ক পুরুষ ব্যক্তিরা যখন মাঠে যায় তখন ধানের আগ বা মাথাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাড়ির নারী সদস্যরা প্রস্তুতি নিতে থাকে। দুইটি ঘটিতে সমপরিমাণ পানি নেওয়া হয়। ঘটি দুইটিতে আম পাতা, বরই পাতা সাজিয়ে দেওয়া হয়। আম ও বরই পাতা দিয়ে সাজানো ঘটি দুইটি মূল থাকার ঘরের দরজার দুই পাশে রেখে দেওয়া হয়। ঘরের দরজার দুইপাশে সাজিয়ে রাখা ঘটি দুইটিকে শুভযাত্রার প্রতীক হিসেবে ভাবা হয়। অন্যদিকে একটি কুলাতে পান, সুপারি, বিগত বছরের অল্প কিছু ধান ও দূর্বা সাজিয়ে রাখা হয়। কুলাতে সাজানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাড়ির যে পুরুষের দল ধানের আগ বা মাথা সংগ্রহ করতে গেছেন তাদের এই উপাদানগুলোর (পান, সুপারি, ধান, দূর্বা) মাধ্যমে বরণ করা নেওয়া হবে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা জমি থেকে ধানের আগ বা মাথা সংগ্রহ করে বাড়িতে ফেরার পরে বাড়িতে অবস্থান করা নারী সদস্যদের মধ্যে বয়স্ক নারী সদস্য বিশেষ কিছু রীতির মাধ্যমে পুরুষ সদস্যদেরকে বরণ করে নেয়। অল্প হলেও ধানের আগ বা মাথাগুলো পুরুষ সদস্য মাথায় করে বাড়ি ফেরেন। ঘরের দরজায় সাজিয়ে রাখা শুভযাত্রার প্রতীক ঘটি দুইটির জল বাড়ির বয়স্ক নারী সদস্য দুই হাত দিয়ে পুরুষ সদস্যের (যে পুরুষ সদস্যের মাথায় ধানের আগ বা মাথা থাকে) মাথায় ঢেলে দেয়। মাথায় ঘটির পানি ঢেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ডান হাত বাম দিকে বাম হাত ডান দিকে করে ঘটির জল ঢেলে দেওয়া হয়। সংগ্রহ করা ধানের আগ বা মাথাগুলো মূল ঘুমানোর ঘরের পালার (খুঁটি) সাথে বেঁধে রাখা হয়। মূলত আগলওয়া বা আগকাটা অনুষ্ঠান বৈশাখী বা বোরো মৌসুমের ধান জাতের সময় পালন করা হয়।
নয়াখাওয়া
ক্ষেতের সব ফসল যেদিন কাটা শেষ হয়ে যায় সেই দিন কর্তনকৃত ধানের ভেতর থেকে ১০/১৫টি ধানের চাল বের করা হয়। এরপর সংগৃহীত ওই ধানের চালগুলো রান্নার সময় ভাতের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। রান্নাকৃত ভাত সবাই মিলে খাওয়া হয়। মূলত দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা এই রীতিকে নয়াখাওয়া বলে অভিহিত করে থাকেন। বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারই ক্ষেতের সব ফসল কাটার শেষ দিনে মিলাদ আয়োজন করে থাকেন। মিলাদ পড়ানোর পর নতুন ধানের চাল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি অথবা পায়েস পরিবেশন করার রেওয়াজ রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসরত মতুয়া সম্প্রদায়ের (বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী) সদস্যরা অগ্রহায়ণ মাসের ৫ থেকে ৭ তারিখের মধ্যেই নয়াখাওয়া সম্পন্ন করে থাকে। মতুয়া ছাড়া হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা পঞ্জিকার দিনক্ষণ অনুযায়ী নয়াখাওয়ার উৎসব করে থাকে।
বৃহত্তর ময়মসসিংহ অঞ্চলে বসবাসরত ডালু আদিবাসী কৃষক সম্প্রদায় নয়াখাওয়াকে লবাণ্য নামে অভিহিত করে থাকে। সাধারণত লবাণ্য (নবান্ন) উৎসবের দিন ডালুরা বাস্তু পূজা সম্পন্ন করে থাকে। বাস্তুভিটা রক্ষা এবং খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে হিন্দু কৃষক পরিবারগুলো বাস্তু গোপালকে পূজা দিয়ে থাকে। বাংলা অগ্রহায়ণ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) মাসে বাস্তু পূজা করা হয়। যেহেতু বাস্তু গোপাল সারাবছর খাদ্যের যোগান দেয় এবং ঘরবাড়ি রক্ষা করে সেহেতু তাকে (বাস্তু গোপাল) নতুন ধানের খাবার না দেওয়া হলে তিনি বিরাগভাজন হতে পারেন, সেই বিশ্বাস থেকে হিন্দু কৃষক পরিবারগুলো লবাণ্য উৎসবের দিন বাস্তু পূজা করে থাকে। তারা বিশ্বাস করেন যে, বাস্তু গোপাল বিরাগভাজন হলে সারাবছর খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। পাকা ধান কাটার পূর্বে প্রত্যেক পরিবারের নারীরা নিজেদের ক্ষেতের প্রথম ধান সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেতের মাঝখান থেকে সাতটি করে ধানের ছড়া তুলে নিয়ে আসে। সংগৃহীত ধানের ছড়া কুলা করে নিয়ে আসা হয় এবং ধান তোলার সময়ে একটি চালনে করে একটি প্রজ্জলীত প্রদীপ নেওয়া হয়। বাড়ি ফেরার পর উগার ঘরের (ফসল রাখার ঘর) যে গোলায় ধান রাখবে সেখানে এক কোনায় রাখে। সেই ধানের চাল থেকে খিচুড়ি, মিষ্টিদ্রব্য তৈরি করে বাস্তু গোপালের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। লপটান (পূজা পরিচালনার জন্য বিশেষ ব্যক্তি) এই পূজা পরিচালনা করে থাকে। হিন্দু কৃষক পরিবারগুলো বাস্তু গোপালকে উৎসর্গ না করে কোন ধরনের চিকন চাল, সুগন্ধি চাল, আতপ চাল খায় না। যদি কোন পরিবার বাস্তু পূজা না করেই ধানের চাল খেতে চায় তাহলে কাটা ধান থেকে দুই থেকে চার কাঠা (বেতের তৈরি পাত্র বিশেষ) পরিমাণ ধান বাস্তু গোপালের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করে রাখে, পরবর্তীতে সুবিধা মত সময়ে বাস্তু পূজা সম্পন্ন করে। প্রতিটি পরিবারই আলাদাভাবে বাস্তু পূজা সম্পন্ন করে। একটি পরিবারের পূজায় কেবলমাত্র সেই সব পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ ও নৈবদ্য (দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত খাদ্যদ্রব্য) খেতে পারে যারা ইতিপূর্বেই বাস্তু গোপালের পূজা সম্পন্ন করেছে। অশুচি অবস্থায় কেউ বাস্তু গোপাল পূজায় অংশগ্রহণ করতে পারে না।
সাধারণত বাস্তু পূজার জন্য প্রতিটি গ্রামে একটি নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারিত থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে একাধিক গ্রামের জন্য একটি স্থান নির্দিষ্ট থাকে। বাস্তু গোপালের পূজার সময় বাস্তু গোপালের প্রতীক হিসেবে মাটি দিয়ে ঢিবি তৈরি করা হয়, যা অনেকাংশে উইপোকার ঢিবির সদৃশ। এই ঢিবিকে স্থানীয়ভাবে থাইবান বলা হয়। থাইবানের পাশে একটি মাটির ঘট স্থাপন করা হয় এবং ঘটের ওপর একটি গামছা ও একটি ধুতি রাখা হয়। বাস্তু গোপাল পূজার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে পুরোহিত যজ্ঞ করে থাকে এবং যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর পূজা দানকারী পরিবারের সদস্যরা ঘটের ওপরে থাকা গামছা ও ধুতির ওপর তৈরিকৃত খিচুড়ি, ফল, মিষ্টি দ্রব্য উৎসর্গ করে।
হাল বৈশাখ
ঐতিহ্যগতভাবেই বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে সবাই তাদের নিজ নিজ জমিতে চাষ দিতো। সব জমিতে একদিনে চাষ দেওয়া সম্ভব নয় বিধায় বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে প্রত্যেকটি জমিতেই এক পাক কিংবা দুই পাক করে লাঙ্গল দিয়ে রাখতো। বর্তমানেও এই রীতি প্রচলিত রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে সব কৃষক পরিবার এই রীতি পালন না করলেও কোন কোন কৃষক পরিবার হাল বৈশাখের এই রীতি পালন করে থাকে। পাথরঘাটা উপজেলার গোলবুনিয়া গ্রামের কৃষক মো. আমীর হোসেন (৭০) হাল বৈশাখের রীতি সম্পর্কে বলেন, ‘আমার জমির পরিমাণ কম এবং যেটুকু জমি আছে সেই জমিতেই বৈশাখের প্রথম দিনে চাষ দিয়ে দেই’। হাল বৈশাখের অংশ হিসেবে বৈশাখের প্রথম দিনে গৃহপালিত গরুকে স্নান করানো হয়। স্নান সম্পন্ন করার পরে গরুকে বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। এরপর গরুর কপালে তিনটি সিঁদুরের ফোটা দিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া কৃষিতে ব্যবহার হয় এমন সবগুলো উপকরণ (যেমন লাঙ্গল, জোয়াল, মই ইত্যাদি) পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে সবগুলোর গায়ে তিনটি সিঁদুরের ফোটা দিয়ে দিতে হয়।
প্রত্যেকটি পরিবারেই হাল বৈশাখ সম্পন্ন করার পর চাল, ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়। চাল ও ডাল মিশ্রিত খিচুড়ি খাওয়ার পর সবাইকে আখের গুড় খেতে দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে এই খিচুড়ি খাওয়ার অনুষ্ঠানকে ডালখিচুড়ি খাওয়ার অনুষ্ঠানও বলা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাল বৈশাখের আয়োজন পারিবারিক পর্যায়ে সম্পন্ন করা হয়। এছাড়া হাল বৈশাখের দিন আরেকটি কাজ করা হয়। সোলা দিয়ে গোল ফুলের আকৃতি তৈরি করা হয়। এই ফুলটি বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। এরপর ওই ফুলটি ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দেওয়া হয়। এই কাজটি জমির মালিক সম্পন্ন করে থাকেন। তবে পরিবারের যে কেউ এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় হাল বৈশাখের সকল কাজ সম্পন্ন করতে হয়।
পয়লা রোয়া
আষাঢ় মাসে আমন ধান রোপণের জন্য এই বিশেষ চর্চা পালন করা হয়। আষাঢ় মাসে ক্ষেত যখন রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়; তখন এই রীতি পালন করা হয়। ক্ষেতের এক কোনায় ছোট আকৃতির একটি কলাগাছ, একটি কচু গাছ ও কইচ্ছাবন (বিশেষ ধরনের ছন জাতীয় ঘাস) পুঁতে রাখা হয়। জমির মালিকের বাড়ির নারীরা এই কাজ সম্পন্ন করেন। তবে পরিবারে নারী না থাকলে অথবা কোন বিশেষ কারণে নারী যদি এই চর্চায় অংশগ্রহণ করতে না পারে তাহলে পুরুষরা এই কাজ করে। নারীরা শিব কোনায় (ঈশান কোন) সাতটি ধানের গুছি (গুচ্ছো) পর পর রোপণ করে। সাতটি ধানের গুছি রোপণের ক্ষেত্রে প্রথমে বড় দুটো ধানের গুছি রোপণ করা হয়। এই দুটি ধানের গুছি রোপণের ক্ষেত্রে বাম হাত ডান দিকে এবং ডান হাত বাম দিকে করে রোপণ করতে হয়। এক্ষেত্রে ডান হাত উপরে, বাম হাত নিচে থাকে। বড় দুইটি ধানের গুছির মাথা এক সাথে করে বেঁধে দেওয়া হয় এবং বেঁধে দেয়া স্থানে দূর্বা, সরিষার তেলের প্রদীপ থেকে সলতে দিয়ে তেল ছিটিয়ে দেওয়া হয়; পরে ওই বাঁধা স্থানে সিঁদুর দেওয়া হয়। শিব কোনের দিকে মুখ করে এই ধান রোপণ করতে হয়। রোপণ করা হয়ে গেলে, যে জমিতে ধান রোপণ করা হয়েছে, সেখানে নারী-পুরুষ এবং রোপণ কাজে অংশগ্রহণকারী সবাই মিলে ওই ক্ষেতে প্যাক খেলে (কাদা মাটি দিয়ে খেলা)। সবশেষে যে ব্যক্তি ধানের গুছি রোপণের দায়িত্বে থাকেন তিনি ক্ষেত থেকে কিছু প্যাক (কাদা মাটি) নিয়ে এসে উগার ঘরের (ফসল রাখার জন্য বিশেষ ঘর) দরজায় মেখে দেয়। স্থানীয় এলাকাভিত্তিক ধানের গুছিকে রোয়া বলে। তাই ধান রোপণের মৌসুমে জমিতে প্রথম ধানের রোয়া রোপণ করা হয় বলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসরত ডালু আদিবাসী কৃষক সম্প্রদায় এই চর্চাকে পয়লা রোয়া বলে।
কূলই পূজা
মাঘ মাসে পঞ্জিকার দিনক্ষণ অনুযায়ী কূলই পূজা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। কূলই এক ধরনের শক্তির পূজা। কূলই পূজাতে প্রতিমা হিসেবে কুমির ব্যবহার হয়। মা কালীর বিভিন্ন রূপের মধ্যে কুমির একটি রূপ। শাস্ত্র মতে, কূলই পূজাকে ‘কুকি লাক্ষা’ অথবা ভূঁইয়া কালী নামেও অভিহিত করা হয়। কুমিরের প্রতিমা তৈরি করতে বাধ্যতামূলকভাবে কোন গুণরাজ (ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিমা বানাতে সিদ্ধহস্ত ব্যক্তি) লাগে না। তবে কেউ ইচ্ছা করলে গুণরাজ দিয়ে কূলই পূজার প্রতিমা তৈরি করাতে পারেন। বেশিরভাগ সময়ই পরিবারের যে সকল ব্যক্তি প্রতিমা বানাতে সিদ্ধিহস্ত তারা গুণরাজের দায়িত্ব পালন করে থাকে। জমিতে পোকামাকড় যেন না লাগে এবং সার্বিকভাবে ফসল ক্ষেতের উন্নয়নের জন্য কূলই পূজা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। যেহেতু কূলই পূজা ফসলের ক্ষেতকেন্দ্রিক তাই কূলই পূজার বেদী ফসল ক্ষেতের জমিতেই স্থাপন করা হয়। বাড়ির কাছাকাছি কোন জমিতে বেদী তৈরি করার পর সূর্য্যকে স্বাক্ষী রেখে পূর্ব দিক মূখ করে কূলই পূজার জন্য নির্ধারিত প্রতিমা কুমিরকে বসানো হয়। কূলই পূজা সম্পন্নকারী পরিবারের প্রধান পূজা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। কৃষি জমির মালিকেরা পৌষ সংক্রান্তির শেষে পুরো মাঘ মাসের যে কোন সময় কূলই পূজা সম্পন্ন্ করতে পারেন। কূলই পূজা সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ কোন উপাদানের ব্যবহার করা হয় না তবে মাঘ মাসে যে সব ফল সহজেই পাওয়া যায় সেই সব ফলমূল (যেমন বরই, খিরই বা খিরা, কলাই) ব্যবহার হয়ে থাকে। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পূজায় খরচ করে থাকে।
বাদলা হারা
রোয়া (ধান বীজ থেকে জন্মানো ধানের চারা) রোপণ যে দিন শেষ হয় সেই দিন কিংবা পরবর্তী ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে পরিবারভিত্তিক এক ধরনের উৎসব আয়োজন করা হয় যাকে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা স্থানীয়ভাবে বাদলা হারা নামে অভিহিত করে থাকেন। কৃষি মৌসুমের সকল কাজ করানোর জন্য কৃষক পরিবাররা এক বা একাধিক কৃষাণ রাখেন। মূলত বাদলা হারার মাধ্যমে ঐ কৃষাণকে বিদায় জানানো হয়। তাই অনেকে বাদলাহারাকে কৃষাণ বিদায়ের অনুষ্ঠানও বলে থাকে। বাদলাহারা অনুষ্ঠানটি পরিবারভিত্তিক আয়োজন সম্পন্ন করলেও সাধ্যমত সমাজের সকলেই আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। সর্বশেষ যে জমিটিতে চাষ সম্পন্ন হয় সেই জমিতে সকল কৃষাণদের সাথে জমির মালিক এবং পাড়াপ্রতিবেশী সবাই মিলে সারি গান গেয়ে আনন্দ উল্লাস করে থাকে। এই আনন্দের মাধ্যমে জানানো হয় যে, আজ আমার সকল জমির চাষ সম্পন্ন হয়েছে। যেহেতু এই দিনে সকল চাষ শেষ করা হয় তাই এই অনুষ্ঠানকে জমি চাষের সমাপনী উৎসব বলা হয়ে থাকে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়িতে আগত সব অতিথিদেরকে গুইল্টা পিঠা ও গড়গড়াইয়া পিঠা খেতে দেওয়া হয়। গড়গড়াইয়া পিঠা সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, কৃষাণ মাঠের সকল কাজ শেষ করার পরে গড়াইতে গড়াইতে বাড়িতে এসে এই পিঠা খায় বলে একে গড়গড়াইয়া পিঠা বলা হয়ে থাকে। পিঠা খাওয়ার শেষে কৃষক পরিবার তার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য খাবার পরিবেশন করে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাছ ভাত সবার মধ্যে পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
বদুয়া
হারাইনা দিনে (ভাদ্র মাসের শেষ দিন) পরিবারের সবাই মিলে হালুয়া খেয়ে থাকে। দক্ষিণাঞ্চলে হালুয়াকে বদুয়া বলা হয়ে থাকে। এই এলাকার কৃষকদের বিশ্বাস বদুয়া খেলে জমিতে বদুয়া বদুয়া ধান হবে। উল্লেখ্য এক বদুয়া সমান ৮০ কেজি ধরা হয়।
ধানবরণ
মাঘ মাসে যে সমস্ত ধান ঘরে আসে সেই সমস্ত ধান অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে ঘরে নেওয়া হয়। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে ধান ঘরে নেওয়াকেই ধান বরণের উৎসব বলা হয়ে থাকে। খাদ্য লক্ষ্মীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কৃষক পরিবারের বয়োঃজ্যৈষ্ঠ নারী সদস্যের নেতৃত্বে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ফসলের জমিতে যায় (যে জমিতে ধান কাটা হবে সেই জমিতে)। ঢেঁকির মশল, শাওড়া গাছের পাতা, বাঁশের পাতা, পান, সুপারি, বেত গাছের আগা, ভূলা (কাঁশ ফুল), অল্প কিছু ধান (যে ধানগুলোকে বরণ করে নিতে হবে সেই ধান) কলার খোলে সাজিয়ে বাঁশের তৈরি কূলাতে রাখা হয়। এইসব উপাদানের সমন্বয়ে সাজানো কূলা নিয়ে ধান ক্ষেতে গিয়ে ধানকে বরণ করে নেওয়া হয়।
বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে ও কঙ্গস দেবতা
বর্তমান সময়ে এই চর্চা না থাকলেও পূর্বকালে কৃষক পরিবারগুলো অনাবৃষ্টির সময় বৃষ্টি আসার জন্য ব্যাঙের বিয়ে দিতো। যেভাবে বৃহত্তর ময়মসসিংহ অঞ্চলে বসবাসরত ডালু আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হতো ঠিক একইভাবে তারা ব্যাঙেরও বিয়ে দিতো। যে দিন বিয়ে দিবে তার আগের দিন দুইটা ব্যাঙ ধরে খাঁচায় আটকে রাখতো, তখন থেকে বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাঙগুলোকে কিছু খেতে দেওয়া হয় না। সাধারণত হিন্দু ডালু সম্প্রদায়ের বিয়েতে ৯ জন আইড়ো (বিয়ের কাজে সহযোগিতা করার জন্য পুরুষ অথবা নারী) থাকলেও তারা ব্যাঙের বিয়েতে দুইজন আইড়ো রাখে। পুকুর পাড়ে চারটি ছোট ছোট কলা গাছ বার্গাকারে স্থাপন করা হয়। ঠিক যে সব পদ্ধতিতে মানুষের বিয়ের কুঁঞ্জ সাজানো হয়; সেভাবেই কুঁঞ্জ বানিয়ে ব্যাঙের বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। নির্দিষ্ট নিয়মে বিয়ে দিয়ে ব্যাঙ দুটোকে পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়। কৃষক পরিবারগুলো বিশ্বাস করে যে, এই বিয়েতে ওই ব্যাঙ দুইটি খুশি হয়ে ডাকবে এবং ব্যাঙ ডাকার পরই বৃষ্টি হবে। অতীতে যদি বৃষ্টির দিনে অনাবৃষ্টি সৃষ্টি হত এবং অনাবৃষ্টির কারণে যদি প্রকৃতিতে গরম হাওয়া বইত তখন সব গ্রামের নারীরা ফসলের জমিতে একসাথে মিলিত হয়ে বৃষ্টি নামার জন্য গান গাইত। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার ডালুদের (আদিবাসী সম্প্রদায়) বিশ্বাস মতে, ওই সময় বৃষ্টির দেবতা কঙ্গস খুশি হয়ে তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ বৃষ্টি বর্ষণ করত।
বৃষ্টির জন্য যে প্রার্থনা সংগীত ডালু নারীরা বৃষ্টির দেবতার উদ্দেশ্যে পরিবেশন করত তা হল-
একেতো রবিরও জ্বালা
আরোও হইলো মোর শরিরও কালা
কঙ্গসরে কোথায় যাইয়া পাবো ঠান্ডা পানি
কোমারেরও কাঞ্চা হাড়ি
ধরাও কঙ্গাস ঠান্ডা পানি
কঙ্গসরে কোথায় যাইয়া পাবো ঠান্ডা পানি
তোর কপালে দিলাম তিলকের ফোঁটা
কঙ্গসরে কোথায় যাইয়া পাবো ঠান্ডা পানি
(নালিতাবাড়ী উপজেলার সালমারা গ্রামের লহরী রানী ডালুর কাছ থেকে সংগৃহীত)
কৃষক ও কৃষির আত্মিক সম্পর্ক : ভঙ্গুর অবস্থান
পরিবেশ-প্রকৃতির সাথে মানুষের আন্তঃসর্ম্পকের বিষয়টি প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক সময় থেকে প্রমাণিত হয়ে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে মানুষ বিশ্বাস করত প্রকৃতির মধ্যে অতি-ভৌতিক, জীবনধাত্রী এবং জীবনধারণ করার মত সকল শর্ত বিদ্যমান রয়েছে। এ জন্য প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাত, প্রশংসা ও প্রার্থনা করত। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা মিশ্রিত চেতনা ছিল বলেই মানুষের সাথে প্রকৃতির সহমর্মিতার সম্পর্ক দৃঢ় ছিল।
পৃথিবীতে কৃষির উদ্ভব হওয়ার পর থেকে প্রকৃতির সাথে মানুষের ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রচলনের পর থেকে পরিবেশ-প্রকৃতির সাথে মানুষের আন্তঃসম্পর্কে ফাটল ঘটতে থাকে। ফলে মানুষ, কৃষি ও প্রকৃতি-পরিবেশ মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। আধুনিক কৃষি রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রবর্তনের কারণে একদিকে এটি যেমন পরিবেশ-প্রকৃতির বিনাশ করে তেমনি বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের জন্য কৃষকদেরকে বাজার নির্ভরশীল করে তুলে। ফলে কৃষিচর্চার ক্ষেত্রে পরিবেশ-প্রকৃতির সাথে কৃষকদের দুরত্ব সৃষ্টি হয়। কারণ কৃষক পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এভাবে প্রকৃতি-পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থার সাথে ধীরে ধীরে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কৃষকদের আত্মিক সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। কৃষিচর্চার মাধ্যমে কৃষক আগে যেভাবে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণ করতো আজ বাণিজ্যিক কৃষিচর্চার মাধ্যমে অনবরতভাবে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাওয়ায় সম্পর্কের ভিতটাও দুর্বল হতে থাকে। অন্যদিকে আধুনিক কৃষিব্যবস্থার কারণে মানুষের ভোগবাদী আচরণের মাত্রাও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অতিরিক্ত ভোগবাদী আকাঙ্খাকে নিবারণের জন্য প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে সম্পদ সংগ্রহের মাত্রাও বেড়ে গেছে। এই সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে মানুষ স্থায়িত্বশীলতার কথা চিন্তা করে না; সে শুধু চিন্তা করে প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে কীভাবে আরও বেশি করে সম্পদ সংগ্রহ করা যায়। এই আগ্রাসী আচরণের কারণে মানুষ প্রকৃতিকে আর বন্ধু হিসেবে বিবেচনা না করে অবিরামভাবে একে শোষণ করছে। ফলে ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য, পাল্টাতে যাচ্ছে মানুষের সাথে প্রকৃতি-পরিবেশের ঘনিষ্ট সম্পর্ক।
স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা: এটাই আমাদের স্বপ্ন
কৃষির উৎপাদন পদ্ধতি এবং মানুষের জীবিকার উৎসকে কেন্দ্র করে যে সকল আচার অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, পুরাণ ইত্যাদি সমাজে গড়ে উঠেছিল সেই সব উৎসবগুলো মানুষের ভোগবাদী আচরণের প্রভাবে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আবার স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারি, তাহলে কৃষির মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।